ইউরোপীয়দের নিন্দার জবাবে বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী এখনই মৃত্যুদণ্ড বাতিল করা হবে না বলে জানিয়েছেন৷ তবে ভবিষ্যতে সরকার সেটি বিবেচনা করতে পারে বলেও আভাস দিয়েছেন তিনি৷ এই বক্তব্য পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেন গ্রেহেম লুকাস৷
বিজ্ঞাপন
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সফররত ইউরোপীয় পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে বৈঠকের পর, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এ সব মন্তব্য করেন৷ ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাংসদরা মৃত্যুদণ্ড বন্ধের আহ্বান জানালে আইনমন্ত্রী তাঁদের এখনই আইনে পরিবর্তন আনা হবে না বলে জানান৷ এর মানে হচ্ছে, ইউরোপ থেকে যাওয়া অতিথিদের মুখে ঠান্ডা মাথায় হিসাব কষে চড় দেয়া, আর এটাও পরিষ্কার করে দেয়া যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে ইসলামি নেতাদের বিচার চালিয়ে যেতে চান৷ আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্থাপন ও পরিচালনার রাজনৈতিক প্রভাব আর পুনর্বিবেচনা করে দেখতে চায় না সরকার৷
সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা দেশের তালিকা
২০১৩ সালে মোট ২২টি দেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় বলে জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷ ছবিঘরে থাকছে সেসব কথা৷
ছবি: Fotolia/lafota
চীন
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, চীনে প্রতিবছর কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷ তবে ব্যাপারটিকে যেহেতু চীনে রাষ্ট্রীয় গোপনীয় বিষয় হিসেবে দেখা হয় তাই অ্যামনেস্টির পক্ষে নির্দিষ্ট সংখ্যা জানানো সম্ভব হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ইরান
তিনভাবে ইরানে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় – গুলি করে, পাথর ছুড়ে আর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে৷ ২০১৩ সালে এভাবে কমপক্ষে ৩৬৯ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে৷ সামান্য অভিযোগে সাংবাদিক সহ মানবাধিকার কর্মীদের মৃত্যুদণ্ড দিয়ে মাঝেমধ্যেই সমালোচনার মুখে পড়ে দেশটি৷
ছবি: ISNA
ইরাক
সাদ্দাম হুসেনের আমলে ইরাকে বেশি সংখ্যায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘটনা ঘটতো৷ ২০১৩ সালে ১৬৯ জনের বেশি বন্দিকে এই শাস্তি পেতে হয়েছে বলে জানিয়েছে অ্যামনেস্টি৷ এর মধ্যে বেশিরভাগই ছিল সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী৷
ছবি: picture alliance/dpa
সৌদি আরব
২০১৩ সালে ১৮ বছরের কম বয়সি তিনজন সহ কমপক্ষে ৭৯ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে সৌদি আরব৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Abir Abdullah
যুক্তরাষ্ট্র
ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে বিষ ঢুকিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যদণ্ড কার্যকর করা হয়৷ এভাবে ২০১৩ সালে ৩৯ জনকে শাস্তি দেয়া হয়৷ অবশ্য সে বছর কমপক্ষে ৮০ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যদণ্ডের রায় দেয়া হয়৷
ছবি: CHANTAL VALERY/AFP/Getty Images
বাংলাদেশ ১৮ নম্বরে
সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা দেশের তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে আছে সোমালিয়ার নাম৷ ২০১৩ সালে সেদেশে ৩৪ জনের বেশি বন্দির প্রাণ নেয়া হয়৷ তালিকায় বাংলাদেশের নাম রয়েছে ১৮ নম্বরে৷ অ্যামনেস্টির হিসেবে ঐ বছর বাংলাদেশে দু’জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
6 ছবি1 | 6
এই ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত৷ বিবাদী পক্ষের আইনজীবীদের কার্যক্রম চালাতে বাধা দেয়া হয়েছে, বিবাদী পক্ষের কয়েকজন সাক্ষীকে সাক্ষ্য দিতে দেয়া হয়নি এবং বাদী পক্ষের কয়েকজন সাক্ষীর সাক্ষ্য ছিল হাস্যকর ও জনশ্রুতির উপর ভিত্তি করে করা৷ জনশ্রুতির বিষয়টিতে অবশ্য আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, কেননা অপরাধ সংঘটন ও বিচার চলার মধ্যে অনেক সময় চলে গেছে৷ ট্রাইব্যুনাল যে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে পরিচালিত হচ্ছে না সেটি স্পষ্ট৷ তবুও বাংলাদেশ সরকারের বিরোধী পক্ষে থাকা ইসলামি নেতাদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হচ্ছে৷
বিভিন্ন দেশে যেভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়
মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য একেক দেশ একেক রকম পদ্ধতি ব্যবহার করে৷ ছবিঘরে থাকছে তেমন কয়েকটি উপায়ের কথা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ইনজেকশন
অ্যানেস্থেশিয়ার জন্য সোডিয়াম পেন্টোনাল, সম্পূর্ণ অক্ষম করার জন্য প্যানকিউরোনিয়াম ব্রোমাইড আর হৃদযন্ত্র থামিয়ে দেয়ার জন্য পটাশিয়াম ক্লোরাইড নামের তিনটি রাসায়নিক উপাদান ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে ঢুকিয়ে অনেক দেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷ যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভিয়েতনামে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়৷
ছবি: BilderBox
গুলি
ইন্দোনেশিয়া, চীন, সৌদি আরব, তাইওয়ান, উত্তর কোরিয়া সহ কয়েকটি দেশে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷ এক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির চোখ কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে তাকে বসিয়ে বা দাঁড় করিয়ে রাখা হয়৷ এরপর সামরিক বা নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য একের পর এক গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন৷
ছবি: Fotolia/Scanrail
বৈদ্যুতিক চেয়ারে বসিয়ে
অভিযুক্তকে কাঠের চেয়ারে বসিয়ে তার মাথা ও পায়ের মাধ্যমে শরীরে ৫০০ থেকে ২,০০০ ভোল্ট বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হয়৷ প্রতিবার ৩০ সেকেন্ড করে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কয়েকবার এভাবে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হয়৷ এই পদ্ধতিটা যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফাঁসি
বাংলাদেশ সহ আফগানিস্তান, ভারত, ইরান, ইরাক, জাপান, মালয়েশিয়া ও কুয়েতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রচলন রয়েছে৷
ছবি: vkara - Fotolia.com
শিরশ্ছেদ
কয়েক হাজার বছর ধরেই শিরশ্ছেদ বিষয়টি রয়েছে৷ তবে বর্তমানে শুধু সৌদি আরবে এই পদ্ধতিটি চালু রয়েছে৷ সাধারণত শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর মসজিদ প্রাঙ্গনে শিরশ্ছেদ করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Abir Abdullah
অন্যান্য উপায়
পাথর ছুড়ে মারা, গ্যাস চেম্বারে ফেলে দেয়া, অনেক উঁচু থেকে অভিযুক্তকে নীচে ফেলে দেয়ার মাধ্যমেও কোথাও কোথাও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
6 ছবি1 | 6
মৃত্যুদণ্ডের রায় অপরিবর্তনীয়৷ এই রায় যখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দেয়া হয় তখন সেটা শহিদের জন্ম দেয় এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করে৷ শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড জনপ্রিয় হলেও এর ধারাবাহিক ব্যবহার যে ইসলামি জঙ্গির প্রসার ঘটাচ্ছে তাতে সন্দেহ নেই৷ মার্কিন ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জেমস ক্ল্যাপার সম্প্রতি সতর্ক করে দিয়েছেন এই বলে যে, হাসিনা সরকারের বিরোধীদের দুর্বল করার ধারাবাহিক চেষ্টা ইসলামি সন্ত্রাসবাদের উত্থান ঘটাবে৷ তিনি ঠিকই বলেছেন৷ ইসলামি সন্ত্রাসীরা যে ২০১৩ সাল থেকে ১১ জন প্রগতিশীল লেখক ও ব্লগার হত্যার দায় স্বীকার করেছে সে বিষয়টিও উল্লেখ করেন ক্ল্যাপার৷ তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে তথাকথিত ‘ইসলামিক স্টেট' বা আইএস-এর অস্তিত্বের বিষয়টি স্বীকার করতে রাজি নন৷
১৯৭১ অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটানোর বাংলাদেশের যে ইচ্ছা তা যেমন বোধগম্য তেমনি মর্যাদার৷ তবে মুসলিম অধ্যুষিত এই দেশটি যারা ধর্মনিরপেক্ষতাকে সমর্থন করে আর যারা ইসলামের ভূমিকাকে বড় করতে দেখতে চায় তাদের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের পথ থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে৷ তাই আরও ক্ষতি হয়ে যাওয়ার আগে মৃত্যুদণ্ড বন্ধে রাজনৈতিক পরিসরে আলোচনা শুরুর প্রয়োজনীয়তা এখন আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে৷
বন্ধু, বাংলাদেশে কি মৃত্যদণ্ড বন্ধ করে দেয়া উচিত? আপনার কী মনে হয়? জানান নীচের ঘরে৷
মৃত্যুদণ্ড বাতিল করেছে যেসব দেশ
বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক দেশে এখনও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর রয়েছে৷ তবে চলতি শতকে কয়েকটি দেশ এই শাস্তি প্রথা বাতিল করেছে৷