বর্ণবাদ জার্মানির একটি রীতি, ব্যতিক্রম নয়
২১ মার্চ ২০২৫
দেশটির রাজধানী বার্লিনে নার্সারি পর্যায়ের স্কুল শিক্ষিকা হিসাবে কাজ করছেন ফাতমা৷ তিনি বলেন, সকালে কাজে যাওয়ার সময়ই এটি (বর্ণবৈষম্য) শুরু হয়৷
স্টাইলিশ পোশাক পরেন ফাতমা৷ আর মাথায় থাকে স্কার্ফ৷ তিনি বলেন, ‘‘অন্যান্য চালকেরা কেমন করে যেন আমার দিকে তাকান৷''
ফাতমা বলেন, ‘‘নার্সারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচির এক প্রশিক্ষক একবার আমাকে বলেছিলেন, তিনি মনে করেন মাথায় থাকা স্কার্ফ অস্বাস্থ্যকর৷''
ফাতমা বলেন, তিনি তার প্রশিক্ষণ কোর্সে ‘খুব ভালো' গ্রেড নিয়ে স্নাতক পাস করেছেন৷ তারপরও চাকরি পাওয়াটা সহজ ছিল না, এখনও বিষয়টি সহজ হয়নি৷ বাস্তবতা হলো, বার্লিন এবং জার্মানির অন্য শহরগুলোর নার্সারি পর্যায়ের স্কুলগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে শিক্ষক প্রয়োজন৷ কিন্তু ফাতমা মনে করেন, মাথার স্কার্ফ তার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে৷
তিনি বলেন, ‘‘এতে আমি সত্যিই বিরক্ত হই৷''
হানাও বার্লিনে থাকেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় যেতে সাহস করি না৷''
যখনই তিনি নিজ সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে সাবওয়েতে যান, তাকে ‘বাজে মন্তব্য' শুনতে হয়৷ কারণ, তার বাচ্চারাও কৃষ্ণ বর্ণের এবং তার নিজের মাথার চুলও কালো৷
হানা বলেন, ‘‘মানুষজন বলেন, আমার নিজ দেশে ফিরে যাওয়া উচিত৷''
বর্ণবাদ বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়
জার্মান সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেশন অ্যান্ড মাইগ্রেশন রিসার্চ প্রকাশিত রেসিজম মনিটর শীর্ষক গবেষণাটির সহ-লেখক ছিলেন আইলিন মেঙ্গি৷ তিনি বলেছেন, ‘‘বৈষম্যের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়৷''
জার্মানিতে বর্ণবাদ এবং বৈষম্য নিয়ে করা সবচেয়ে বিস্তৃত জরিপের একটি এটি৷ এর গবেষকেরা জার্মানজুড়ে অন্তত ১০ হাজার মানুষের উপর জরিপ করেছেন৷
২০২৫ সালের মার্চে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, যাদের দেখে মনে হয় যে তারা অভিবাসী ও মুসলমান, তারাই জার্মানিতে বর্ণবাদ ও বৈষম্যের সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছেন৷ কিন্তু তারা অভিবাসী হোক বা না হোক, বর্ণবাদের শিকার হচ্ছেন৷ কেউ কেউ এসবের শিকার হচ্ছেন ফাতমার মতো মাথায় স্কার্ফ পরেন বলে, আবার কেউ কেউ শিকার হচ্ছেন গায়ের রঙের কারণে৷ আবার কেউ কেউ বর্ণবাদ ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন হানার মতো চুলের রঙ কালো হওয়ার কারণে৷
এসব বৈশিষ্ট্যধারী অর্ধেকেরও বেশি মানুষ মাসে অন্তত একবার বৈষম্যের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন৷
‘বর্ণবাদ আরো সূক্ষ্ম হয়ে উঠছে'
মুসলিম নারী এবং কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছেন৷ প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ৬০ শতাংশেরও বেশি মানুষ নিয়মিতভাবে তাদের নিত্যদিনের জীবনে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন৷
রেসিজম মনিটরের প্রধান জিহান সিনানোলো ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, জার্মান সমাজে বৈষম্যের অভিজ্ঞতা অসমভাবে ছড়িয়ে রয়েছে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা আরো দেখতে পাচ্ছি, জার্মানিতে বর্ণবাদ আরো সূক্ষ্ম হয়ে উঠছে এবং সামাজিক রীতিনীতিতে এটি ঢুকে যাচ্ছে৷''
জিহান সিনানোলো গবেষণার ফলাফলের সারসংক্ষেপ করে বলেছেন, মূলধারার সমাজে একটি প্রচলিত বিশ্বাস রয়েছে যে জাতিগত এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা অনেক বেশি রাজনৈতিক অধিকার দাবি করছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এতে একটি বিষয় পরিষ্কার হয় যে, কিছু সামাজিক গোষ্ঠী এখনও রাজনৈতিক অধিকার বঞ্চিত হচ্ছেন৷''
জার্মানিতে বৈষম্যের শিকার মানুষেরা এমন একটি মূলধারার বিরুদ্ধে আছেন, যেখানে বর্ণবাদ দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে৷ রেসিজম মনিটরের প্রধান বলেন, ‘‘জার্মানির জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশেরও বেশি বর্ণবাদী মনোভাব পোষণ করেন৷''
বর্ণবাদের কারণে বাড়ছে মানসিক যন্ত্রণা
জিহান সিনানোলোর মতে, কুসংস্কার এবং (অভিবাসীদের) বর্জনের এই মানসিকতা দীর্ঘমেয়াদি ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি যত বেশি বৈষম্য এবং বর্ণবাদের মুখোমুখি হই, উদ্বেগ এবং হতাশা ততো বেশি বাড়তে থাকে৷ আর আমি যত বেশি বৈষম্যের মুখোমুখি হই, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি বিশ্বাসও আমার ততো কমতে থাকে৷''
জার্মানির রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই দেশটিতে থাকা বর্ণবাদকে একটি ছোটো সমস্যা হিসাবে দেখিয়ে বিষয়টি উপেক্ষা করতে চান৷ রাজনৈতিক দলগুলোর এমন আচরণের কড়া সমালোচনা করেছেন গবেষণাটির লেখকেরা৷
জার্মান সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেশন অ্যান্ড মাইগ্রেশন রিসার্চের প্রধান নাইকা ফরুটান বলেন, ‘‘জার্মানির প্রতি তিন পরিবারের একটিতে অভিবাসনের ইতিহাস রয়েছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘বৈষম্যমূলক অভিজ্ঞতাসমাজের একটি বড় অংশকে প্রভাবিত করে৷''
ফরুটান বিশ্বাস করেন, জার্মানিতে বর্ণবাদ নিয়ে আলোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক প্রায়ই আড়ালে পড়ে যায়, সেটি হলো, ‘‘জার্মানির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কিন্তু বর্ণবাদের বিরুদ্ধে৷ মানুষ শিখতে চায় এবং তারা বর্ণবাদ সম্পর্কে অবহিত হতে চায়৷''
গবেষণার এই ফলাফল রাজনীতিবিদদের জন্য একটি ‘স্পষ্ট দায়িত্ব' বলে মনে করেন বৈষম্যবিরোধী ফেডারেল কমিশনার ফেরডা আটামান৷ ডিডাব্লিউকে আটামান বলেন, ‘‘জার্মানিতে বৈষম্যবিরোধী কিছু দুর্বল আইন রয়েছে৷ আর গবেষণায় স্পষ্ট হয়েছে যে, মানুষকে আরো ভালোভাবে সুরক্ষিত করা দরকার৷''
আটামানের এই দাবির পুরোটাই হচ্ছে জার্মানির দায়িত্ব নিতে যাওয়া নতুন সরকারের কাছে৷ সাধারণ নির্বাচনে জয় পাওয়ার পর রক্ষণশীল সিডিইউ/সিএসইউ মধ্য-বামপন্থি এসপিডিকে নিয়ে জোট সরকার গঠন করতে যাচ্ছে৷ তারাই আগামী চার বছর জার্মানির নেতৃত্ব দেবেন৷
হান্স ফাইফার/টিএম