পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে ইউরোপের সব বাঁধ তুলে দেয়ার প্রস্তাব করেছে একটি গোষ্ঠী৷ কিন্তু এটা কি আসলেই দরকার? তাছাড়া এত উপকার করেই বা কী হবে?
বিজ্ঞাপন
ইউরোপের ৬০ শতাংশ ভূপৃষ্ঠের পানি বর্তমানে দুর্বল প্রাকৃতিক অবস্থায় রয়েছে৷ ইউরোপীয় পরিবেশ এজেন্সির পানির মান নিয়ে এক গবেষণা থেকে জানা গেছে এই তথ্য৷
‘ডেম রিমুভাল ইউরোপ' নামের বেসরকারি একটি সংগঠন পানির আধারগুলোর দুরাবস্থার জন্য সরাসরি এই অঞ্চলের ৩০ হাজারের মতো বাঁধকে দায়ী করেছে৷ সংগঠনটি মনে করছে, বাঁধ শুধু পরিবেশেরই ক্ষতি করছে না, এগুলো রক্ষণাবেক্ষণও ব্যয়বহুল৷ ফলে সেগুলো তুলে ফেলার পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে তারা৷
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসেব অনুযায়ী, বর্তমানে ইউরোপের মাত্র এক শতাংশ নদী স্বাধীনভাবে প্রবাহিত হচ্ছে৷ বাঁধের কারণে মাছেরও ক্ষতি হচ্ছে৷ কিছু মাছের প্রজাতি প্রজননের জন্য নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে না পারায় সেগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে৷ স্যামন এবং স্ট্যারজেন মাছ ইউরোপের কিছু দেশ থেকে ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে৷
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাঁধের কারণে মাটির গুণগতমানেও পরিবর্তন আসছে৷ পলি এবং অন্যান্য পরিপোষক পদার্থ বিভিন্ন কাঠামোতে আটকে যাওয়ায় নদীর পানিতে মিশে ছড়িয়ে যেতে পারছে না৷ আর পলি একজায়গায় আটকে গেলে, পানির অতিরিক্ত প্রবাহ ভাঙন ত্বরান্বিত করে৷
বন্যার হাত থেকে জার্মানি যেভাবে বাঁচে
পরিখা ছাড়া জার্মানির উত্তর সাগর উপকূলে মানুষের বসতি সম্ভব ছিল না৷ বন্যার সময় এই পরিখা সেখানকার ভূমিকে শুষ্ক রাখে এবং ভয়াবহ ঝড় থেকে মানুষ ও প্রাণীকে রক্ষা করে৷
ছবি: Imago/Tillmann Pressephotos
পরিখা তৈরিতে সবার অংশগ্রহণ
পরিখা নির্মাণ এমন একটা কাজ, যেখানে সবার অংশগ্রহণ জরুরি৷ মধ্যযুগে পরিখা সংক্রান্ত দায়িত্বে যে অবহেলা করত, তাকে কঠোর শাস্তি দেয়া হতো৷ পরিখা খননে কীভাবে মানুষকে বাধ্য করা হতো অটেনডর্ফের এই ভাস্কর্যটি তার একটা প্রমাণ৷ শত শত বছর ধরে উপকূলীয় এলাকার মানুষই এ কাজ করে যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/G. Franz
১৯৬২ সালে বন্যা
১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জার্মানির উপকূলীয় এলাকাগুলোতে, বিশেষ করে হামবুর্গে বন্যা দেখা দেয়৷ দুই দিনের বন্যায় ৬০ হাজার ঘর বিধ্বস্ত হয়৷ কেবল হামবুর্গেই মারা যায় ৩১৫ জন৷
ছবি: Imago/ZUMA/Keystone
শ্কফভের্ক
পূর্ব ফ্রিজিয়ায় পুরোনো ধরনের পানি সেচ পদ্ধতি৷ এর মাধ্যমে অভ্যন্তরে প্রবেশ করা পানি পাম্প করে বের করে দেয়া হয়৷ পরিখায় পানির উচ্চতা অনেক উপরে উঠে গেলেও এই ব্যবস্থা কাজ করে৷
ছবি: Imago/McPHOTO
পরিখা পরিদর্শন
পরিখা নির্মাণ সাধারণ অধিবাসীদের অর্থায়ন ও সহযোগিতায় হয়ে থাকে, তারাই এ নির্মাণকাজের চেয়ারপার্সন ঠিক করেন৷ ঊনবিংশ শতাব্দীতে ঘোড়ায় চড়ে নিয়মিত পরিখা পরিদর্শন করতেন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা৷
ছবি: picture-alliance/kpa
শত বছর আগে পরিখা নির্মাণ
এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, নর্থ ফ্রিজিয়ান ক্লানব্যুলে পরিখা নির্মাণে কাজ করছেন শ্রমিকরা, যদিও তাঁদের চেনা খুবই কষ্টকর৷
ছবি: picture-alliance/arkivi
যখন পানির তোড় আসে
২০১৩ সালের ১০ই জুনের ছবি এটি৷ স্যাক্সনি আনহাল্ট রাজ্যে এলবে নদীর পানি বেড়ে প্লাবিত হয় ফিশবেক গ্রাম৷ যে ভাঙা বাঁধের কারণে গ্রামটি প্লাবিত হয়, সেটা পুনর্নিমাণ শুরু হয় এরপর৷
ছবি: Reuters
কখনো কখনো সেনাবাহিনীর প্রয়োজন হয়
প্রচণ্ড ঝড়ের কারণে সাগরে উত্তাল ঢেউ দেখা দিলে সেনাবাহিনীর সদস্যরা বালির বস্তা নিয়ে কাজে লেগে পড়েন৷ শত শত বালির বস্তা দিয়ে পানি আটকানোর চেষ্টা করেন তাঁরা৷
ছবি: Imago//Seeliger
7 ছবি1 | 7
‘ডেম রিমুভাল ইউরোপের' যুক্তি হচ্ছে বাঁধগুলো তুলে দেয়া হলে প্রকৃতি আবার নিজের মতো করে নিজেকে পুনরুদ্ধারের সুযোগ পাবে৷ তবে, বলা যত সহজ, বাঁধের মতো ব্যয়বহুল কাঠামো তুলে ফেলা ততই কঠিন৷ এধরনের ত্রিশ হাজার কাঠামোকে একই দৃষ্টিতে দেখারও সুযোগ নেই৷ বরং প্রতিটি বাঁধের ক্ষেত্রেই আলাদাভাবে ভাবতে হবে৷
হাইড্রো-এনার্জি-রোথ সংস্থার আন্দ্রেয়াস রোট এই বিষয়ে বলেন, ‘‘প্রতিটি বাঁধ এবং জাঙ্গালের বিষয়ে আলাদা আলাদাভাবে ভাবতে হবে৷ সেক্ষেত্রে সেগুলোর অবস্থান, স্থানীয় কমিউনিটির উপর সেটির প্রভাব এবং মালিকানা কার সেসব বিবেচনা করার পর সেগুলো বদলানো বা তুলে ফেলা যাবে কিনা, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷''
উল্লেখ্য, জার্মানিতে তিনশো বাঁধ রয়েছে যেগুলোর উচ্চতা ১৫ মিটারের বেশি৷ তবে, ছোট ছোট এরকম কাঠামো আরো অনেক রয়েছে, যার সঠিক হিসেব কেন্দ্র সরকারের কাছেও নেই৷ শুধু জার্মানিই নয়, ইউরোপের অনেকে দেশেই ঠিক কতগুলো ছোট-বড় বাঁধ রয়েছে তাঁর সঠিক হিসেব সেসব দেশের সরকারের কাছে নেই৷ অথচ কোনো কোনো বাঁধের বয়স শতবছর পেরিয়ে গেছে৷ ফলে সেগুলোর কোনটি হঠাৎ ভেঙে গেলে বড় দুর্ঘটনার শঙ্কাও রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷
নদীতে সর্বস্বান্ত
বাংলাদেশে প্রতিবছরই নদী ভাঙনে বিলীন হয় হাজার হাজার হেক্টর জমি৷ নদীতে ঘর-বাড়ি, ভিটে-মাটি হারিয়ে গৃহহীন হয় বহু পরিবার৷ সব হারানো এসব মানুষের অনেকেরই ঠাঁই হয় শহরের বস্তিতে, স্বচ্ছল গৃহস্থ থেকে চলে যান তাঁরা মানবেতর জীবনে৷
ছবি: Bdnews24.com
বছরে গৃহহীন লাখো পরিবার
রাষ্ট্রীয় সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস (সিইজিআইএস)-এর তথ্য মতে, প্রতি বছর ভাঙনে নদীতে চলে যায় প্রায় চার হাজার হেক্টর জমি৷ আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় লাখখানেক পরিবার৷ সব কিছু হারিয়ে নানা ধরনের দুর্দশার মুখোমুখি হয় তাঁরা৷
ছবি: bdnews24.com
সর্বনাশা তিন নদী
বাংলাদেশ জুড়ে থাকা কয়েকশ’ নদী-উপনদীতে ভাঙন হলেও সবচেয়ে বেশি ভাঙন-প্রবণ যমুনা, পদ্মা ও মেঘনা৷ স্বাধীনতার পর থেকে নদী ভাঙনে এ দেশের পৌনে দুই লাখ হেক্টরের মতো জমি বিলীন হয়েছে বলে বিভিন্ন সমীক্ষায় উঠে এসেছে৷
ছবি: bdnews24.com
যমুনাই নিয়েছে বেশি
প্রতিবছর বর্ষামৌসুমেই সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় যমুনা নদীর ভাঙনে লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে৷ সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসের তথ্য মতে, এই এক নদীর ভাঙনেই ৯০ হাজার হেক্টরের মতো জমি হারিয়ে গেছে৷
ছবি: Bdnews24.com
পদ্মা নিয়েছে ৬০ হাজার হেক্টর
মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬৭ সাল থেকে প্রমত্ত পদ্মায় বাংলাদেশের ৬০ হাজার হেক্টর (২৫৬ বর্গমাইল)-এর বেশি জমি বিলীন হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
মেঘনায়ও গেছে গ্রামের পর গ্রাম
পদ্মা-যমুনার মতোই ভয়ঙ্কর আগ্রাসী হয়ে ওঠে মেঘনা৷ এ নদীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বরিশাল, চাঁদপুর এলাকার বাসিন্দারা৷ সিইজিআইএসের হিসাবে, ১৯৭৩ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মেঘনার ভাঙনে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে ২৫ হাজার ৮২০ হেক্টর এলাকা৷
ছবি: Bdnews24.com
ভাঙছে নড়িয়া
বর্তমানে শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে নিচ্ছে পদ্মা৷ গত দুই মাসে এই উপজেলার অন্তত দুই বর্গকিলোমিটার এলাকা চলে গেছে নদীগর্ভে৷
ছবি: bdnews24.com
স্কুল-কলেজ হাসপাতালও গেছে
নদী ভাঙনে মানুষের ভিটে-মাটির সঙ্গে এলাকার স্কুল-কলেজ, হাপাতালসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও হারিয়ে গেছে৷ নড়িয়ার আড়াই লাখ মানুষের স্বাস্থ্য সেবার একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছিল ২০১৪ সালে৷ সাম্প্রতিক সময়ে সেই হাসপাতালও গিলতে শুরু করেছে পদ্মা৷ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নতুন ভবনের বেশিরভাগ অংশ ইতোমধ্যে চলে গেছে নদীতে৷
ছবি: Bdnews24.com
শিবিরে আশ্রয়
নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রাথমিক সহায়তায় এগিয়ে আসে সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা৷ পরে এক সময় এসব মানুষকে নিজের পথ বেছে নিতে হয়৷ নড়িয়ায় সব হারানো পরিবারগুলোকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে ৩৯টি সাইক্লোন সেন্টারে৷ খাদ্য সহায়তা হিসেবে চাল ও শুকনা খাবার পাচ্ছেন তাঁরা৷
ছবি: Bdnews24.com
‘সবচেয়ে বড়’ দুর্যোগ
নিয়মিত নদী ভাঙনে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় একে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন অনেকে৷
ছবি: Bdnews24.com
ব্লক, বালুর বস্তায় রক্ষার চেষ্টা
বাংলাদেশের ভাঙন-প্রবণ অধিকাংশ নদীর পাড়ই বাঁধাই করা নয়৷ বর্ষা মৌসুমে পানি বাড়লে ভাঙন শুরু হলে তা ঠেকাতে তৎপর হন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা৷ ব্লক, বালুর বস্তা ফেলে শহর এলাকা রক্ষার চেষ্টা করেন তাঁরা৷
ছবি: bdnews24.com
ক্ষয়ক্ষতি কমানোর উপায়
বাংলাদেশে নদী ভাঙন প্রতিরোধের কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় এর পূর্বাভাস এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া গেলে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা যাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷