ডান হাতে ১৪টি সেলাই, একটি রগ কেটে গেছে একেবারেই৷ হাতে এখন আর শক্তিও পান না৷ সিলেটের শফিক মিয়ার অভিযোগ, পুলিশের কুকুর কামড়ে তাকে এই অবস্থা করেছে৷
বিজ্ঞাপন
নির্মমভাবে শরণার্থী ও অভিবাসীদের পেটানোর অভিযোগ রয়েছে ক্রোয়েশিয়া পুলিশের বিরুদ্ধেও৷ এমনকি অনেক শরণার্থী বলছিলেন, বসনিয়া সীমান্ত পাড়ি দেয়ার পর ধরা পড়লে তাদের কালো মুখোশধারী পরিহিত পুলিশ চোখ বন্ধ করে পেটায়৷ এসব পুলিশের অনেকের ইউনিফর্মে জার্মান নাম লেখা, তেমনটাও অভিযোগ করেছেন অনেক শরণার্থী৷
বসনিয়া-ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তের ঠিক কাছেই অবস্থিত মিরাল ক্যাম্প৷ আর সে কারণে বসনিয়ায় অন্য অঞ্চলে অবস্থিত ক্যাম্পগুলোর চেয়ে এই ক্যাম্পটিই শরণার্থী ও অভিবাসীদের কাছে বেশি আগ্রহের৷ এখান থেকে তারা সহজেই অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করতে পারেন৷ এই চেষ্টার একটা নামও দিয়েছেন তারা- ‘গেম মারা’৷
বসনিয়ার তিনদিনে অনেক বাংলাদেশি শরণার্থী ও অভিবাসীর সঙ্গে কথা হয়েছে৷ প্রায় প্রত্যেকেই নিজের গায়ের কাপড় সরিয়ে দেখিয়েছেন লাঠির দগদগে দাগ৷
প্রতিদিনই রাস্তায় আমাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে বাংলাদেশ ছাড়াও আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মরক্কোসহ নানা দেশের অভিবাসন প্রত্যাশীদের সঙ্গে৷ কারো চোখ দিয়ে রক্ত পড়ছে, কারো পিঠে রক্ত জমে কালো হয়ে গেছে৷
কাওসার আহমেদের কথাই ধরুন৷ ডয়চে ভেলের সংবাদকর্মীদের দেখে তিনিও এসেছিলেন কথা বলতে৷ তখনও তার পায়ে ব্যান্ডেজ৷ রাতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে জঙ্গলে ঘুমাচ্ছিলেন, সকালে তাকেসহ অন্যদের ঘিরে ফেলে পুলিশ, তারপর তাদের বসনিয়া ফেরত পাঠানোর সময় পেটায় ইচ্ছেমতো৷ এমনকি কেবল অন্তর্বাস ছাড়া তাদের সব জামা-কাপড় এবং মোবাইল ফোনও রেখে দেয়া হয়৷
‘টাকা দিয়ে বিপদ কিনেছি’
এভাবেই নিজের হতাশার কথা ডয়চে ভেলের কাছে জানিয়েছেন বসনিয়ায় আটকে পড়া ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশী বাংলাদেশিরা৷ পানির সংকট, শীতের সমস্যা তো আছেই, অভিযোগ রয়েছে ক্রোয়েশিয়া পুলিশের নির্মম নির্যাতনেরও৷
ছবি: Anupam Deb Kanunjna/DW
‘পাঁচ লাখ টাকা লস দিয়েও ফেরত যাবো’
সিলেট থেকে বসনিয়া আসা সাইফুর রহমানের এখন পর্যন্ত ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে৷ ওমান-দুবাই সাগর পাড়ি দিয়ে আসার পর আর ফেরত যাওয়ার চিন্তা করা সম্ভব না বলেও জানান তিনি৷ তবে যেভাবে কষ্ট করে জঙ্গলে থাকতে হচ্ছে, নির্যাতন সহ্য করে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করতে হচ্ছে, তাতে এখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন তিনি৷ এখন কেউ যদি কেউ ১০ লাখ টাকাও তাকে দিতে চায়, তাহলে পাঁচ লাখ টাকা লস দিয়েও দেশে ফেরত যেতে চান তিনি৷
ছবি: Anupam Deb Kanunjna/DW
ওমানে ছয় মাস বেতন মেলেনি
ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে এখন বসনিয়ার জঙ্গলে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন মাদারিপুরের ইয়াসিন খান৷ ওমানে ফ্লাইবোর্ডের কারখানায় দীর্ঘদিন কাজ করেছেন তিনি৷ কিন্তু দালালের খপ্পরে পড়ে বেতন পাননি ছয় মাস৷ ফলে ইউরোপে স্থায়ী হওয়ার স্বপ্নে ওমান থেকে ইরান, তুরস্ক, গ্রিস, ম্যাসিডোনিয়া, সার্বিয়া হয়ে বসনিয়া আসেন তিনি৷ এই রাস্তা অতিক্রম করতে তার লেগেছে দুই বছর৷
ছবি: Anupam Deb Kanunjna/DW
বিজনেস ভিসায় তুরস্ক, তারপর বসনিয়া
মেরাজ শেখের বাড়ি গোপালগঞ্জ৷ বিজনেস ভিসায় তুরস্ক এসে সেখান থেকে অবৈধভাবে গ্রিসে আসেন তিনি৷ বসনিয়ার জঙ্গলে অতি কষ্টে থাকলেও এখনও বাঙালি খাবারের মায়া ছাড়তে পারেননি৷ কষ্ট করে জল, চাল ও লাকড়ি সংগ্রহ করে জঙ্গলেই চলছে ভাত রান্নার আয়োজন৷ এরই মধ্যে বসনিয়ায় তার এক বছর হয়ে গেছে৷ তিনবার সীমান্ত পাড়ির চেষ্টা চালিয়েছেন তিনি৷ খরচ হয়ে গেছে ১৩ লাখ টাকা, আরো অন্তত চার লাখ টাকা লাগবে বলে মনে করছেন মিরাজ৷
ছবি: Anupam Deb Kanunjna/DW
বড় পরিবার চালাতে নিরুপায় হয়ে...
একদিন আগেই ‘গেমে’ গিয়ে স্লোভেনিয়ার পুলিশের হাতে আটকা পড়েন মৌলভীবাজারের শেখ লাকী৷ বসনিয়ায় ফেরত পাঠানোর আগে সীমান্তে তাকে ক্রোয়েশিয়া পুলিশ মারধরও করেছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি৷ ওমানে পাঁচ বছর কাটিয়েও দেশে পরিবারকে তেমন একটা আর্থিক সাহায্য করতে পারেননি তিনি৷ ফলে পরিবারের কথা চিন্তা করেই ফ্রান্সে যাওয়ার লক্ষ্যে রওয়ানা হয়েছেন লাকী৷ খরচ হয়ে গেছে ১৭ লাখ টাকা৷
ছবি: Anupam Deb Kanunjna/DW
সাগরে মৃত্যুর ঝুঁকি
মধ্যপ্রাচ্য থেকে অনেকেই সাগর পথে ইরান, তুরস্ক বা গ্রিস আসেন৷ এ পথে মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে বলে ডয়চে ভেলেকে জানান রেহান আহমেদ৷ এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকবার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ক্রোয়েশিয়া প্রবেশের চেষ্টা করেছেন তিনি৷ প্রতিবারই ধরা পড়েছেন পুলিশের হাতে৷
ছবি: Anupam Deb Kanunjna/DW
ক্রোয়েশিয়া পুলিশের অত্যাচার
ক্রোয়েশিয়া সীমান্ত পাড়ি দেয়ার সময় পুলিশের নির্মম নির্যাতনের চিত্র ডয়চে ভেলেকে দেখাচ্ছেন সুনামগঞ্জের নিখিল৷ জাতিসংঘের অভিবাসী বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইওএম তাকে সীমান্ত থেকে নিয়ে এসেছে৷ এখন মিরাল ক্যাম্পে স্থান পেয়েছেন তিনি৷ নিখিলের সারা গায়ে পুলিশের লাঠির বাড়ির দাগ৷
ছবি: Anupam Deb Kanunjna/DW
রাজনৈতিক কারণে বিদেশ পাড়ি
সিলেটে রাজনৈতিক আক্রোশের শিকার হয়ে এখন বসনিয়ার মিরাল ক্যাম্পে আছেন বলে দাবি শায়েল আহমেদের৷ গ্রিস ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হলেও সেখান থেকে অন্য দেশে যাওয়া বেশ কষ্টকর৷ এজন্য বাধ্য হয়ে এখন বসনিয়ায় এসে সেখান থেকে ইটালি বা ফ্রান্স যাওয়ার চেষ্টা করছেন শায়েল৷
ছবি: Arafatul Islam/DW
কুকুরের কামড়, ১৪ সেলাই
ডান হাতে ১৪টি সেলাই, একটি রগ কেটে গেছে একেবারেই৷ হাতে এখন আর শক্তিও পান না সিলেটের শফিক মিয়া৷ তার অভিযোগ, পুলিশের কুকুর কামড়ে তার এই অবস্থা করেছে৷ এখন চার মাস ধরে মিরাল ক্যাম্পে আছেন শফিক৷ তবে এরই মধ্যে তার কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে৷ ফলে দেশে ফেরার সুযোগও আর দেখছেন না তিনি৷ সুস্থ হয়ে উঠলেই আবার সীমান্ত পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করবেন বলে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন শফিক৷
ছবি: Arafatul Islam/DW
8 ছবি1 | 8
শরণার্থীরা জানান, বসনিয়ায় পুশ-ব্যাকের পর তারা যখন প্রচণ্ড শীতের মধ্যে খালি গায়ে, খালি পায়ে হেঁটে আসেন, তখন কোনো বাসও তাদের নিতে চায় না৷ তবে কিছু বসনিয়ান সহমর্মী হয়ে তাদের জামা-জুতা দান করেন৷
ক্লাদুসার মিরাল ক্যাম্পে গিয়ে এমন অনেকের সঙ্গে দেখা হলো যাদের হাত ভাঙা, চোখে পট্টি বাঁধা৷ একজন পিঠের কাপড় তুলে দেখালেন স্পষ্ট লাঠির ক্ষত৷
সালমান নামের পাকিস্তানি এক শরণার্থী জানিয়েছেন, তাকে মেরে ফেরত পাঠানোর পর রাতের অন্ধকারে পথ ভুলে আবার বসনিয়া থেকে ক্রোয়েশিয়া ঢুকে পড়েন তিনি৷ সেখানে আবার ধরা পড়েন আগের রাতে তাকে পেটানো পুলিশের হাতেই৷ এবার দ্বিগুণ নির্যাতন করে আবার বসনিয়া ফেরত পাঠানো হয় তাকে৷
শরণার্থী যেসব এলাকাতে থাকেন, সেসব এলাকাতে সব দেশেই কিছু মানুষ তাদের পছন্দ করেন না, এটাই স্বাভাবিক৷ বাংলাদেশেও শুরুতে রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের মানবিক আচরণ থাকলেও এখন স্থানীয়দের অনেকেই রোহিঙ্গাদের অপছন্দ করতে শুরু করেছেন৷ কিন্তু অনেকে এখনও রোহিঙ্গাদের প্রতি অবিচারের যৌক্তিক সমাধানও চান৷
বসনিয়াতেও একই অবস্থা৷ বিশেষ করে ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকায় শরণার্থী ও অভিবাসীদের আনাগোণা বেশি থাকায় এখানকার মানুষ বসনিয়া সরকারের ওপরও বেশ ক্ষিপ্ত৷ তেমনই কয়েকজন নিয়মিত মিরাল ক্যাম্পের সামনে জড়ো হয়ে ক্যাম্প বন্ধের দাবি জানান৷ একদিন তো আমরা ক্যাম্পের সামনে শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলার কারণে আমাদের ওপরেই চড়াও হলেন৷ পরে পুলিশ এসে বলতে গেলে আমাদের উদ্ধার করে৷
কিন্তু অন্যদিকে বসনিয়ার অনেকেই শরণার্থীদের দুর্দশায় নিজেরাও ব্যথা পান৷ অনেকেও ক্ষিপ্ত ক্রোয়েশিয়ার পুলিশের ওপর৷ এমন একজন বসনিয়ান নিজে ডেকে আমাদের একটি ভিডিও দিয়েছেন৷ জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে কয়েকজন শরণার্থীকে হেঁটে আসতে দেখেছেন তারা, যাদের শরীরে নির্মম অত্যাচারের দাগ৷
ক্যাম্পের ম্যানেজার মিতে চিলকোভস্কিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ক্রোয়েশিয়া পুলিশের বর্বরতার বিষয়ে৷ তিনিও শরণার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া অভিযোগের কথা জানালেন, বললেন যে ক্রোয়েশিয়া পুলিশকেও এ বিষয়ে জানানো হয়েছে৷ কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে স্বাভাবিকভাবেই সব অস্বীকার করা হয়৷
বাংলাভাষী সাংবাদিক হিসেবে আমরাই প্রথম গিয়েছি এই অঞ্চলে৷ ফলে আমাদের দেখে নিজের মনের সব কথা খুব সহজেই খুলে বলতে পেরেছেন তারা৷ বারবার একটা আকুতিই জানিয়েছেন, যাই করা হোক, ক্রোয়েশিয়া সীমান্ত পুলিশের নির্যাতনের বিষয়টি যাতে তুলে ধরা হয়৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যরাষ্ট্র ক্রোয়েশিয়া ইউরোপের ভিসাবিহীন অঞ্চল শেঙ্গেনে নেই৷ ইইউ সীমান্তে সংশ্লিষ্ট দেশের পুলিশের সঙ্গে কাজ করে ফ্রন্টেক্স নামের ইউরোপিয়ান সংস্থাও৷ ক্রোয়েশিয়া পুলিশের কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে জার্মানি ফিরেই যোগাযোগ করি ফ্রন্টেক্সের সঙ্গে৷ উত্তরে সীমান্তে এমন কোনো ঘটনা সম্পর্কে তাদের কিছু জানা নেই বলে জানান সংস্থাটির মুখপাত্র ক্রিস বরভস্কি৷
সীমান্তে ফ্রন্টেক্সের কেবল ছয় জন অফিসার কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন বরভস্কি৷ ক্রোয়েশিয়া পুলিশকে তারা আকাশপথে নজরদারিতে সহায়তা করে৷ একই সঙ্গে ফ্রন্টেক্স সব ধরনের মানবাধিকার ও আইন মেনেই কাজ করছে বলেও জানিয়েছেন তিনি৷ স্বভাবতই এমন উত্তর আসবে ভেবেই বাড়তি একটা প্রশ্ন যোগ করে দিয়েছিলাম- ফ্রন্টেক্স এমন নির্যাতনের নিন্দা জানায় কিনা৷ উত্তরে বলা হয়েছে, যেকোনো নির্যাতন ও মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘনের নিন্দা জানায় ফ্রন্টেক্স৷
আমাদের অনেক প্রতিবেদনের নীচে অনেক পাঠক ও দর্শকই শরণার্থীদের নিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘এরা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে’, ‘এরা টাকার লোভে বিদেশ গেছে, এমনই হবে’, এমনকি অনেকে শরণার্থীদের পেটানো ‘উচিত’ বলেও মন্তব্য করছেন৷
মানবাধিকারের বিষয়টিই এমন৷ কেউ কোনো অপরাধ করলেও তার আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার রয়েছে৷ একজন চোরকেও পেটানো মানবাধিকারের লঙ্ঘন, সেটাও বেআইনী৷ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না করে যেকোনো অপরাধের অভিযোগের ‘পেটানোর’ যে সংস্কৃতি বাংলাদেশের মানুষের মনে গড়ে উঠছে, সেটা দূর করতে না পারলে অর্থনীতিতে দেশ এগিয়ে গেলেও, আমরা সভ্য হতে পারবো না৷
অন্যদিকে ইউরোপের দেশগুলোও যদি এই ‘পেটানো’ এবং ‘দেখেও চোখ বন্ধ করে রাখা’ সংস্কৃতির চর্চা করে, তাহলে তারা তথাকথিত ‘মানবতার পতাকা’ ওড়ানোর অধিকার হারাবে৷
কেউ যদি অবৈধ পথে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার চেষ্টাও করে, তাকে আটক করা যায়, জেলে পাঠানো যায়, দেশে ফেরত পাঠানো যায়, কিন্তু তার কাপড়চোপড় খুলে নেয়া যায় না, মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়া যায় না, তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা যায় না৷ এই সহজসরল কথাগুলো ইউরোপের পুলিশকে নতুন করে বোঝানোর কথা না৷
বলকান রুটে শরণার্থীদের ওপর পুলিশি অত্যাচার সীমাহীন হয়ে উঠেছে৷ ইউরোপের বন্ধ চোখ কি জোর করে খুলতে হবে?
ইউরোপের স্বপ্ন বন্দি বসনিয়ার জঙ্গলে
ইউরোপে অভিবাসনের প্রত্যাশায় এসে বসনিয়ায় আটকা পড়েছেন কয়েকশো বাংলাদেশি৷ ডয়চে ভেলের আরাফাতুল ইসলাম ও অনুপম দেব কানুনজ্ঞ তুলে ধরেছেন তাদের মানবেতর জীবনের দিনলিপি৷
ছবি: Arafatul Islam/DW
জঙ্গলে বসবাস
এটি বসনিয়া-ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী শহর ভেলিকা ক্লাদুসার একটি জঙ্গল৷ সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন কয়েকশো বাংলাদেশি৷ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছেন তারা৷ লক্ষ্য ক্রোয়েশিয়া হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করা৷
ছবি: Arafatul Islam/DW
পলিথিনের তাঁবু
সেখানে কোন স্থাপনা নেই৷ স্থানীয় সুপার মার্কেট থেকে পলিথিন কিনে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাত কাটানোর সাময়িক ব্যবস্থা করেছেন তারা৷ এক একটি তাঁবুতে ১০ থেকে ১২ জন থাকেন৷ সোমবার সকালে সেখানে তাপমাত্রা ছিল দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ ঠাণ্ডা বা বৃষ্টি কোনটি থেকেই রক্ষা পাওয়ার সুযোগ নেই এই আচ্ছাদনে৷
ছবি: Anupam Deb Kanunjna/DW
‘পুলিশ সবকিছু কেড়ে নেয়’
ইয়াসিন নামে একজন জানান, ওমান থেকে স্পিড বোটে করে তিনি ইরান থেকে তুরস্ক হয়ে গ্রিসে আসেন৷ তারপর গ্রিস থেকে আসেন বসনিয়াতে৷ ‘‘সর্বশেষ গত তিনদিন আগে ক্রোয়েশিয়া প্রবেশের চেষ্টা করি৷ সে সময় কিছুটা (ক্রোয়েশিয়ার) ভিতরে ঢুকেছিলাম৷ কিন্তু পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যাই৷ পুলিশ আমার সবকিছু কেড়ে নেয়৷ শুধু আন্ডারওয়্যার পরা অবস্থায় আমাকে এখানে ফেরত পাঠায়৷’’
ছবি: Arafatul Islam/DW
লাখ টাকা খরচ
মোটা অংকের টাকা খরচ করে দালালদের মাধ্যম ইউরোপের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছেন তারা৷ ‘‘১৮ থেকে ২০ লাখ খরচ করে এখানে এসেছি৷ বিভিন্ন দেশে দালালদের এ টাকা দিতে হয়েছে আমাদের৷ এ মুহূর্তে দেশে গেলে নিঃস্ব হয়ে যাব আমরা,’’ জানালেন একজন৷
ছবি: Arafatul Islam/DW
গোসলের সুযোগ
আশেপাশে নেই বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা৷ বৃষ্টিতে নীচু জমিতে পানি জমেছে, যা গোসল আর কাপড় ধোয়ার সুযোগ করে দিয়েছে অভিবাসন প্রতাশীদের৷
ছবি: Arafatul Islam/DW
মিরাল ক্যাম্প
কাছেই আছে জাতিসংঘের ‘আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা’ আইওএম পরিচালিত মিরাল ক্যাম্প৷ ক্যাম্পে মোট সাতশ জনের থাকার ব্যবস্থা আছে৷ এদের মধ্যে ৫০ শতাংশ পাকিস্তানি অভিবাসনপ্রত্যাশী৷ বাংলাদেশিদের হার ২৮ শতাংশ৷ এছাড়া মরক্কো, আফগানিস্তান, সিরিয়া, আলজেরিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশের অভিবাসনপ্রত্যাশীরাও আছেন সেখানে৷
ছবি: Arafatul Islam/DW
ক্যাম্পের সুযোগ-সুবিধা
ক্যাম্পের ব্যবস্থাপক আইওএম কর্মকর্তা মিতে চিলকোভস্কি জানান, ক্যাম্পের বাসিন্দাদের দিনে তিন বেলা খাবার দেয়া হয়৷ পাশাপাশি তাদের অন্য সামগ্রীও দেয়া হয়৷ এছাড়া স্থানীয় ডাক্তারদের দিয়ে ক্যাম্পের ভেতরে ও বাইরে থাকা আহত অভিবাসনপ্রত্যাশীদের চিকিৎসা দেয়া হয়৷
ছবি: Arafatul Islam/DW
নির্যাতন
বসনিয়া সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে ক্রোয়েশিয়ার পুলিশের বাধা ও তাদের হাতে নির্যাতিত হওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন ক্যাম্পে বাস করা বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীরা৷ যেমন সিলেট থেকে আসা শফিক মিয়া তার ডানহাতে থাকা কুকুরের কামড়ের ক্ষত দেখিয়েছেন৷ অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশ কুকুর ছেড়ে দিয়েছিল বলে অভিযোগ করেন তিনি৷ ছবিতে নির্যাতনের চিহ্ন দেখাচ্ছেন মিরাল ক্যাম্পে থাকা আরেক বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী৷
ছবি: Anupam Deb Kanunjna/DW
পরিত্যাক্ত কারখানা
বেশিরভাগেরই ঠাই মেলেনি মিরাল ক্যাম্পে৷ তাদের বড় একটি অংশই আশ্রয় নিয়েছেন জঙ্গলে৷ সেখানেও এখন থাকার জায়গা নেই৷ বাকিরা তাই বেছে নিয়েছেন পাশের একটি পরিত্যাঙ্ক কারখানা ভবন৷
ছবি: Anupam Deb Kanunjna/DW
শতাধিক
এই কারখানা ভবনেও শতাধিক বাংলাদেশির দেখা পেয়েছেন ডয়চে ভেলের দুই সংবাদকর্মী৷ বাংলাদেশির পাশাপাশি আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে আসা শরণার্থীরাও আছেন সেখানে৷
ছবি: DW
দেয়াল, ছাদবিহীন ভবন
কারখানা ভবনটির চারপাশের একটি বড় অংশেই দেয়াল নেই৷ এমনকি ছাদের অনেকটা অংশই ফাঁকা৷ যার কারণে অনায়াসে বৃষ্টির পানি ঢুকছে সেখানে৷ আছে শীতের প্রকোপও৷
ছবি: Anupam Deb Kanunjna/DW
পুলিশের তাড়া
অভিবাসীদের অভিযোগ কারখানাতে অনেক সময় পুলিশ আসে৷ সেসময় তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যেতে হয় সেখান থেকে৷ পরে আবারো এসে আশ্রয় নেন তারা৷
ছবি: Anupam Deb Kanunjna/DW
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ
ভবনটির মেঝেতে জমে আছে পানি৷ পাশেই ময়লার স্তূপ৷ এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই দিনের পর দিন কাটাচ্ছেন ইউরোপের স্বপ্নে বিভোর মানুষগুলো৷
ছবি: Arafatul Islam/DW
এক জায়গায় সব
অস্বাস্থ্যকর সেই পরিবেশে রান্না, খাওয়া আর থাকার ব্যবস্থা৷ খাবার কিনতে হয় স্থানীয় সুপার মার্কেট থেকে৷ তবে সেজন্যেও বহু কাঠখড় পোহাতে হয়৷ অনেকের কাছে নেই পর্যাপ্ত টাকাও৷
ছবি: Arafatul Islam/DW
ছিনতাইয়ের ভয়
মানবেতর এই পরিস্থিতিতে আরেক বিপদ ছিনতাই৷ রাতের বেলা বাইরে বের হয়ে ছিনতাইয়ের কবলে পড়তে হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ৷
ছবি: Arafatul Islam/DW
স্থানীয়দের সহযোগিতা
তবে অনেক সময় স্থানীয়দের কেউ কেউ সহযোগিতাও করেন৷ ছবির ব্যক্তির সামনে রাখা চুলাটি সেভাবেই মিলেছে৷
ছবি: Arafatul Islam/DW
অবশেষে সহায়তার দেখা
গত কয়েক মাসে ক্যাম্পের বাইরে থাকা এই শরণার্থীরা আন্তর্জাতিক কোন সংস্থা থেকে মানবিক সহায়তা পাননি বলে অভিযোগ৷ তবে ১৯ অক্টোবর আইওএম এর একটি দল সেখানে উপস্থিত হন৷ ছয়শো জনকে তারা কিছু খাবার আর স্লিপিং ব্যাগ দিয়েছেন৷ প্রথমবারের মতো এমন সহায়তা মিলেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশিরা৷
ছবি: Arafatul Islam/DW
প্রাথমিক চিকিৎসা
সীমান্ত অতিক্রম করতে গিয়ে অনেকেই আহত হয়েছেন৷ আবার ক্রোয়েশিয়া পুলিশের নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগও করেছেন কেউ কেউ৷ তেমনই একজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছিলেন রেডক্রসের কর্মীরা৷
ছবি: Arafatul Islam/DW
‘গেম মারা’
আটকা পড়া অভিবাসন প্রত্যাশীরা দালালের মাধ্যমে দল বেঁধে চেষ্টা করেন সীমান্ত অতিক্রমের৷ এটিকে তারা বলে থাকেন ‘গেম মারা’৷ তবে বেশিরভাগই ব্যর্থ হোন৷ ক্রোয়েশিয়া পুলিশের হাতে ধরা পড়ে আবার ফিরে আসেন জঙ্গলেই৷
ছবি: Arafatul Islam/DW
ইউরোপ কত দূর
এই বাংলাদেশিদের কেউ কেউ মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপে ঢুকার চেষ্টা করে যাচ্ছেন দুই-তিন বছর ধরে৷ এর মধ্যে দালালকে দিয়েছেন ১৫-২০ লাখ টাকা করে৷ তবুও দেখা মেলে না প্রত্যাশিত গন্তব্য ফ্রান্স বা ইটালির৷ একজন বলেছেন, ‘‘ওমান, দুবাইর সাগর পাড়ি দেয়ার পর পেছনে যাওয়ার উপায় নাই৷ ইটালি ম্যাপে দেখতে অনেক ছোট লাগে, কিন্তু যেতে অনেক সময় লাগে৷ অনেক কষ্ট৷’’
ছবি: Arafatul Islam/DW
আর যেন কেউ না আসে
বেশিরভাগই জানিয়েছেন তারা এভাবে এসে ভুল করেছেন৷ টাকা দিয়ে বিপদ কিনেছেন৷ এতটা অবর্ণনীয় কষ্টে পড়তে হবে কেউ ভাবেননি৷ তাদের মতো কেউ যেন আর অবৈধপথে পাড়ি না জমায় সেই অনুরোধ জানান৷