জাতিসংঘের মানবাধিকার হাই কমিশনার নাভি পিল্লাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনীতিকদের ক্রমবর্ধমান প্ররোচনামূলক বাচনভঙ্গির সমালোচনা করে বলেছেন, এর ফলে সহিংসতা ও মানবাধিকার ভঙ্গের পথ প্রশস্ত হচ্ছে৷ বাড়ছে বহিরাগত-বিদ্বেষ৷
বিজ্ঞাপন
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গ্রীষ্মকালীন অধিবেশনের উদ্বোধন উপলক্ষ্যে পিল্লাই বলেন, বহিরাগত-বিদ্বেষী, জাতিবাদী ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতামূলক বাগাড়ম্বরের কারণে ইউরোপে বৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ব্যাহত হতে পারে৷ পিল্লাই এই ধরনের ‘হেট স্পিচ' বা আক্রোশমূলক বক্তব্যের উদাহরণ দিতেও ভোলেননি৷
পিল্লাই জার্মানির ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি বা এনপিডি দলের সাবেক প্রধান উডো ফয়েগ্ট-এর ইউরোপীয় সংসদে নির্বাচিত হওয়ার কথা বলেন এবং স্মরণ করিয়ে দেন যে, এই ফয়েগ্ট-ই মন্তব্য করেছেন: ‘‘ইউরোপ শ্বেতাঙ্গদের মহাদেশ এবং তার সেটাই থাকা উচিত৷''
তার পরই পিল্লাই উল্লেখ করেন ফ্রান্সের ফ্রঁ নাসিনাল বা ন্যাশনাল ফ্রন্ট দলের প্রধান মারিন ল্য পেন-এর কথা, যাঁর দল সাম্প্রতিক ইউরোপীয় নির্বাচনে ২৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ফ্রান্স থেকে সর্বাধিক আসন সংগ্রহ করেছে৷ মারিন ল্য পেন মুক্ত প্রাঙ্গণে প্রার্থনারত মুসলিমদের জার্মানির হাতে ফ্রান্সের জবরদখল হওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন৷
অপরদিকে ন্যাশনাল ফ্রন্টের ৮৫-বছর-বয়সি প্রতিষ্ঠাতা – এবং মারিন ল্য পেনের পিতা – জঁ-মারি ল্য পেন সম্প্রতি তাঁর সমালোচকদের ‘‘চুল্লিতে পোরার'' কথা বলে নিজের কন্যার রোষের পাত্র হয়েছেন – কেননা পিতার উক্তির ফলে কন্যার ইউরোপীয় সংসদে উগ্র দক্ষিণপন্থিদের একটি নিজস্ব গোষ্ঠী গঠনের চেষ্টা বিপন্ন হতে পারে৷
তবে পিল্লাই-এর সব মন্তব্যের পটভূমিতে রয়েছে সম্প্রতি ব্রাসেলসের ইহুদি সংগ্রহশালার উপর যে প্রাণঘাতি আক্রমণ চালানো হয়, সেই বিভীষিকা৷ সেখানে গুলি চালায় ২৯ বছর বয়সি মেহদি নেমুশ, যে সিরিয়ায় জিহাদীদের কাছ থেকে সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ পেয়েছিল বলে পুলিশের ধারণা৷ ধ্বনি-প্রতিধ্বনির মতো এভাবেই দু'পক্ষে ঘৃণা ও বিদ্বেষ বেড়ে চলেছে৷
জার্মানিতে সফল কয়েকজন তুর্কি
১৯৮২ সালে জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর হেলমুট কোল বলেছিলেন, তিনি জার্মানিতে বসবাসরত তুর্কিদের সংখ্যা কমিয়ে অর্ধেকে নিয়ে আসতে চান৷ ছবিঘরে থাকছে জার্মানির কয়েকজন সফল মানুষের কথা, যাদের শেকড় তুরস্কে৷
ছবি: Keystone/Getty Images
চিত্র পরিচালক ফাতিহ আকিন
ফাতিহ আকিন জার্মানির চিত্রজগতের সুপারস্টারদের মধ্যে একজন, যার আন্তর্জাতিক পরিচিতি রয়েছে৷ তাঁর অভিনীত ছবি ‘গেগেন ডি ভান্ড’ (দেয়ালের বিপরীতে) ছবির জন্য তিনি বেশ কয়েকটি পুরস্কারও পেয়েছেন৷ সেগুলোর মধ্যে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব বার্লিনালের ‘গ্লোডেন বেয়ার’ও রয়েছে৷ তাঁর বাবা, মা দুজনই তুরস্ক থেকে এসেছেন৷ ফাতিহ আকিনের জন্ম ১৯৭৩ সালে জার্মানির হামবুর্গ শহরে৷
ছবি: dapd
রাঁধুনি আলি গ্যুনগোরমুস
গ্যুনগোরমুস ২০০৬ সালে একটি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সেরা রাঁধুনির পুরস্কার লাভ করেন৷ তাঁর ‘ল্য কানার নুভো’ নামের রেস্তোরাঁটি নামকরা রেস্তোরাঁর মধ্যে একটি৷ আলি ১০ বছর বয়সে তুরস্ক থেকে এসেছেন৷ ৩৭ বছর বয়সি আলি বলেন, তিনি যে একটি দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছেন সেটাই তাঁকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে প্রেরণা যুগিয়েছে৷
ব্যবসায়ী ভুরাল ওয়গার
ব্যবসায়ী ভুরাল ওয়গার ১৯৬০ সালে তুরস্ক থেকে জার্মানিতে এসেছেন৷ তিনি পড়াশোনা শেষ করার পর একটি আন্তর্জাতিক ট্রাভেল এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করেন৷ যেটা জার্মানির বৃহত্তম ট্রাভেল এজেন্সি হিসেবে গড়ে উঠে৷ তিনি ২০০৮ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত এসপিডি দলের হয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে সংসদ সদস্য ছিলেন৷ তাঁর আন্ত:সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকান্ডের জন্য তাঁকে জার্মানির সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মাননা ‘জার্মান সেবা পদক’ দেয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রাজনীতিক: সেম ওসডেমিয়ার
তুর্কি বংশোদ্ভূতদের মধ্যে সেমি ওসডেমিয়ারই প্রথম যিনি ১৯৯৪ সালে সবুজ দলের সদস্য হিসেবে জার্মানির সংসদ সদস্য হন৷ শুধু তাই নয়, পরে তিনি সবুজ দলের চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন৷ তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নে তুরস্কের অন্তর্ভুক্তির একজন সমর্থক৷ ওসডেমিয়ার জার্মান স্কুলে তুর্কি ভাষা শিক্ষা দেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উপস্থাপিকা নাজান একেস
হাসি মুখে যিনি বসার ঘরের টিভিতে উপস্থিত হন তিনি হচ্ছেন নাজান একেস৷ তিনি জার্মানির একজন জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপিকা৷ অভিবাসী তুর্কি বাবা-ময়ের সন্তান নাজান ছোট বড় অনেক টিভি অনুষ্ঠানেই উপস্থাপনা করেন৷ ২০১০ সালে নাজানের পরিবারের গল্প নিয়ে তাঁর লেখা একটি বই প্রকাশিত হয়েছে৷ তিনি সামাজিক কর্মকান্ডের সাথেও জড়িত৷ ২০১১ সাল থেকে তিনি জার্মান সরকারের ইন্টিগ্রেশন কাউন্সিল-এ আছেন৷
ছবি: Getty Images
জার্মান ফুটবল দলের খেলোয়াড় মেসুত ওজিল
মেসুত ওজিল জার্মান ফুটবল তারকাদের একজন৷ তুর্কি বাবা মায়ের সন্তান ওজিল জার্মান নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন এবং ২০০৯ সালে জার্মান জাতীয় ফুটবল দলে খেলার সুযোগ লাভ করেন৷ ২০১০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতায় ফুটবল প্রেমীদের হৃদয় জয় করায় তাঁকে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের তালিকায় মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল৷ মেসুত ওজিল জার্মানির সবচেয়ে দামি খেলোয়াড়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হেলমুট কোলের বিতর্কিত বিবৃতি
জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর হেলমুট কোল ১৯৮২ সালে ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারকে বলেছিলেন, তিনি জার্মানিতে বসবাসরত তুর্কিদের সংখ্যা অর্ধেকে কমিয়ে ফেলতে চান৷ কারণ তাঁর মনে হয়েছিল, তুর্কিরা জার্মান সমাজের সঙ্গে নিজেদের ভালভাবে খাপ খাওয়াতে পারছেন না৷ ছবিঘরে থাকছে জার্মানির কয়েকজন সফল তুর্কি বংশোদ্ভূত নাগরিকের কথা৷
ছবি: Keystone/Getty Images
7 ছবি1 | 7
সন্ত্রাসের জবাব যদি অসহিষ্ণুতা হয়, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচনে ফ্রান্স, ব্রিটেন ও ডেনমার্কে দক্ষিণপন্থি দলগুলির জয় এবং অস্ট্রিয়া, ফিনল্যান্ড ও সুইডেনে দক্ষিণপন্থি দলগুলির বর্ধিত সাফল্যের একটা ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় বৈকি৷ তবে উত্তরটা স্বভাবতই অতটা সহজ নয়৷ স্বদেশে অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে যদি বিদেশ থেকে – এমনকি অপরাপর, দরিদ্রতর ইইউ দেশ থেকে অভিবাসন যুক্ত হয়, তাহলে শুধু কোনো দক্ষিণপন্থি রাজনীতিকের এই অশুভ সংমিশ্রণের সুযোগ নেওয়ার অপেক্ষা৷ সঙ্গে-সঙ্গে জ্বলে ওঠে বহিরাগত-বিদ্বেষ – ও সেই বিদ্বেষে সাধারণ মানুষদের নীরব সমর্থনের আগুন৷ যেমন ইটালির নর্দার্ন লিগ দলের মারিও বোরঘেজি স্বয়ং অভিবাসীদের রাস্তায় পাতা বিছানায় আগুন দিয়েছেন – কিন্তু তা সত্ত্বেও এবার ইউরোপীয় সংসদে নির্বাচিত হয়েছেন৷
ইউরোপীয় কমিশনের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জোসে মানুয়েল বারোসোর মতে, চরমপন্থি মনোভাবগুলি যে পরস্পরের সঙ্গে বিরোধ বাঁধাতে চাইছে, যা শেষমেষ ইউরোপীয় মূল্যবোধের মূলেই কুঠারাঘাত করবে, সেই প্রক্রিয়াটাকে সর্বাগ্রে রোখা প্রয়োজন৷