শুধু জ্বালানি উৎপাদন নয়, তার জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল থেকে শুরু করে গোটা প্রক্রিয়াও হতে হবে সহজ৷ বর্জ্য পদার্থ কাজে লাগাতে পারলে তো আরও ভালো৷ জার্মান বিজ্ঞানীরা এমনই এক প্রযুক্তি পরীক্ষা করছেন৷
বিজ্ঞাপন
প্রতি বছর লাখ লাখ টন নর্দমার জল ও কাদা ফেলে দেওয়া হয়৷ নষ্ট হয় খড় ও কৃষিজাত আবর্জনাও৷ খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের উৎপাদনের সময় এই সব বর্জ্য সৃষ্টি হয়৷ সেই সঙ্গে মূল্যবান জ্বালানিরও অপচয় ঘটে৷
জার্মানির ফ্রাউনহোফার ইনস্টিটিউট-এর কর্মীরা নতুন ধরনের এক অরগ্যানিক জ্বালানি প্লান্ট তৈরি করেছেন, যার মধ্যে উদ্ভিদজাত ও প্রাণীজ বর্জ্য থেকে জ্বালানি উৎপাদন করা যায়৷ নতুন এই প্রযুক্তির মাধ্যমে থার্মাল-কেমিকাল রূপান্তর প্রক্রিয়ায় অরগ্যানিক বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ ও উত্তাপ সৃষ্টি করা যায়৷ যে কোনো কঠিন বা তরল কাঁচামাল ব্যবহার করা চলে৷ তবে ছোট দলার মতো আয়তন হলে তা পরিবহণের জন্য সুবিধাজনক হয়৷ ফ্রাউনহোফার ইনস্টিটিউটের আন্দ্রেয়াস হরনুং বলেন, ‘‘আলাদা করে উৎপাদন করতে হয় – এমন কোনো বায়োজেনিক উপকরণ ব্যবহার করা চলে না৷ আমরা ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বা বায়োগ্যাস প্লান্ট থেকে পাওয়া বর্জ্য কাজে লাগাই৷ গরুর গোবর ও শুয়রের মলও ব্যবহার করা হয়৷ তাতে খড়কুটার মতো কৃষিজাত বর্জ্য মেশানো থাকলেও কোনো সমস্যা নেই৷''
প্লাস্টিকের ব্যাগ কি শুধুই ব্যাগ?
বাজার করার জন্য একবার ব্যবহার করা যায়, এমন প্লাস্টিকের ব্যাগ হামেশাই দেখা যায় যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর৷ ‘ওয়ান-টাইম’ প্লাস্টিক ব্যাগের জায়গায় সুতি, চট বা কাগজের ব্যাগও হতে পারে৷ ছবিঘরে কিছু ব্যাগের নমুনা দেখুন!
ছবি: DUH
সব সময় শুধু প্লাস্টিক নয়
সুপারমার্কেটগুলিতে ফল বা সবজি কেনার সময়, এই যেমন ধরুন কলা, আপেল বা গাজর কেনার সময়, হাতের কাছেই রাখা থাকে প্লাস্টিকের ব্যাগ৷ সেই ব্যাগে পছন্দের ফল বা সবজিগুলি ভরে ওজন করে নিয়ে যেতে হয় কাউন্টারে৷ এভাবেই মাথা পিছু বছরে প্রায় ৭১টি প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করেন জার্মানরা৷
ছবি: Fotolia/pizzicati
দূরে থাকুন
সাধারণ প্লাস্টিকের ব্যাগগুলির শতকরা ১০০ ভাগই কৃত্রিম পলিথিনের, যা জীবাশ্মের অপরিশোধিত তেল থেকে তৈরি৷ এই ব্যাগগুলো মোটেই পরিবেশবান্ধব নয় এবং এগুলো পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেতে অন্তত ৪০০ থেকে ৫০০ বছর সময় লাগে৷ এ কারণেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিবেশ বিষয়ক কমিশন প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানায়৷
ছবি: picture alliance/ZB
‘অর্গানিক’ যে সব সময় ভালো, তা নয়
জৈবিক উপায়ে ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়, এমন প্লাস্টিক ব্যাগও পাওয়া যায় আজকাল৷ তবে সেই সব প্লাস্টিকের ব্যাগ সাধারণত শতকরা ৭০ ভাগ অপরিশোধিত তেল এবং ৩০ ভাগ নবায়ণযোগ্য কাঁচামাল থেকে তৈরি৷ শুনতে ভালো লাগলেও, এ ধরণের প্লাস্টিকের ব্যাগ ‘রিসাইক্লিং’ করার ক্ষেত্রেও কিন্তু সীমাবদ্ধতা আছে৷
ছবি: picture-alliance/ZB
রিসাইক্লিং-এর ভাগ বেশি থাকাও যথেষ্ট নয়
একবার ব্যবহার করা যায়, এমন প্লাস্টিকের ব্যাগে রয়েছে শতকরা ৭০ ভাগ রিসাইক্লিং পলিথিন৷ এগুলি সাধারণ প্লাস্টিক ব্যাগের তুলনায় কিছুটা যে পরিবেশবান্ধব – তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ কিন্তু জার্মানিতে বেশিরভাগ প্লাস্টিক ব্যাগই আবর্জনায় ফেলে দেওয়া হয়, তাই উপায় থাকলেও রিসাইক্লিং করা হয় না বা যায় না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ভালোর চেয়ে মন্দই বেশি
অন্যদিকে কাগজের ব্যাগ যে সব সময়ই পরিবেশবান্ধব, অর্থাৎ কৃত্রিম ব্যাগের তুলনায় ভালো – তাও কিন্তু নয়৷ কারণ, এ সব ব্যাগ তৈরিতে অনেক বেশি সময় এবং ব্লিচিং করার জন্য শক্তিশালী রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়, যা পরবর্তীতে আবারো রাসায়নিক উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করতে হয়৷ এতে কিছুটা হলেও দূষণ ঘটে৷
ছবি: PA/dpa
কাপড়ের ব্যাগের অন্য দিক
কাপড়ের ব্যাগ যদি সুতির হয়, তাহলে সেগুলি বেশ মজবুত হয় এবং পরিবেশ রক্ষাতেও ভূমিকা রাখে৷ কিন্তু এ ধরণের ব্যাগ তৈরির জন্য একদিকে যেমন বেশি মাত্রায় কাঁচামাল প্রয়োজন হয়, তেমনই প্রয়োজন হয় বেশি পরিমাণে জ্বালানি৷ বলা বাহুল্য, এর একটা প্রভাবও পড়ে পরিবেশের ওপর৷
ছবি: Fotolia/Robert Kneschke
আছে মজবুত প্লাস্টিকের ব্যাগও
কাপড়ের ব্যাগের তুলনায় কৃত্রিম বা পলিয়েস্টারের ব্যাগ কিন্তু কম মজবুত নয়৷ ‘ওয়ান টাইম ইউজ’ বা ‘ইউজ অ্যান্ড থ্রো’ – এমন ব্যাগ ছাড়াও বাজারে কয়েকবার ব্যবহারযোগ্য কৃত্রিম প্লাস্টিকের ব্যাগও পাওয়া যায়৷ এই যেমন ছবির ব্যাগটি৷ তবে এগুলো কতটা পরিবেশবান্ধব – সেটা বলা কঠিন৷
ছবি: DUH
বিজয়ী হচ্ছে...
তাই সত্যিকার অর্থে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ হচ্ছে পলিয়েস্টারের তৈরি এই হাল্কা ব্যাগগুলি৷ এগুলির ওজন মাত্র ৩০ গ্রাম এবং ভাঁজ করলে এগুলো একেবারে হাতের মুঠোয় রাখা সম্ভব৷ এই ব্যাগ দেখতে ছোট এবং ওজনে কম হলেও প্রায় ১০ কেজি ওজনের জিনিস বহন করতে পারে৷
ছবি: DUH
8 ছবি1 | 8
এই প্লান্ট প্রায় সব কিছুই গিলে ফেলে৷ এই সব অবশিষ্ট উপকরণ দিয়ে ই্ঞ্জিনে ব্যবহারের যোগ্য তেল, গ্যাস ও উচ্চ মানের বায়োচার তৈরি করা যায়, যা বিক্রি বা বণ্টন করা সম্ভব৷ হরনুং বলেন, ‘‘এই তেল ইঞ্জিন চালাতেও ব্যবহার করা যায়৷ গ্যাস দিয়ে পরিশোধন প্লান্ট চালানো যায়৷ হাইড্রোজেন বার করে রাসায়নিক শিল্পে কাজে লাগানো যায়৷ বায়োচারও জ্বালানো যায়, গুদামে রাখা যায়৷ কৃষিকাজেও এই সব উপকরণ কাজে লাগানো যায়৷''
অরগ্যানিক আবর্জনা পাইপের মাধ্যমে এক চুল্লিতে চলে যায়৷ অক্সিজেন-বিহীন পরিবেশে ৫০০ ডিক্রি সিলসিয়াস তাপমাত্রার বেশি উত্তাপে তা বাষ্প ও বায়োচারে রূপান্তরিত করা হয়৷ তার পরের ধাপে সেই বাষ্প ও বায়োচার আরও ‘এনরিচ' করা হয়৷ তারপর বাষ্প ঠান্ডা করা হয়৷ তখন অরগ্যানিক তেল ও গ্যাস তৈরি হয়৷
বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ভেরেন্ডা
সারা বিশ্বে যে তেলের মজুদ আছে আগামী একশো বছরের মধ্যে তা শেষ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের৷ তাই বিকল্প জ্বালানির সন্ধান চলছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
জাট্রোফা বা ভেরেন্ডা
ইংরেজি নাম জাট্রোফা৷ এর কয়েকটি প্রজাতি রয়েছে৷ এর মধ্যে ‘জাট্রোফা কারকাস’ বাংলাদেশে ভেরেন্ডা নামে পরিচিত৷ তবে কেউ কেউ ‘সাদা মান্দার’ও বলেন৷ ভেরেন্ডার বীজ থেকে অনেকেই তেল বের করে সেটা কাজে লাগান৷ কাজটা একটু বড় পরিসরে করলে বাংলাদেশ অনেক বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে পারবে৷
ছবি: Live Energies GmbH/George Francis
৩৭ লক্ষ টন তেল আমদানি
প্রতি বছর বাংলাদেশ প্রায় ৩৭ লাখ টন (পরিশোধিত ও অপরিশোধিত) জ্বালানি তেল আমদানি করে থাকে৷ এর প্রায় ২৪ লাখ টনই ডিজেল, যার মোট আমদানি মূল্য ১৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি৷ সরকার বেশি দামে ডিজেল কিনে কম মূল্যে জনগণকে সরবরাহ করে৷ ফলে প্রতিবছর হাজার কোটি টাকারও বেশি লোকসান গুনতে হয় সরকারকে৷ তাই বায়োডিজেল উৎপাদনে ভেরেন্ডাকে কাজে লাগালে সরকারের লোকসান কমবে৷
ছবি: AFP/Getty Images
প্রতি হেক্টরে ৩-৪ হাজার লিটার
হিসেবে দেখা গেছে, এক হেক্টর জমিতে জন্মানো জাট্রোফা থেকে প্রতিবছর প্রায় ৩-৪ হাজার লিটার বায়োডিজেল উৎপাদন করা সম্ভব৷
ছবি: Live Energies GmbH/George Francis
সরকারি উদ্যোগ
ভেরেন্ডা বা জাট্রোফা থেকে বায়োডিজেল উৎপাদনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে জ্বালানি মন্ত্রণালয় ২০০৬ সালে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে৷ কমিটি ২০০৭ সালে তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদন দাখিল করলেও আজ পর্যন্ত এ ব্যাপারে সরকারি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি বলে জানা গেছে৷
ছবি: Live Energies GmbH/George Francis
সামাজিক বনায়ন
বাংলাদেশে অতি সহজেই বায়োডিজেল উৎপাদন সম্ভব৷ কারণ সরকারের ‘সামাজিক বনায়ন’ কর্মসূচির মাধ্যমে জাট্রোফা রোপণ ও পরিচর্যার ব্যবস্থা করা যেতে পারে৷ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখা যেতে পারে কারণ, বিকল্প জ্বালানির উৎসের সন্ধান পাওয়া না গেলে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ৷
ছবি: Live Energies GmbH/George Francis
বিকল্প জ্বালানির চাহিদা
সারা বিশ্বে যে তেলের মজুদ আছে তা আগামী একশো বছরের মধ্যেই শেষ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের৷ তাই অনেক দেশই বিকল্প জ্বালানির সন্ধানে নেমেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কয়েকটি দেশে শুরু হয়েছে
বিকল্প জ্বালানি হিসেবে অনেকদিন ধরেই বায়োডিজেলের নাম উচ্চারিত হয়ে আসছে৷ বিশেষ করে অনেক দেশেই এখন জাট্রোফা থেকে বায়োডিজেল উৎপাদন করা হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
7 ছবি1 | 7
অরগ্যানিক কয়লায় কার্বন ছাড়াও উদ্ভিদজাত পুষ্টি থাকে – যেমন ফসফেট, নাইট্রোজেন ও ক্যালসিয়াম৷ ফলে তা সার হিসেবে খুবই ভালো৷ কিন্তু শুধু সে কারণেই এটি কৃষিকাজের উপযুক্ত নয়৷ হরনুং বলেন, ‘‘এগুলি জমির মানের উন্নতির জন্যও ব্যবহার করা যায়৷ ভারতে প্রথম পরীক্ষায় পেঁয়াজ ও ক্যাপসিকামের ফলন অনেক বেড়ে গেছে৷ তবে এমন সব দেশে বেশি পরিমাণ উৎপাদন বড় বিষয় নয়৷ আরও কম পরিমাণ জল ব্যবহার করে একই ফলন আরও বেশি জরুরি৷''
অরগ্যানিক জ্বালানি প্রযুক্তি এমন সব দেশের জন্য উপযুক্ত, যেখানে পরিবেশের ক্ষতি না করে বেড়ে চলা জ্বালানির চাহিদা মেটানো সম্ভব৷ বিঘ্ন ঘটলেও প্লান্টের মধ্যে থার্মাল রূপান্তর প্রক্রিয়ার ক্ষতি হয় না৷ এ সব দেশে অরগ্যানিক বর্জ্যেরও অভাব নেই৷ হরনুং বলেন, ‘‘শুধু উত্তর ভারতেই দু'টি ফলনের মধ্যে যে ঘাটতি হয়, তার সমান পরিমাণ খড় জার্মানিতে পাওয়া যায়৷ ভারত, ব্রাজিল ও আফ্রিকায় আমরা এই প্রযুক্তির বিপুল সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি৷ ১০ থেকে ৩০টি বাড়ির জন্য ৩০ কিলোওয়াটের ছোট ইউনিট থেকে শুরু করে ছোটখাটো শহরের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে৷''
এই প্লান্টে তৈরি উচ্চ মানের তেল ও গ্যাস স্থানীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে এক জেনারেটারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও উত্তাপে রূপান্তরিত করা সম্ভব৷ এই প্রযুক্তি প্রয়োগ করলে অত্যন্ত কম জায়গায় জ্বালানি উৎপাদন করা সম্ভব৷
পরিবেশের ক্ষতি না করে নতুন এই প্রযুক্তি জ্বালানি উৎপাদন করে৷ বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকলে বা সৌর ও বায়ুশক্তির ঘাটতি পূরণ করতে এটি কাজে লাগানো যায়৷ শুধু অরগ্যানিক বর্জ্য থেকেই তা করা সম্ভব৷