বাঙালির খাবার নিয়ে লড়াই ঐতিহ্য ও ফিউশনের। বর্ধমানের বিখ্যাত সীতাভোগ এবার প্রথম তৈরি হয়েছে নলেন গুড় দিয়ে। শতাব্দীপ্রাচীন এই মিষ্টান্নের রূপবদল নিয়ে নানা মুনির নানা মত।
বিজ্ঞাপন
বাংলার শস্য ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলা। এই জেলার সীতাসের প্রজাতির গোবিন্দভোগ চাল থেকে তৈরি সীতাভোগ মিষ্টির খ্যাতি বিশ্বজুড়েই। শতাব্দী পার করা এই মিষ্টির ইতিহাস বলে, ১৯০৪ সালে বড়লাট লর্ড কার্জন বর্ধমান এসেছিলেন। তৎকালীন বর্ধমানের জমিদার বিজয়চাঁদ মহতাবকে মহারাজা খেতাব দিতেই তাঁর আগমন। সেই বড়লাটকে স্বাগত জানাতে নতুন ধরনের মিষ্টির পরিকল্পনা করেন বিজয়চাঁদ। মিষ্টি ব্যবসায়ী ভৈরবচন্দ্র নাগ ইংরেজ বড়লাট লর্ড কার্জনের জন্য তৈরি করেছিলেন সীতাভোগ, মিহিদানা। সেই শুরু সীতাভোগের জয়যাত্রা। তার আগেই কলকাতার বুকে ভীমচন্দ্র নাগ তৈরি করে ফেলেছেন লেডিকেনি। লেডি ক্যানিংকে খুশি করতে যখন তৈরি হচ্ছে লেডিকেনি, তখন অনেক দেরি সীতাভোগের আবির্ভাবের। উৎসাহ জোগালেন কার্জন। তিনি সীতাভোগ খেয়ে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, সরকারি অনুষ্ঠানে এই মিষ্টির পরিবেশন বাধ্যতামূলক করেন। সেই শুরু সীতাভোগের জয়যাত্রার।
প্রদীপ ভকত
ঐতিহ্যের মিষ্টি এবার নতুন চেহারায় হাজির হয়েছে। ছানার তৈরি মিষ্টিতে শীতকালে নলের গুড়ের মিশ্রণ নতুন কিছু নয়। রসগোল্লা থেকে নানা ধরনের সন্দেশে এই গুড়ের ব্যবহার করা হয়। এই বছর বর্ধমানের একাধিক মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারী সীতাভোগে নলেন গুড়ের ব্যবহার করছেন। এই মিষ্টি তৈরি হয় যে সীতাসের চাল দিয়ে তার চাষ হয় বর্ধমানেই। এই চালের গুঁড়োর সঙ্গে নির্দিষ্ট অনুপাতে ছানা ও দুধ মেশানো হয়। সেই মিশ্রণ চালের আকৃতির ছিদ্রযুক্ত পাত্রের মধ্যে দিয়ে গরম চিনির রসে ফেলা হয়। এই শেষ ধাপটিতে একটু পরিবর্তন এনে ফিউশন সীতাভোগ তৈরি করা হচ্ছে।
বর্ধমানের রাধাবল্লভ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কর্ণধার প্রদীপ ভকত জানান, চিনির রসের বদলে মিশ্রণ ফেলা হচ্ছে নলেন গুড়ে। তাতে তৈরি হচ্ছে নয়া সীতাভোগ। সাদা নয়, এটা দেখতে একটু লালচে। মুখে দিলে পাওয়া যাচ্ছে গুড়ের স্বাদ। কেন সীতাভোগ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে হল? পশ্চিমবঙ্গ মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী সমিতির কার্যকরী সদস্য প্রদীপ বলেন, "মানুষ চিরকালই নতুন কিছু চায়। নলেন গুড় প্রাকৃতিক জিনিস, আমরা প্রত্যেকেই শীতকালে খেতে পছন্দ করি। তার সঙ্গে সীতাভোগের মিশেল মানু্ষ গ্রহণ করবে, আমাদের ব্যবসার পক্ষে ইতিবাচক হবে, এসব ভেবেই এই পরিবর্তন।"
দেবদত্ত
বর্ধমানের বাসিন্দারা সীতাভোগের নয়া অবতার নিয়ে দুই শিবিরে বিভক্ত। নতুন প্রজন্ম এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানাচ্ছে। প্রবীণ মানুষরা এর পক্ষপাতী নন। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রকাশনা আধিকারিক দেবদত্ত বলেন, ”গোড়ায় নতুন জিনিসের প্রতি আকর্ষণ থাকে। গুড়ের সীতাভোগ নিয়েও থাকবে। এটা একেবারেই সাময়িক। দীর্ঘস্থায়ী হবে না এই আকর্ষণ। এবারও হাতে গোনা কয়েকটি দোকান সীতাভোগ তৈরি করেছে। ধবধবে সাদা রং ছাড়া সীতাভোগ ভাবাই যায় না। এটা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়ার অনুষ্ঠানের মতো।" তিনি জানান, বর্ধমানে ভৈরবচন্দ্র নাগের হাত ধরে সীতাভোগের সৃষ্টি। সেই দোকান হাতবদল হয়েছে। সেখানেও কিন্তু গুড়ের ফিউশন নেই।
কলকাতা যাওয়ার পথে বর্ধমান স্টেশনে নেমে গণেশ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে গুড়ের সীতাভোগ কিনে খেয়েছেন মানস সরকার, বিপ্লব গুপ্তরা। দামেও বিশেষ পার্থক্য নেই। কেজিতে মাত্র ১০ টাকা বেশি। অনেক ক্রেতার বক্তব্য, গুড়ের স্বাদ অভিনব। শীতের সময় ভালোই লাগছে। তবে বছরভর সাদা, ঐতিহ্যবাহী সীতাভোগই চাই। এতে পরম্পরায় আঘাত লাগছে বলে মনে করেন না প্রদীপ ভকত। তাঁর বক্তব্য, "দুটিই পাশাপাশি থাকলে আপত্তি নেই। পাশ্চাত্যের ঝোঁক এসেছে, এটা মানতেই হবে। যে জিন্স পরে প্রতিদিনের কাজকর্মে স্বচ্ছন্দ বোধ করে, সে আবার কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে বা বিয়ের পিঁড়িতে বসার সময় বাঙালি পোশাক পরে। সুতরাং ঐতিহ্যের সঙ্গে নতুনের বিরোধ নেই।"
বাংলাদেশের মিষ্টি
মিষ্টির ঐতিহ্য বাংলাদেশে বহুকালের৷ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু ও ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্নের সমাহার৷ ছবিঘরে দেখুন তার কিছু নমুনা৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
পোড়াবাড়ির চমচম
টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমকে বলা হয় মিষ্টির রাজা৷ যমুনার শাখা নদী ধলেশ্বরীর তীরের গ্রাম পোড়াবাড়িতে প্রথম এই মিষ্টি তৈরি শুরু হয়৷ এখানকার নদীর পানি নাকি সেই মিষ্টির স্বাদে আলাদা একটা বিশেষত্ব যোগ করত৷ প্রায় দেড়শ বছর আগে ভারতের উত্তর প্রদেশের বালিয়া জেলার জনৈক রাজা রাম গোরার হাতে জন্ম হয় সুস্বাদু এই চমচমের৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
নাটোরের কাঁচাগোল্লা
এটি নাটোরের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন৷ ছানাকে চিনির ঘন সিরায় ডুবিয়ে বিশেষভাবে পাক দেয়ার পর ছেঁকে নেয়া এক ধরনের মিষ্টি হলো নাটোরের বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
নওগাঁর প্যারা সন্দেশ
নওগাঁর প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন প্যারা সন্দেশ৷ জনশ্রুতি আছে, বহুকাল আগে নওগাঁ শহরের কালিতলার মহেন্দ্রী দাস নামে এক ব্যক্তি প্রথমে প্যারা সন্দেশ তৈরি শুরু করেন৷ প্যারা সন্দেশ তৈরির সময় তরল দুধের সাথে চিনি মিশিয়ে তা ভালোভাবে জ্বাল করে ক্ষীর তৈরি করা হয়৷ ক্ষীর যখন জড়িয়ে আসতে শুরু করে তখন গরম ক্ষীর দু’হাতের তালুর মাঝে সামান্য চাপ দিতে হয়৷ এভাবেই তৈরি হয় প্যারা সন্দেশ৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
কুমিল্লার রসমালাই
কুমিল্লার রসমালাইয়ের যাত্রা মাতৃভাণ্ডার এর হাত ধরে৷ আদিতে এর নাম ছিল ক্ষীরভোগ৷ পাকিস্তান আমলে অবাঙালিরা এসে এ ক্ষীরভোগকে রসমালাই বলতে শুরু করে৷ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বেশ কিছু মাতৃভাণ্ডার থাকলেও আসল প্রাচীন মাতৃভাণ্ডারটি কুমিল্লা শহরের মনোহরপুরে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
জামতলার রসগোল্লা
যশোরের শার্শা উপজেলার জামতলার রসগোল্লার সুনাম দেশজোড়া৷ প্রায় ৫০ বছর আগে জামগাছের নীচে একটি চায়ের দোকানে জনৈক সাদেক আলী এই মিষ্টির জনক৷ জনশ্রুতি আছে, তাঁর কাছে কিছু সময়ের জন্য আশ্রয় নেয়া এক আগন্তুক তাঁকে এই মিষ্টি তৈরির পদ্ধতি শিখিয়েছিলেন৷ তবে বর্তমানে জামতলা বাজারে এখন প্রায় পনেরজন ব্যবসায়ী সাদেক আলীর উদ্ভাবিত সেই রসগোল্লা তৈরি করেন৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি
নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি আকারে বালিশের মত বড় নয়, কিন্তু আকৃতিগত দিক থেকে অনেকটাই বালিশ সদৃশ৷ দুধ, ছানা, চিনি আর ময়দা মিশিয়ে তৈরি হয় মিষ্টি৷ নেত্রকোনা শহরের গয়ানাথের দোকানে পাওয়া যায় প্রসিদ্ধ এ মিষ্টি৷ দেখতে অনেকটা চমচমের মতো৷ প্রতিটির ওজন ২০০ গ্রাম থেকে এক কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
মুক্তাগাছার মণ্ডা
ময়মসিংহের মুক্তাগাছার মিষ্টি মণ্ডার সুনাম দেশজোড়া৷ মুক্তাগাছার তারাটি গ্রামের গোপাল পাল নামে এক ময়রা ১৮২৪ সালে বিশেষ এ মিষ্টান্ন তৈরি শুরু করেন৷ তাঁর পরিবার পাঁচ পুরুষ ধরে এখনো তৈরি করেন এ মণ্ডা৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
বরিশালের আদি রসগোল্লা
বরিশালের রসগোল্লার স্বাদই আলাদা৷ বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের রসগোল্লা থেকে এটি স্বতন্ত্র৷ এ মিষ্টির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এতে মিষ্টির পরিমাণ খুবই কম৷ দেশি গরুর দুধ, উন্নতমানের চিনি আর কাঠের চুলা এ মিষ্টি তৈরির মূল উপাদান৷ বরিশাল অঞ্চলের সর্বত্রই এ মিষ্টি পাওয়া যায়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
নাটোরের ছানার জিলাপি
নাটোরের ছানার জিলাপিও বিখ্যাত৷ তবে এ মিষ্টির উত্পত্তি ভারতের নদিয়ার মুড়াগাছা অঞ্চলে৷ ছানার জিলাপি আসলে জিলাপির মতো নয়৷ ছানা দিয়ে তৈরি রসে ভেজানো এক ধরনের মিষ্টান্ন৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
গুটিয়ার সন্দেশ
বরিশালের গুটিয়া বাজারের সন্দেশের সুনাম দেশজুড়ে৷ গরুর দুধের ছানা দিয়ে তৈরি এ মিষ্টান্ন খুবই মজাদার৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
আরও যত বিখ্যাত মিষ্টি
বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলেই প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন রয়েছে৷ যেমন ফরিদপুরের মালাই সর, দিনাজপুরের গুড় ক্ষীরমোহন, রংপুরের হাবসি হালুয়া, রাজশাহীর রসকদম, পাবনার ইলিশপেটি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছানামুখী, খেপুপাড়ার জগার মিষ্টি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আদি চমচম, মেহেরপুরের সাবিত্রী মিষ্টি ও রসকদম, পাবনার বটফল, ফরিদপুরের বাগাট রাজকুমারের সাগরভোগ, বরিশালের রসের সন্দেশ, বগুড়ার আদি মহররমের দই, বরিশালের গৌরনদীর দই ইত্যাদি৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
বাংলার মিষ্টি
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী সব মিষ্টি এক ছাদের নীচে নিয়ে এসেছে ঢাকার ৬০ গুলশান অ্যাভিনিউতে অবস্থিত দোকান ‘বাংলার মিষ্টি’৷ এখান থেকে ঐতিহ্যবাহী সব মিষ্টি কেনা ছাড়াও দোকানে বসেই খেতে পারবেন যে কেউ৷