কেন টয়লেটে সন্তান প্রসব করতে গেলেন হামিদা? ছুটি পাননি বলে? লজ্জায়? কেনই বা ঐ সময়ে কাজ করতে গেলেন? অজ্ঞতার কারণে? কারখানা কর্তৃপক্ষের চাপে? নাকি দারিদ্র্যের কষাঘাতে? কারণ যা-ই হোক, ‘দায়ীত্বশীলরা’ দায় এড়াতে পারেন না৷
বিজ্ঞাপন
সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারে কাজ করার সময় হামিদা আক্তারের পেটে যন্ত্রণা শুরু হয়৷ কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে ছুটি চেয়েও তখন ছুটি পাননি৷ তাই বাধ্য হয়ে ছুটে যান টয়লেটে৷
‘মা’ ডাক শোনার স্বপ্ন প্রতিটি নারীর আর একজন নারী হয়ত পূর্ণতা পান মাতৃত্বেই৷ কিন্তু মা হতে যে দশ মাসের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়! এই পথকে সহজ করা এবং সুস্থ সন্তানের জন্ম দেওয়ার কিছু সহজ উপায় নিয়েই এই ছবিঘরে৷
ছবি: DW
হবু মায়ের অনুভূতি
‘মা’ – এটি একটি মাত্র শব্দ, যার সাথে মিশে আছে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা৷ সন্তানের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশা না করেই সন্তানকে মা পরম যত্নে বড় করে তোলেন, সেই গর্ভাবস্থা থেকেই৷ পৃথিবীতে একমাত্র মা-ই জানেন সন্তানকে গর্ভে ধারণ করার কষ্ট, ধৈর্য আর আনন্দের অনুভূতিটুকু৷
ছবি: imago/CTK Photo
স্বামী ও পরিবারের অন্যান্যদের সহযোগিতা
গর্ভবতী মায়েদের শরীরে হরমন পরিবর্তনের কারণে এ সময়ে তাঁদের অনেকেই কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে৷ আর এ কথাটি স্বামীসহ পরিবারের সকলকেই মনে রাখতে হবে৷ তাঁকে খুশি রাখার চেষ্টা করতে হবে, কারণ এতে পরিবারের অনাগত সদস্যটিরই মঙ্গল৷ শারীরিক এবং মানসিকভাবে মা সুস্থ থাকলে তার প্রভাব যে পড়ে শিশুটির ওপরও৷
ছবি: fotolia/diegoa8024
হবু মায়ের দিনের শুরু
‘‘সকালে উঠেই কুসুম গরম পানিতে গোসল সেরে নিন৷ তারপর পুরো শরীরে আস্তে আস্তে অলিভ অয়েল মাসাজ করে নিন৷ অন্য তেলও অবশ্য মালিশ করা যেতে পারে, তবে অলিভ অয়েলে সন্তান জন্মের পর সাধারণত পেটে আর কোনো দাগ থকে না৷’’ এমনটাই বলেন জার্মান ধাত্রী হাইকে শোয়ার্ৎস৷
ছবি: Fotolia/Subbotina Anna
সুন্দর ত্বক
গর্ভকালীন সময়ে শরীরে হরমনের পরিবর্তনের কারণে হবু মায়ের ত্বকেও দেখা দেয় নানা সমস্যা, বিশেষকরে মুখমণ্ডলে৷ তাই সপ্তাহে একবার ‘মাস্ক’ ব্যবহার করতে পারেন৷ যেমন একটি পাকা অ্যাভোকাডোর সাথে দু’চামচ ছানা মিশিয়ে চোখ ছাড়া পুরো মুখে লাগিয়ে দশ মিনিট পর গরম পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে ফেলুন৷ তারপর ভালো কোনো ‘সানস্ক্রিন’ লাগিয়ে ফেলুন৷
ছবি: Fotolia/studiovespa
গর্ভকালীন হালকা ব্যায়াম
ঘরের মেঝেতে পা মুড়ে বসুন এবং হতের তালু সামনে নিয়ে বুকের কাছে রাখুন৷ খুবই মনোযোগ দিয়ে আস্তে আস্তে গভীরভাবে নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নিন এবং পেটে থেকে নিঃশ্বাস ছাড়ুন আর ভাবুন – ‘‘এই নিঃশ্বাসের মধ্য দিয়ে আমার সন্তানের সাথে যোগাযোগ হচ্ছে৷’’ ব্যায়াম কোনো গ্রুপের সাথে করতে পারলে আরো ভালো লাগবে৷
ছবি: Fotolia/Robert Kneschke
হালকা খাবার
এই সময়টাতে অনেকেরই সকালে বেশ খারাপ লাগে বা বমিভাব হয়৷ তাই এক কাপ ভেষজ চা পান করতে পারেন সাথে একটা টোস্ট বা বিস্কুট৷ ধাত্রী হাইকে বলেন, ‘‘এ সময় অনেকেই সকালে গরম নাস্তা পছন্দ করেন৷ আসলে নিজের যা ভালো লাগে সেটাই খাবেন৷ তবে লক্ষ্য রাখবেন যে, সেই খাবার যেন ফাইবার বা আঁশযুক্ত হয়৷ এছাড়া তার সঙ্গে অবশ্যই ফল খেতে ভুলবেন না৷’’
পানি
একজন সুস্থ গর্ভবতীর দিনে কম পক্ষে দেড় থেকে দুই লিটার পানি পান করা উচিত৷ তাই মাঝে মাঝেই অল্প অল্প পানি পান করে নেবেন৷ এতে শরীরটা সারা দিন ঝরঝরে লাগবে এবং রক্ত ঘনও হয়ে যাবে না৷
ছবি: Fotolia/photo 5000
চুলের যত্ন
সাধাণত গর্ভবতী মায়েদের মাথার চুল তেমনভাবে ঝরে না৷ তবে কারো কারো চুলের আগা শুকিয়ে যায়৷ তাই তাঁরা বেবি শ্যাম্পু ব্যবহার করতে পারেন, এতে চুল নরম থাকে৷ তাছাড়া চুলকে সুন্দর ও ঝরঝরে রাখতে সপ্তাহে একদিন রান্নাঘর থেকে দুই টেবল চামচ অলিভ অয়েল, দুই চামচ সাদা দই এবং একটি ডিমের কুসুম মিশিয়ে মাথায় দিয়ে দশ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন৷
ছবি: Fotolia/Masson
মুক্ত বাতাস সেবন
‘‘শরীর এবং মনকে সুস্থ রাখতে এবং দুটোর মধ্যে সমতা রক্ষা করতে এই বিশেষ সময়টিতে মুক্ত বাতাস সেবন খুবই জরুরি৷ হাঁটাহাঁটি খুব ভালো, তবে গায়ে জোড় দিয়ে কোনোরকম ব্যায়াম করা উচিত নয়৷ এতে হিতে বিপরিত হতে পারে৷ অন্য ব্যায়াম, অর্থাৎ যাঁরা সাঁতার জানেন তাঁদের জন্য কিছুক্ষণ পানিতে থাকা কোমর এবং পিঠে বেশ আরাম দেয়৷’’ বলেন ধাত্রী হাইকে শোয়ার্ৎস৷
ছবি: imago/emil umdorf
দাঁত ব্রাশ
গর্ভবতী মাকে যেন সব সময় আকর্ষণীয় লাগে, সেজন্য দিনে অন্তত দু’বার দাঁত ব্রাশ করতে হবে, তবে নরম ব্রাশ দিয়ে৷ এ সময় অনেকের মাড়ি নরম হয়ে রক্ত ঝরতে পারে৷ তাই দাঁতের মাড়ি শক্ত রাখতে ক্যামেলিয়া চা দিয়ে কুলি করতে পারেন৷ এছাড়া প্রথম ছয় মাস নিয়মিত দাঁতের ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত বলে জানান ধাত্রী শোয়ার্ৎস৷
ছবি: imago/CHROMORANGE
হোম স্পা
‘‘সন্ধ্যায় বাথটবে কুসুম কুসুম গরম পানি ভর্তি করে তাতে এক গ্লাস দুধ ঢেলে দিন, যা ত্বককে মসৃণ করবে৷ কিছুক্ষণ টবে থাকার পর উঠে গায়ে তেল মালিশও করতে পারেন৷ চাইলে বাথটবে হবু মায়ের সঙ্গী বা কোচ হতে পারেন হবু বাবা৷’’ বলেন হাইকে৷
ছবি: Fotolia/Ariwasabi
পায়ের যত্ন
গর্ভবতী মায়ের জন্য সবচেয়ে বেশি ভারী বোধ হয় তাঁর পা দুটো৷ তাই সকালে বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থাতেই দুই পা খানিকটা উঁচু করে একটু একটু করে ঘোরাবেন৷ এতে রক্তসঞ্চালন ভালো হয়৷ রাতে যদি পা দুটোকে ভারী মনে হয়, তাহলে একটি বাটিতে ঠান্ডা পানি দিয়ে সামান্য লেবুর রস দিন৷ এতে ছোট টাওয়েল ভিজিয়ে পানিটা চিপে উঁচু করা পায়ে দুই মিনিট পেচিয়ে রাখুন৷
ছবি: superfood - Fotolia.com
ডাক্তারি ‘চেকআপ’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পেটের সন্তানটি যেন ভালোভাবে বড় হতে পারে সেজন্য চাই যথেষ্ট সবুজ শাক-সবজি এবং আয়োডিন৷ আরো দরকার আয়রন এবং ক্যালসিয়াম৷ তাই এ সবের কোনোটারই যেন ঘাটতি না থাকে৷ সুতরাং শারীর আর মনের যত্নের পাশাপাশি প্রয়োজন নিয়মিত ডাক্তারি ‘চেকআপ’-ও৷
ছবি: DW
13 ছবি1 | 13
প্রকৃত সত্যটা আসলে কী? হামিদার পক্ষ থেকে যা বলা হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, তা-ই কি ঠিক? নাকি কারখানা কর্তৃপক্ষই সত্যি ঘটনা তুলে ধরেছে? দেশের প্রায় সব কারখানায় কর্মীদের উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি রয়েছে- এটা যেমন সত্যি, তেমনি সাধারণ কর্মীদের অশিক্ষা বা স্বল্প শিক্ষা এবং আর্থিক অস্বচ্ছলতাজনিত অসহায়ত্ব ব্যাপক মাত্রায় রয়েছে, এটাও বাস্তব৷ তদন্তে প্রকৃত সত্যি বেরিয়ে আসুক – এটাই কাম্য৷ কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা এমন যে, তদন্ত প্রতিবেদনে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদলেও অবাক হবো না৷ তাই তো হয় সব সময়!
আবার হামিদা যদি সত্যি সত্যি গর্ভ ধারণের বিষয়টি লুকিয়ে থাকেন তাতেও অবাক হবো না৷ হামিদাদের ঘরে অভাব থাকে, লোকজ্জা থাকে, কুসংস্কার, ‘অজ্ঞতা'ও থাকে৷ কর্তৃপক্ষের নির্দেশ না মানলে চাকরি যায়৷ হামিদারা তাই সব অন্যায়-অনাচার মেনেই বছরের পর বছর চাকরি করে যান৷ স্বাস্থ্যের বিষয়ে অসচেতনতা, মাতৃত্বকালীন সময়ের করণীয় সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানই বা দেশের কতভাগ নারী আছে!!
তবে হামিদা সত্য গোপন করে থাকলেও কারখানা কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে পারে না৷ কর্তৃপক্ষের দাবি, হামিদাকে কারখানার চিকিৎসকের কাছে নেয়া হয়েছিল৷ তিনি সেখানে শুধু ব্যথার কথা বললেও নাকি পেটে সন্তান আসার কথা বলেননি৷ সে অবস্থায় তাঁকে ব্যথার ওষুধ দেয়া হয়েছিল, যদিও অর্তসত্ত্বাকে ব্যথা কমানোর ওষুধ খাওয়ালে অনেক সময় লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়৷ বাংলাদেশে ডাক্তাররা প্রায়ই কোনো রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া ওষুধ লিখে দেন৷ অপ্রয়োজনে শত রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর অভিযোগও আছে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে৷ হামিদার অজ্ঞতা বা অসচেতনতার বিষয়টি প্রমাণ সাপেক্ষ৷ কিন্তু অ্যাপেক্স কর্তৃপক্ষ যা দাবি করছে তা সত্যি হলে হামিদার গর্ভপাতের জন্য যে চিকিৎসক দায়ী, তা অস্বীকার করার উপায় আছে? যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যদি ওষুধ দেয়া হতো, কিংবা তৎক্ষনাৎ হাসপাতালে পাঠানো হতো, তাহলে কী এমন মর্মান্তিক, অমানবিক ঘটনা ঘটত?