কিংবদন্তী পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের ভ্রমণ ডায়েরির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ হয়েছে৷ ডায়েরিতে বিভিন্ন দেশের মানুষ, বিশেষ করে চীনাদের সম্পর্কে তাঁর মনোভাবকে অনেকেই তীব্র বর্ণবাদী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন৷
বিজ্ঞাপন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনে থাকার সময় আফ্রিকান-অ্যামেরিকানদের বিষয়ে শ্বেতাঙ্গদের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন আইনস্টাইন৷ এমন আচরণকে ‘ সাদা মানুষদের রোগ’ হিসেবেও বর্ণনা করেছিলেন তিনি৷
তবে এবার হয়তো তাঁর সম্পূর্ণ বিপরীত দিকটাও সবার সামনে উঠে আসতে যাচ্ছে৷ সম্প্রতি ইংরেজিতে অনূদিত ট্রাভেল ডায়েরিজ অব আলবার্ট আইনস্টাইন: দ্য ফার ইস্ট, প্যালেস্টাইন অ্যান্ড স্পেন, ১৯২২-১৯২৩ বইটিতে পাওয়া যাচ্ছে এমন ধারণা৷
আইনস্টাইনের এই ব্যক্তিগত ডায়েরিতে উনিশ শতকের বিশের দশকে এশিয়া সফরের সময় তাঁর বর্ণবাদী মনোভাব ফুটে উঠেছে বলে মন্তব্য করেছে ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান৷ জার্মান ভাষায় লেখা এই ডায়েরি অনুবাদ করে প্রকাশ করেছে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস৷
ডায়েরির এক জায়গায় মিশরের পোর্ট সাঈদে নেমে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মানুষের সাথে সাক্ষাতের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন তিনি৷ বলেছেন, ‘‘মনে হচ্ছে, এদের সরাসরি নরক থেকে পাঠানো হয়েছে৷’’
‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ এর অজানা কিছু কথা
১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট দিনটি অ্যামেরিকার ইতিহাসে অমর হয়ে আছে৷ সেদিন ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ খ্যাত একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, যিনি অ্যামেরিকায় আফ্রিকান-অ্যামেরিকান নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা৷
ছবি: AP
লক্ষ্য বর্ণবাদের অবসান
এই সেই বিখ্যাত ছবি৷ ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটনের লিংকন মেমোরিয়ালে প্রায় আড়াই লক্ষ সমর্থকের উদ্দেশ্যে ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ খ্যাত ভাষণ দিয়েছিলেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র৷ যুক্তরাষ্ট্র থেকে বর্ণবাদ দূর করাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নাগরিক অধিকার আন্দোলন
বর্ণবাদ অবসানের লক্ষ্যে ‘সিভিল রাইটস মুভমেন্ট’ বা নাগরিক অধিকার আন্দোলন শুরু করেছিলেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র৷ তারই অংশ হিসেবে ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট আয়োজিত ‘মার্চ অন ওয়াশিংটন’ কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন তিনি৷ ছবিতে সামনের সারিতে বাম থেকে দ্বিতীয়তে দেখা যাচ্ছে তাঁকে৷
ছবি: Hulton Archive/Getty Images
যেভাবে আন্দোলনের শুরু
ছবির এই নারীর নাম রোজা পার্কস৷ বাস চালকের নির্দেশের পরও বাসের পেছনে বসতে অস্বীকৃতি জানানোয় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল৷ তার প্রতিবাদেই শুরু হয়েছিল নাগরিক অধিকার আন্দোলন - যাঁর অন্যতম নেতা ছিলেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র৷ মার্কিন কংগ্রেস পরবর্তীতে রোজা পার্কসকে ‘দ্য ফার্স্ট মিনিস্টার অফ সিভিল রাইটস’ উপাধি দিয়েছিল৷
ছবি: AP
বাস বয়কটের দায়ে অভিযুক্ত
রোজা পার্কসের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে বাস বয়কট আন্দোলন শুরু করেছিলেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র৷ ১৯৫৬ সালের ২২ মার্চ তোলা ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে মার্টিন লুথার কিংকে স্বাগত জানাচ্ছেন তাঁর স্ত্রী কোরেটা স্কট কিং৷ এটা আদালত ছাড়ার সময়কার ছবি৷ মন্টগোমারি শহরের বাসে চালু থাকা নিয়ম ভঙ্গের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছিল লুথার কিং এর বিরুদ্ধে৷ তবে তাঁর আপিলের পর বিচারক ৫০০ ডলারের জরিমানা মওকুফ করে দিয়েছিলেন৷
ছবি: AP
কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য ভোটাধিকার
১৯৬৫ সালের ৩০ মার্চের এই ছবিতে কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য ভোটাধিকারের দাবিতে ঘোষিত কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে মার্টিন লুথার কিং ও তাঁর স্ত্রী সহ অন্যান্যদের৷
ছবি: William Lovelace/Express/Getty Images
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা
কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য ভোটাধিকারের দাবি নিয়ে ১৯৬৫ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসনের সঙ্গে আলোচনা করতে দেখা যাচ্ছে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে৷
ছবি: Hulton Archive/Getty Images
জন্ম
১৯২৯ সালের ১৫ই জানুয়ারি জর্জিয়ার অ্যাটলান্টায় জন্মগ্রহণ করেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র৷ ১৯৫৫ সালে বস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেন ডক্টর অব ফিলোসোফি ডিগ্রি৷ নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় অহিংস আন্দোলনের জন্য ১৯৬৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি৷ তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৫৷ নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ীদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ৷ ছবিটি ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ ভাষণের৷
ছবি: picture-alliance/akg
জার্মান মার্টিন লুথার
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এর নাম কিন্তু শুরুতে ছিল মাইকেল কিং৷ পরবর্তীতে তাঁর বাবা ষোড়শ শতকে যে জার্মান ক্যাথলিক যাজক প্রোটেস্টান্ট গির্জা প্রতিষ্ঠা করেন, সেই মার্টিন লুথারের নামে তাঁর ছেলে ও নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন মার্টিন লুথার কিং৷
ছবি: Hulton Archive/Getty Images
মৃত্যু
১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল এক আততায়ীর গুলিতে নিহত হন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র৷ তাঁকে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল জেমস আর্ল রে’কে (ছবিতে যাকে দেখা যাচ্ছে)৷ ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত রে একবার জেল থেকে পালিয়ে যাবার পর এফবিআই তাঁকে ধরতে এই পোস্টারটি ছাপিয়েছিল৷ তিনটি ছবিই রে’র৷
ছবি: picture-alliance/Everett Collection
9 ছবি1 | 9
কলম্বোতে অবস্থানের বর্ণনাও দিয়েছেন তিনি৷ বলেছেন, ‘‘এরা প্রচণ্ড নোংরাভাবে বসবাস করে, কাজ করে না বললেই চলে, চাহিদাও একেবারেই কম৷’’
অন্যান্য অনেক কিছুর মধ্যে হংকং ও সাংহাইয়ে প্রতিদিনকার জীবন সম্পর্কে খুঁটিনাটি লিখেছেন এই পদার্থবিদ৷ শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট-দুঃখ-বেদনার চিত্রও উঠে এসেছে তাঁর লেখনীতে৷ তবে পরিশ্রমী হিসেবে প্রশংসা করলেও এক জায়গায় চীনাদের ‘নোংরা ও স্বল্পবুদ্ধির’ জাতি হিসেবে বর্ণনা করেছেন আইনস্টাইন৷
গার্ডিয়ান বলছে, ভিন্ন সংস্কৃতির সম্মিলনে কী ধরনের জটিলতা তৈরি হতে পারে, সে সম্পর্কে আইনস্টাইনের ধারণা ছিল ঠিকই, কিন্তু তারপরও চীনের মানুষদের দেখতে গিয়ে তিনি তাঁর ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গীর বাইরে যেতে পারেননি৷
চীনের পুরুষ ও নারীর মধ্যে পার্থক্য খুবই অল্প বলে নিজের ধারণা প্রকাশ করেছেন তিনি৷ ডায়েরির এক জায়গায় তিনি বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন, ‘‘আমি জানি না, চীনের নারীদের মধ্যে কী এমন আছে, যা পুরুষদের এমনভাবে আকর্ষণ করে যে, তারা সন্তান উৎপাদন থেকে বিরত থাকতে পারে না৷’’
হংকং ভ্রমণের সময় এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘‘চীনারা অন্যান্য জাতির চেয়ে ওপরে উঠে গেলে সেটা খুব দুঃখের বিষয় হবে৷ এমন চিন্তা করলেও আমার দারুণ ভয় হচ্ছে৷’’
ডায়েরি প্রকাশের সাথে জড়িত সেফ রোসেনক্রান্স এই অংশটি নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন৷ তাঁর মতে, ‘‘আইনস্টাইন অন্য একটি জাতিকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতেন, যা বর্ণবাদী আচরণেরই বহিঃপ্রকাশ৷’’
প্রতিক্রিয়া
চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে গার্ডিয়ানের এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে৷ তবে এতে চীনা কর্তৃপক্ষের কোনো মন্তব্য দেয়া হয়নি৷ রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো বক্তব্য না এলেও, পাঠকেরা এ নিয়ে নিজেদের অসন্তোষের কথা ঠিকই জানিয়েছেন৷
একজন মন্তব্য করেছেন, ‘‘একজন বিজ্ঞানী হিসেবে আইনস্টাইন বিখ্যাত ছিলেন৷ কিন্তু অন্যদের প্রতি সম্মান না দেখিয়ে মানুষ হিসেবে তিনি নিজের যোগ্যতা হারিয়েছেন৷’’
এই মন্তব্যকারীকে সমর্থন জানিয়ে আরেকজন লিখেছেন, ‘‘আইনস্টাইনের বক্তব্য প্রচণ্ড বর্ণবাদী৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে হলে তিনি অবশ্যই এমন কিছু লিখতেন না৷ এ কারণেই সম্ভবত আইনস্টাইন ডায়েরি প্রকাশে অনীহা দেখিয়েছিলেন৷’’