বাংলাদেশের এক বিতর্কিত বিশেষ বাহিনী ব়্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান (ব়্যাব)৷ এই বাহিনী একসময় জঙ্গি দমনে ব্যাপক সাফল্য দেখালেও এখন ব্যবহৃত হচ্ছে ‘ডেথ স্কোয়াড’ হিসেবে৷ এমন বাহিনীর কি আদৌ দরকার আছে?
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের বিভিন্ন বাহিনীর এক ধরনের পোশাকি গুরুত্ব আছে৷ কোনো এলাকায় পুলিশ, ব়্যাব কিংবা সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে৷ সাধারণ মানুষ পুলিশ দেখে অভ্যস্থ৷ ঘুসখোর এবং দুর্বল হিসেবে পুলিশ মোটামুটি পরিচিত৷ তাদের উপস্থিতি তাই সাধারণের মনে বাড়তি কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না৷ তবে ব়্যাবের বিষয়টি ভিন্ন৷ কালো পোশাকে এই বিশেষ বাহিনী কোথাও গেলে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়৷ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়৷ যারা পুলিশকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চান না, তারা নড়েচড়ে বসেন৷ ব়্যাবের মধ্যে একটা কঠোর, গুরুত্বপূর্ণ এবং ক্ষমতাবান ব্যাপার আছে৷ যা সাধারণ পুলিশের মাঝে তেমন নেই৷
র্যাব – বিতর্কিত এক বিশেষ বাহিনী
শুরুটা হয়েছিল ২০০৪ সালে৷ সেসময় বাঘা বাঘা জঙ্গিদের কুপোকাত করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় ব়্যাব৷ কিন্তু অসংখ্য ক্রসফায়ার, অপহরণ, হত্যার দায়ে এখন সমালোচিত এই ‘এলিট ফোর্স’৷ র্যাব নিয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/AFP
‘এলিট ফোর্স’
বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব নামক ‘এলিট ফোর্স’-এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে৷ এই বাহিনীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ‘‘পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে সরকার একটি এলিট ফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করে৷’’ তবে এই বাহিনী এখন তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন মহল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সমন্বিত বাহিনী
বাংলাদেশ পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে র্যাব গঠন করা হয়৷ এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাস প্রতিরোধ, মাদক চোরাচালান রোধ, দ্রুত অভিযান পরিচালনা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কার্যক্রমে নিরাপত্তা প্রদান৷
ছবি: Getty Images/AFP
জঙ্গি তৎপরতা দমন
শুরুর দিকের ব়্যাবের কার্যক্রম অবশ্য বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল৷ বিশেষ করে ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে বাংলাদেশে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা উগ্র ইসলামি জঙ্গি তৎপরতা দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে র্যাব৷
ছবি: AP
জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার
বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় ২০০৫ সালে একসঙ্গে বোমা ফাটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা জেএমবির শীর্ষ নেতাদের আটক ব়্যাবের উল্লেখযোগ্য সাফল্য৷ ২০০৬ সালের ২ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান (ছবিতে) এবং ৬ মার্চ সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় ব়্যাব৷ একাজে অবশ্য পুলিশ বাহিনীও তাদের সহায়তা করেছে৷
ছবি: DW
ভুক্তভোগী লিমন
২০১১ সালে লিমন হোসেন নামক এক ১৬ বছর বয়সি কিশোরের পায়ে গুলি করে এক ব়্যাব সদস্য৷ গুলিতে গুরুতর আহত লিমনের বাম পা উরুর নীচ থেকে কেটে ফেলতে হয়৷ এই ঘটনায় ব়্যাবের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ তবে এখনো সুবিচার পায়নি লিমন৷ উল্টো বেশ কিছুদিন কারাভোগ করেছেন তিনি৷
ছবি: DW
‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’
জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্য দেখালেও ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব়্যাবের বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমশ বাড়তে থাকে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করে জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বাহিনী ‘সিসটেমেটিক’ উপায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে৷
ছবি: DW
‘ক্রসফায়ার’
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ব়্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ২৪ জন৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে কমপক্ষে সাতশো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ব়্যাব জড়িত ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আলোচিত সাত খুন
২০১৪ সালের মে মাসে ব়্যাবের বিরুদ্ধে ৬ কোটি টাকা ঘুসের বিনিময়ে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ এবং খুনের অভিযোগ ওঠে৷ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন ব়্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ৷ এই ঘটনার পর ব়্যাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আবারো বিতর্ক শুরু হয়েছে৷
ছবি: DW
প্রতিষ্ঠাতাই করছেন বিলুপ্তির দাবি
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করেছেন৷ অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ‘এলিট ফোর্স’৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিলুপ্তির দাবি নাকচ
বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক স্তর থেকে ব়্যাবকে বিলুপ্তির দাবি উঠলেও বর্তমান সরকার সেধরনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না৷ বরং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ব়্যাব বিলুপ্তির দাবি নাকচ করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘র্যাবের কোনো সদস্য আইন ভঙ্গ করলে তাদের চিহ্নিত করে বিচারিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়৷’’
ছবি: Getty Images/AFP
10 ছবি1 | 10
ব়্যাব কেন দরকার?
ব়্যাবের মতো বিশেষ বাহিনী বিশ্বের আরো অনেক দেশে আছে৷ সন্ত্রাসী হামলা দ্রুত মোকাবিলা থেকে শুরু করে বিশেষ পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা নিশ্চিতে কিংবা জঙ্গিবাদ দমনের মতো অপারেশনে এমন বাহিনীর গুরুত্ব অপরিসীম৷ তাই বাংলাদেশেরও পুলিশের পাশাপাশি ব়্যাবের মতো বিশেষ বাহিনীর প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে৷ ২০০৬ সালে জঙ্গিবাদ দমন করে সেই প্রয়োজনীয়তা প্রমাণও করেছে বাহিনীটি৷
সমস্যা রাজনৈতিক ব্যবহারে
সমস্যা বাঁধে ব়্যাব যখন রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যবহার হয়৷ বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ব়্যাবকে ব্যবহার করছে বিরোধী দল দমনে৷ ছোটখাট অভিযোগে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গায়েব করা থেকে শুরু করে কথিত বন্ধুকযুদ্ধের নামে হত্যার অজস্র অভিযোগ এখন এই বাহিনীর বিরুদ্ধে৷ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো ব়্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে অত্যন্ত সরব৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর ওয়েবসাইটে ব়্যাব নিয়ে বিশেষ একটি পাতাই রয়েছে৷ গত বছর এই বাহিনীকে ‘ডেথ স্কোয়াড' আখ্যা দিয়ে তা ভেঙে দেয়ার সুপারিশ করেছে আন্তর্জাতিক সংগঠনটি৷ এইচআরডাব্লিউ-র হিসেব অনুযায়ী, ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দশ বছরে কমপক্ষে আটশো হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে ব়্যাব৷
আরেক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও ব়্যাবের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে একাধিকবার প্রশ্ন তুলেছে৷ গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের অপহরণ, গুমের পেছনে বিশেষ এই বাহিনীর ভূমিকা রয়েছে, দাবি করেছে সংগঠনটি৷ তারা সুনির্দিষ্ট কিছু ঘটনা তদন্তের প্রেক্ষিতে বলেছে একথা৷
সমালোচনায় সীমাবদ্ধ আন্তর্জাতিক সমাজ
সর্বশেষ কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ সফরকালে ব্রিটেনের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ডেসমন্ড সোয়ানি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড গ্রহণযোগ্য নয়৷ তিনি দোষীদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নও ব়্যাবের সমালোচনা করেছে একাধিকবার৷
লক্ষ্যণীয় ব়্যাব নিয়ে আন্তর্জাতিক সমাজের অবস্থান অনেকটা সমালোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ৷ এসব সমালোচনা বাংলাদেশ সরকার কিংবা বাহিনীটি বিশেষ আমলে নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না৷ বরং আবারো নিয়মিত হয়ে উঠেছে ‘ক্রসফায়ার'৷ আর এ সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিশেষ বাহিনী হিসেবে ব়্যাবের প্রয়োজনীয়তাকে ম্লান করে দিচ্ছে৷
ব্লগ পোস্টটিতে কি আরো কিছু যোগ করার আছে? আপনার মতামত লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷