জাতিগত বৈচিত্র্যকে উৎসাহিত করার বিভিন্ন উদ্যোগে ২০১৭ সালে ১০ কোটি ইউরোর বেশি ব্যয় করেছে জার্মান সরকার৷ তা সত্ত্বেও বর্ণ ও জাতি সংক্রান্ত অসহিষ্ণুতা এখনো উল্লেখযোগ্য সমস্যা৷
বিজ্ঞাপন
আখেনের সমাজকর্মী ইজাবেল টেলার পেশায় আইনজীবী৷ তিনি যে উদ্বাস্তু কল্যাণ উদ্যোগটির হয়ে কাজ করেন, তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৩ সালে৷ ফেডারাল ও রাজ্য সরকারের অর্থানুকুল্যে এই উদ্যোগ চলে এবং এদের একটি মূল কাজ হলো, যুদ্ধ ও পলায়নের বিভীষণ অভিজ্ঞতার ফলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত উদ্বাস্তুদের থেরাপির ব্যবস্থা করা৷ বর্তমানে একটি থেরাপির জন্য উদ্বাস্তুদের ছয় মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে বলে ইজাবেল জানালেন৷
তিনি যে প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করেন, তারা সাধারণভাবে উদ্বাস্তুদের সাহায্য করার চেষ্টা করে৷ এক্ষেত্রে ইজাবেলকে প্রায়ই সরকারি কর্মকর্তাদের মুখোমুখি হতে হয়: বিশেষ করে জার্মানিতে যেসব উদ্বাস্তু শিশুর জন্ম হয়, তাদের নথিভুক্ত করা ও কাগজপত্র করা নিয়ে দৃশ্যত আমলারা ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি করেন৷
দক্ষিণপন্থি প্রবণতা
বর্ণবাদ সংক্রান্ত বিভিন্ন সেমিনার ও আলোচনাচক্রে ইজাবেল টেলারের ডাক আসে৷ এক্ষেত্রে তিনি জার্মান সমাজ যে দক্ষিণপন্থি মনোভাবের দিকে ঝুঁকছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর মতো সমাজকর্মী ও উদ্যোগ ছাড়া সমাজ ও সরকারের তরফেও এক ধরণের অসহায়তা লক্ষণ করেছেন৷
শরণার্থী সংকটের কিছু আইকনিক ছবি
ইউরোপে ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে বিপুল সংখ্যক অভিবাসী প্রবেশের ছবি গোটা বিশ্বে ছড়িয়েছে এবং মানুষের মতামত সৃষ্টিতে প্রভাব বিস্তার করেছে৷ অভিবাসন এবং অভিবাসনের ফলে সৃষ্ট ভোগান্তির এত ছবি আগে দেখেনি বিশ্ব৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/E. Morenatti
লক্ষ্য: টিকে থাকা
অনিশ্চিত যাত্রার ধকল সামলাতে হয় শারীরিক এবং মানসিকভাবে৷ ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচতে হাজার হাজার সিরীয় নাগরিক তুরস্ক হয়ে গ্রিসে জড়ো হয়েছেন৷ সে দেশের তিনটি দ্বীপে এখনো দশ হাজারের মতো শরণার্থী বসবাস করছেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস অবধি ছয় হাজার নতুন শরণার্থী এসেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Messinis
পায়ে হেঁটে ইউরোপে
২০১৫ এবং ২০১৬ সালে এক মিলিয়নের বেশি মানুষ গ্রিস ও তুরস্ক থেকে পশ্চিম ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেছে৷ ম্যাসিডোনিয়া, সার্বিয়া, হাঙ্গেরি, অর্থাৎ বলকান রুট ব্যবহার করে তাদের এই যাত্রার অধিকাংশই ছিল পায়ে হেঁটে৷ অভিবাসীদের এই যাত্রা বন্ধ হয়ে যায়, যখন রুটটি আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয় এবং কয়েকটি দেশ সীমান্তে বেড়া দিয়ে দেয়৷
ছবি: Getty Images/J. Mitchell
বৈশ্বিক আতঙ্ক
এই ছবিটি গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ তিন বছর বয়সি সিরীয় শিশু আয়লান কুর্দির মরদেহ তুরস্কে সমুদ্রতটে ভেসে ওঠে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে৷ ছবিটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে এবং শরণার্থী সংকটের প্রতীকে পরিণত হয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/DHA
বিশৃঙ্খলা এবং হতাশা
শেষ সময়ের ভিড়৷ ইউরোপে প্রবেশের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শুনে ক্রোয়েশিয়াতে এভাবে ট্রেনে এবং বাসে উঠতে দেখা যায় অসংখ্য শরণার্থীকে৷ ২০১৫ সালের অক্টোবরে হাঙ্গেরি সীমান্ত বন্ধ করে দেয় এবং শরণার্থীদের জন্য কন্টেইনার ক্যাম্প তৈরি করে৷
ছবি: Getty Images/J. J. Mitchell
বিবেকবর্জিত সাংবাদিকতা
হাঙ্গেরির এক সাংবাদিক এক শরণার্থীকে ল্যাং মেরে ফেলে দেয়ার ভিডিও নিয়ে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে সমালোচনার ঝড় ওঠে৷ সার্বিয়ার সীমান্ত সংলগ্ন হাঙ্গেরির একটি এলাকার সেই ঘটনায় আলোচিত সাংবাদিকের চাকুরি চলে যায়৷
ছবি: Reuters/M. Djurica
উন্মুক্ত সীমান্ত নয়
২০১৬ সালের মার্চে বলকান রুট আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দেয়ার পর সীমান্তগুলোতে আরো আবেগপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়৷ হাজার হাজার শরণার্থী বিভিন্ন সীমান্তে আটকা পড়ে এবং তাদের সঙ্গে বর্বর আচরণের খবর পাওয়া যায় বিভিন্ন স্থান থেকে৷ অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করে৷
ধুলা এবং রক্তে ঢাকা এক শিশু৷ পাঁচবছর বয়সি ওমরানের এই ছবিটি প্রকাশ হয় ২০১৬ সালে৷ আয়লান কুর্দির ছবির মতো এই ছবিটিও গোটা বিশ্বকে আরেকবার নাড়িয়ে দেয়৷ সিরীয়ায় গৃহযুদ্ধ কতটা বিভৎস পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে এবং সিরীয়রা কতটা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে, তার এক প্রতীক হয়ে ওঠে ছবিটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Aleppo Media Center
অজানা নতুন ঠিকানা
গ্রিক-ম্যাসিডোনিয়া সীমান্তের ইডোমিনিতে নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় হাঁটছেন এক সিরীয় নাগরিক৷ ইউরোপে তাঁর পরিবার নিরাপদ থাকবে, এমনটাই প্রত্যাশা ছিল তাঁর৷ ডাবলিন রেগুলেশন অনুযায়ী, একজন শরণার্থী প্রথম ইউরোপের যে দেশে প্রবেশ করেন, সে দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করতে হবে৷ ফলে যারা আরো ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন, তাদের অনেককে ফেরত পাঠানো হয়েছে৷
ছবি: Reuters/Y. Behrakis
সহযোগিতার আশা
বিপুল সংখ্যক শরণার্থী প্রবেশের কারণে জার্মানি অভিবাসন নীতি আরো কড়া করে ফেললেও এখনো শরণার্থীদের প্রথম পছন্দ জার্মানি৷ ইউরোপের আর কোনো দেশ জার্মানির মতো এত বিপুল সংখ্যক শরণার্থী নেয়নি৷ ২০১৫ সালে সঙ্কট শুরুর পর থেকে দেশটি ১২ লক্ষ শরণার্থী নিয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Hoppe
ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরা
ইউরোপে শরণার্থী প্রবেশের সংখ্যা চলতি বছর কমেছে, তবে থেমে যায়নি৷ বরং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ডুবে মরছে অনেকে৷ বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা এবং সরকারের হিসেব অনুযায়ী, চলতি বছর এখন অবধি সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে মারা গেছে প্রায় দু’হাজার মানুষ৷ গতবছর এই সংখ্যা ছিল ৫ হাজার৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/E. Morenatti
10 ছবি1 | 10
টেলারের মতে, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও রাজনীতিকদের নিজেদের মনোভাব বদলানো উচিত৷ দৃশ্যত টেলার ও তাঁর সতীর্থরা প্রায়ই অভিবাসী পটভূমির পুলিশকর্মীদের কাছ থেকে কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক ব্যবহারের কাহিনি শোনেন – যেমন ওপরওয়ালা, তেমন সহকর্মীদের তরফ থেকে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হন বিদেশি-বহিরাগত বংশোদ্ভূত পুলিশকর্মীরা৷
সাংবাদিক আন্দ্রেয়া রোয়েপকে বহু বছর ধরে জার্মানিতে বর্ণবাদ প্রণোদিত দক্ষিণপন্থি সহিংসতা নিয়ে লিখছেন৷ তাঁর মতে, জার্মানিতে দক্ষিণপন্থি হওয়াটা আবার ফ্যাশনেবল হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ কাজেই বর্ণবাদ বিরোধী উদ্যোগগুলি আগের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে বলে রোয়েপকে মনে করেন৷ এই উদ্যোগগুলিই বস্তুত জার্মান সমাজের আসল মনোভাবকে তুলে ধরছে বলে তাঁর ধারণা৷
মুশকিল এই যে, বর্ণবাদী স্লোগানগুলি ছড়ায় প্রধানত অনলাইনে৷ অনলাইনে জার্মানির সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হলো উদ্বাস্তু বিরোধী এএফডি দল৷ অনলাইনে তাদের ফলোয়ারের সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি৷ অনলাইন প্রচারণার ক্ষেত্রে এএফডি যে কতটা পেশাদার, সে ব্যাপারে জনসাধারণের আজ পর্যন্ত কোনো পর্যাপ্ত ধারণা নেই বলে রোয়েপকের আক্ষেপ৷ দক্ষিণপন্থি অপরাধের আইনগত বিচার প্রক্রিয়াতেও নানা সমস্যা আছে বলে তাঁর অভিমত৷
দক্ষিণপন্থি মতাদর্শ বলতে কী বোঝায়?
‘এক্সিট’ নামের একটি উদ্যোগ ২০০০ সাল থেকে নব্য নাৎসিদের দল থেকে বেরিয়ে আসায় সাহায্য করে আসছে৷ ফেডারাল পরিবার মন্ত্রণালয় উদ্যোগটির অর্থসংস্থান করে থাকে৷ ফেলিক্স বেনেকেনস্টাইন ১০ বছর নব্য নাৎসি থাকার পর এখন ‘এক্সিট’-এর কর্মী৷ ৩১ বছর বয়সি বেনেকেনস্টাইনের কর্মক্ষেত্র বাভেরিয়া৷ সেখানে যে প্রশ্নটি তাঁকে প্রায়ই শুনতে হয়, সেটি হলো: ‘‘জার্মানিতে বড় বেশি উদ্বাস্তু এসেছে বললেই কি আমি বর্ণবাদী হয়ে গেলাম?’’
বেনেকেনস্টাইনের মতে বামঘেঁষা মনোভাবের কাউন্সেলররা কারো দক্ষিণঘেঁষা মনোভাব দেখলেই তার মুখ বন্ধ করে দেন৷ অপরদিকে উদ্বাস্তু সংক্রান্ত উদ্যোগগুলিতে রক্ষণশীল মনোভাবের আরো বেশি মানুষ থাকা প্রয়োজন, বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ থাকা আবশ্যক বলে তাঁর ধারণা৷