মিশর, সুদান ও ইথিওপিয়ার মধ্যে আলোচনায় কোনও ফল হয়নি। তারপরই ইথিওপিয়া নীল নদের শাখানদীর ওপর বাঁধের কাজ আবার শুরু করে দিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
বাঁধের নাম গ্র্যান্ড রেনেসাঁ। জলবিদ্যুৎ তৈরির জন্য নীল নদের শাখা নদী ব্লু নাইলের ওপর এই বাঁধ তৈরি করছে ইথিওপিয়া। আপত্তি জানিয়েছে মিশর ও সুদান। কিন্তু তিন দেশের মধ্যে আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার পর সেই আপত্তিতে কান না দিয়ে বাঁধের কাজ আবার শুরু করে দিয়েছে তারা। আর তাই নিয়ে তিন দেশের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। শুরু হয়েছে প্রতিবাদ।
ইথিওপিয়া বলছে, তাদের ১১ কোটি লোকের দারিদ্র্য ঠেকাতে এই বাঁধ অত্যন্ত জরুরি। এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হয়ে গেলে ইথিওপিয়া হবে আফ্রিকার সব চেয়ে বড় বিদ্যুৎ রপ্তানিকারী দেশ। ইথিওপিয়ার মন্ত্রী সেলেশে বেকেলে জানিয়েছেন, বাঁধেরনির্মাণকাজ এবং জল আটকানোর কাজ পশাপাশি চলবে। জলস্তর এখন ৫২৫ মিটার থেকে ৫৬০ মিটার হয়েছে।
মিশর ইতিমধ্যে ইথিওপিয়ার কাছ থেকে জরুরি ভিত্তিতে ব্যাখ্যা চেয়েছে। বিদেশমন্ত্রী জানিয়েছেন, ব্লু নাইল হলো নীল নদের শাখানদী। এখান থেকেই মিশরের ৯০ শতাংশ জল আসে। জাতি সংঘকেও মিশর জানিয়েছে, ইথিওপিয়া এই বাঁধ বানালে তাদের অস্তিত্ব সংকট দেখা দেবে।
সুদান বলেছে, ইথিওপিয়া বাঁধের কাজ শুরু করার পর ব্লু নাইলে জল দৈনিক ৯ কোটি কিউবিক মিটার কমে গেছে। তাদের দাবি, ইথিওপিয়া একতরফাভাবে এই কাজ করতে পারে না। বিশেষ করে যখন তিন দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। আর জলস্তর দেখে বোঝা যাচ্ছে, ইথিওপিয়া বাঁধের গেট বন্ধ করে দিয়েছে।
পানির নয়, যেন প্লাস্টিকের নদী
বিশ্বের সাগরগুলিতে যে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক গিয়ে পড়ে, তার অধিকাংশই আসে এশিয়ার আটটি ও আফ্রিকার দু’টি নদী থেকে৷ এসব নদীর অপরাপর পরিবেশগত সমস্যাও কম নয়৷
ছবি: Imago/Xinhua/Guo Chen
১) ইয়াংৎসে নদী
ইয়াংৎসে হলো এশিয়ার দীর্ঘতম ও বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম নদী৷ সাগরে প্লাস্টিক বয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও দৃশ্যত ইয়াংৎসে সবার ওপরে – অন্তত সাম্প্রতিক একটি জরিপ তাই বলছে৷ ইয়াংৎসে শাংহাইয়ের কাছে পূর্ব চীন সাগরে গিয়ে পড়ে৷ চীনের অর্থনীতি ও পরিবেশের জন্য এই নদীটির গুরুত্ব অসীম৷ ইয়াংৎসের উপকূলে ৪৮ কোটি মানুষের বাস, যা কিনা চীনের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ৷
ছবি: Imago/VCG
২) সিন্ধু নদ
জার্মানির হেল্মহলৎস পরিবেশ গবেষণা কেন্দ্রের সমীক্ষা অনুযায়ী, সাগরে যে প্লাস্টিক গিয়ে পড়ে, তার ৯০ শতাংশ আসে বিশ্বের ১০টি নদী থেকে৷ সিন্ধু নদ বা ইন্ডাস রিভার তাদের মধ্যে দ্বিতীয়৷ এশিয়ার বৃহত্তম নদীগুলির অন্যতম এই নদ ভারত ও পাকিস্তান হয়ে আরব সাগরে গিয়ে পড়েছে৷ কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা এই নদীর সঙ্গে জড়িত, কিন্তু অবকাঠামো ও পয়ঃনিষ্কাশনের অভাবে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক নদীতে গিয়ে পড়ে৷
ছবি: Asif Hassan/AFP/Getty Images
৩) হোয়াংহো নদী
মাছ-মাংসের ভিতর দিয়ে প্লাস্টিক মানুষের খাদ্যেও পৌঁছাতে পারে৷ চৈনিক সভ্যতার জন্মই নাকি হোয়াংহো নদীর তীরে৷ সেই নদীর কিন্তু প্লাস্টিক ছাড়া আরো অনেক সমস্যা আছে৷ দূষণের ফলে এই নদীর পানি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পানের অযোগ্য হয়ে উঠেছে৷ নদীতে বিভিন্ন মাছের প্রজাতির প্রায় ৩০ শতাংশ ইতিমধ্যেই লোপ পেয়েছে বলে গবেষকদের ধারণা৷
ছবি: Teh Eng Koon/AFP/Getty Images
৪) হাই নদী
এই নদীটি চীনের দু’টি সর্বাপেক্ষা জনবহুল শহুরে এলাকা তিয়ানজিন ও বেইজিংয়ের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে, তারপর বোহাই সাগরে গিয়ে পড়ে, যা কিনা বিশ্বের সবচেয়ে ঘন জাহাজ চলাচল এলাকাগুলির অন্যতম৷ তালিকার ১০টি নদীর সব ক’টির ক্ষেত্রেই কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়: তীরে ঘনবসতি, সেই সঙ্গে বর্জ্য অপসারণের অবকাঠামো ও রিসাইক্লিং চেতনার অভাব৷
ছবি: Imago/Zumapress/Feng Jun
৫) নীল নদ
নীল নদ ১১টি দেশের মধ্যে দিয়ে বয়ে শেষমেষ মিশরে ভূমধ্যসাগরে গিয়ে পড়ে৷ নদীর অববাহিকায় প্রায় ৩৬ কোটি মানুষের বাস৷ নীল নদের পানি সেচের কাজেও ব্যবহার করা হয়, কেননা, কৃষিকাজ এই এলাকার মূল উপজীব্য৷ সেচ ও গ্রীষ্মের খর তাপমাত্রার কারণে নদীর পানি মাঝে মধ্যে সাগর অবধি পৌঁছায় না৷ তবুও প্লাস্টিক বহন করার ক্ষেত্রে নীল নদ পঞ্চম স্থানে৷
ছবি: Imago/Zumapress
৬) গঙ্গা নদী
ভারতের ৫০ কোটি মানুষের কাছে গঙ্গা নদী ধর্মজীবন ও দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ৷ পয়ঃ বর্জ্য, কৃষি ও শিল্প-কারখানার বর্জ্যের ফলে গঙ্গা নদী বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নদীগুলির মধ্যে একটি হয়ে উঠেছে৷ সেই সঙ্গে টন টন প্লাস্টিক এই নদীতে গিয়ে পড়েছে৷ কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে পানি থেকে প্লাস্টিক সরিয়ে সমস্যার সমাধান করা যাবে না, প্লাস্টিকের ব্যবহার ও প্লাস্টিক বর্জ্যের উৎপাদন কমাতে হবে৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. Kanojia
৭) পার্ল রিভার
চীনের পার্ল রিভার বা মুক্তা নদী দূষণের জন্য সুবিদিত৷ এই নদী হংকং আর ম্যাকাওয়ের মধ্যে দক্ষিণ চীন সাগরে গিয়ে পড়ে৷ এলাকাটির অবিশ্বাস্য নগরায়ণের ফলে বিপুল পরিমাণ পয়ঃনিষ্কাশন ও শিল্প বর্জ্য পার্ল নদীর ব-দ্বীপে গিয়ে পড়ে৷ প্রধানত কৃষি এলাকাটি সত্তরের দশক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম নাগরিক এলাকাগুলির মধ্যে একটিতে পরিণত হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/Goh Chai Hin
৮) আমুর নদ/হাইলং নদী
নগর ও শিল্পাঞ্চলে পৌঁছানোর পরেই নদীতে প্লাস্টিক বাড়ে৷ কিন্তু বর্তমানে প্রত্যন্ত ও প্রকৃতি প্রধান অঞ্চলেও নদীতে প্লাস্টিক দেখা দিতে শুরু করেছে৷ আমুর নদের উৎস উত্তর-পূর্ব চীনের পর্বতাঞ্চলে৷ পরে এই নদ চীনের হাইলংজিয়াং প্রদেশ ও রাশিয়ার সাইবেরিয়ার মধ্যে সীমান্ত নদী হিসেবে কাজ করার পর ওখোটস্ক সাগরে গিয়ে পড়ে৷
ছবি: picture-alliance/Zumapress/Chu Fuchao
৯) নাইজার নদী
পশ্চিম আফ্রিকার মুখ্য নদী নাইজার যে শুধু ১০ কোটি মানুষের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য, তাই নয়, এই নদীর দু’কূলে প্রকৃতি তার আদিম প্রাচুর্য আজও বজায় রেখেছে৷ নাইজার নদী পাঁচটি দেশের ভিতর দিয়ে বয়ে শেষে নাইজেরিয়ায় অতলান্তিক মহাসাগরে গিয়ে পড়ে৷ প্লাস্টিক দূষণ ছাড়াও বিভিন্ন বাঁধ প্রকল্পের ফলে নদীর জল কমেছে৷ সেই সঙ্গে রয়েছে নাইজারের ব-দ্বীপে খনিজ তেল শিল্প, যা থেকে একাধিক বার তেল বেরিয়ে নদী দূষিত করেছে৷
ছবি: Getty Images
১০) মেকং নদী
মেকং নদীতেও একাধিক বাঁধ প্রকল্পের ফলে পরিবেশগত ও সামাজিক সমস্যা দেখা দিয়েছে৷ মেকং নদীর বদ্বীপে প্রায় দু’কোটি মানুষের বাস৷ তাঁদের অনেকেই পেশায় ধীবর বা কৃষিজীবী৷ নদীটি ভিয়েতনাম ও লাওসসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ছয়টি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়৷ প্রতিবছর বিশ্বের নদীগুলো থেকে মোট ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক সাগরে গিয়ে পড়ে, যার অধিকাংশই আসে মেকং ও তালিকার অন্যান্য নদীগুলি থেকে৷
ছবি: Imago/Xinhua
10 ছবি1 | 10
মিশরও বলছে, তারা পুরোপুরি নীল নদের জলের ওপর নির্ভরশীল এবং জল যেহেতু কমছে, তাই ১০ কোটি লোকের জীবনের ওপর বিশাল প্রভাব পড়বে। গত মাসেই মিশরের বিদেশমন্ত্রী বলেছিলেন, জতি সংঘ হস্তক্ষেপ না করলে সংঘাত অনিবার্য। বাঁধ হলে মিশর ও সুদান মিলিয়ে ১৫ কোটি লোকের জীবন বিপন্নহয়ে যাবে। তাই এই বাঁধ তারা মানবে না।
গবেষক আহমেদ সোলেমান বলেছেন, মিশরে ইতিমধ্যেই জলের অভাব দেখা দিয়েছে। যতটা প্রয়োজন, তার তুলনায় জল কম পাওয়া যাচ্ছে। যত দিন যাবে তত সমস্যা বাড়বে।
মিশরের দাবি, ১৯৫৯ সালের জলচুক্তি মেনে চলতে হবে। সেই চুক্তিতে নীল নদের জলের সব চেয়ে বেশি অংশ মিশরকে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ইথিওপিয়া সেই চুক্তির শরিক ছিল না। ইথিওপিয়া দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসতে চেয়েছে। কিন্তু মিশর ১৯৫৯ এর চুক্তি থেকে সরে আসতে রাজি নয়। ইথিওপিয়ার লোক এই বাঁধ বানাবার পক্ষে। তাঁদের দাবি, এটা তাঁদের অধিকার। কারণ, তাঁরা নিজের দেশে বাঁধ তৈরি করছেন।
এই অবস্থায় মিশর চাইছে, জলবন্টন নিয়ে আইনত ব্যবস্থা হোক। ব্লু নাইলের নাব্যতা বজায় রাখার ব্যবস্থা হোক। বাঁধ তৈরি শেষ হওয়া এবং জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র কাজ শুরু করার আগেই জলবন্টন চুক্তি করতে হবে।
এমনিতে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে সুদানের লাভ। তারা কম দামে বিদ্যুৎ পাবে। কিন্তু তাদের চিন্তা জল পাওয়া নিয়ে। মঙ্গলবার তিন দেশের মধ্যে আলোচনা শেষ হয়েছে এবং সেখানে কোনো মতৈক্য হয়নি। ফলে বিরোধ কীভাবে মিটবে তার কোনো সঙ্কেত পাওয়া যাচ্ছে না।