তথাকথিত জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে দুই ব্যক্তি ও বাংলাদেশি একটি গ্রুপসহ সাতটি সংগঠনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র৷ যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ এই নিষেধাজ্ঞা দেয়৷
বিজ্ঞাপন
ট্রেজারি বিভাগের ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোল বিভাগ বা ওএফএসি-র ওয়েবসাইটে নিষিদ্ধ ব্যক্তির তালিকায় নাইজেরিয়ার নাগরিক আবু মুসাব আল-বার্নাবি এবং সোমালিয়ার মাহাদ মোয়ালিমের নাম যুক্ত করা হয়েছে৷ পাশাপাশি বাংলাদেশ, মিশর, ফিলিপাইন্স, সোমালিয়া, নাইজেরিয়া ও টিউনিশিয়ার সাতটি জঙ্গি সংগঠনকে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় আনার কথা বলা হয়েছে৷
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর আলাদা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা তথাকথিত জঙ্গি সংঘটন আইএস-এর নতুন ৪০ জন ব্যক্তি, সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, যারা ২০১১ সাল থেকে আইএস-এর হয়ে কাজ করছে৷ এতে বলা হয়েছে, ‘‘এদের নিষিদ্ধ করা হলে আইএস-এর ‘নিরাপদ স্বর্গ' নষ্ট হয়ে যাবে, অর্থাৎ তাদের অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বিদেশি যোদ্ধাদের তারা নিয়োগ দিতে ব্যর্থ হবে৷ ফলে ইরাক ও সিরিয়ায় তাদের আধিপত্য খর্ব হবে, সেখানে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে এবং গৃহহীন মানুষরা নিজের দেশে ফিরে যেতে পারবে৷''
আইএস কী, কোথায় এবং কেন?
প্রতিদিনই খবরে আইএস৷ কোনোদিন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য, কোনোদিন হয়তো ইরাক বা সিরিয়ায় কোনো অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য৷ আইএস বলছে, ইসলামি খেলাফত কায়েম করার জন্য যুদ্ধে নেমেছে তারা৷ ছবিঘরে আইএস সম্পর্কে কিছু তথ্য....
ইসলামিক স্টেট বা আইএস আসলে কী?
আল কায়েদা থেকে তৈরি হওয়া সুন্নি মুসলমানদের জঙ্গি সংগঠন আইএস৷ সাদ্দাম পরবর্তী সময়ে ইরাকে এবং বাশার আল আসাদের আমলে সিরিয়ায় সুন্নিদের হতাশা থেকেই জন্ম সংগঠনটির৷ আইএস-এর পতাকায় লেখা থাকে, ‘মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর নবী’ এবং ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই৷’
ছবি: AP
আইএস কোথায় সক্রিয়?
শরিয়া আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে এমন রাষ্ট্র, বা ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায় আইএস৷ সিরিয়া এবং ইরাকেই প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় তারা৷ দুটি দেশেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগে বেশ বড় অঞ্চল দখল করে নিয়েছে আইএস৷
আইএস কেন আলাদা?
মূলত নিষ্ঠুরতার জন্য৷ শত্রুপক্ষ এবং নিরীহ মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়াতে তারা এমন বর্বরতা এবং নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করে যা আগে কেউ করেনি৷ জবাই করে ভিডিও প্রচার, পুড়িয়ে মারা, বাবার সামনে মেয়েকে জবাই করা এবং তার তার ভিডিও প্রচার, মেয়েদের যৌনদাসী বানানো আর পণ্যের মতো বিক্রি করা – এসব নিয়মিতভাবেই করছে আইএস৷ কোনো অঞ্চল দখলে নেয়ার পর সেখানে শাসন প্রতিষ্ঠায় মন দেয় আইএস৷
ছবি: gebphotography - Fotolia.com
অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক
আইএস যদিও শুধু সিরিয়া এবং ইরাকেই সক্রিয়, তবে বিশ্বের অন্যান্য ইসলামি জঙ্গি সংগঠনগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন নয়৷ নাইজেরিয়ার জঙ্গি সংগঠন বোকো হারাম কয়েকদিন আগেই জানিয়েছে, আইএস-কে তারা সমর্থন করে৷ দুটি সংগঠনের মধ্যে একটি জায়গায় মিলও আছে৷ আইএস-এর মতো বোকো হারামও নিষ্ঠুরতা এবং বর্বরতার প্রতিভূ হয়ে উঠেছে৷ অন্য ধর্মের নারীদের প্রতি দুটি সংগঠনের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণই মধ্যযুগীয়৷
ছবি: Getty Images/A. Katib
আইএস-এর অনুসারী কারা?
অনুসারী সংগ্রহের সাফল্যেও আইএস অন্য সব জঙ্গি সংগঠনের চেয়ে আলাদা৷ এ পর্যন্ত অন্তত ২০ হাজার বিদেশী যোদ্ধা আইএস-এ যোগ দিয়েছে৷ তাদের মধ্যে ৪ হাজারই পশ্চিম ইউরোপ এবং উত্তর অ্যামেরিকার৷
আইএস-কে রুখতে অন্য দেশগুলো কী করছে?
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বেশ কিছু পশ্চিমা এবং আরব দেশ সিরিয়া ও ইরাকে আইএস ঘাঁটির ওপর বিমান থেকে বোমা হামলা চালাচ্ছে৷ বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ পর্যন্ত সিরিয়ায় ১৪২২ এবং ইরাকে ২২৪২ বার হামলা হয়েছে৷ কোনো কোনো সরকার দেশের অভ্যন্তরেও কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছে৷ সিরিয়া ফেরত অন্তত ৩০ জন সন্দেহভাজন জঙ্গির বিচার শুরু করবে জার্মানি৷ গত মাসে সৌদি পুলিশও ৯৩ জন সন্দেহভাজন আইএস জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে৷
6 ছবি1 | 6
বাংলাদেশ ছাড়া আইএসআইএস-ইজিপ্ট, আইএসআইএস-ফিলিপাইন্স, আইএসআইএস-সোমালিয়া, আইএসআইএস-ওয়েস্ট আফ্রিকা, জুন্দ আল-খলিফা-টিউনিশিয়া (আইএসআইএস-টিউনিশিয়া) এবং ফিলিপিন্সভিত্তিক মাউতি গ্রুপকে ঐ তালিকায় যুক্ত করেছে ইউএস ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট৷
বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে বিভিন্ন জঙ্গি হামলা ও হত্যার দায় স্বীকার করে আইএস-এর পক্ষ থেকে বার্তা পাঠানো হলেও সরকার ও পুলিশ সবসময়ই সে দাবি নাকচ করে আসছে৷
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডেরপর মুক্তমনা লেখক, ব্লগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও ভিন্ন মতাবলম্বীরা সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন৷ সে বছরের ২৮শে সেপ্টেম্বর গুলশানে এক ইটালীয় এনজিওকর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ এর পাঁচ দিনের মাথায় রংপুরের এক গ্রামে একই কায়দায় খুন হন জাপানি নাগরিক হোশি কোনিও৷ দু'টি ঘটনার পরই আইএস (ইসলামিক স্টেট) হত্যার দায় স্বীকার করে বলে খবর দেয় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জঙ্গি তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ‘সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ'৷
এই ঘটনার তদন্তে গিয়ে পুলিশ সন্দেভাজন হামলার হোতাদের চিহ্নিত করার পর বলেছিল, তারা বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গি গোষ্ঠীজামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ-জেএমবির নতুন সংস্করণ ‘নব্য জেএমবি'৷
এপিবি/ডিজি (রয়টার্স)
কোথা থেকে অর্থ পাচ্ছে আইএস?
পেট্রোলিয়াম বিক্রি থেকে শুরু করে ব্যাংক ডাকাতি, অধিকৃত এলাকায় কর চাপানো এবং প্রাচীন সামগ্রী বিক্রি করে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট প্রায় ২০০ কোটি ডলার একত্র করেছে৷ তাতে তাদের আরও ২ বছর চলে যাবার কথা৷
ছবি: picture alliance/abaca
বেআইনি তেল বিক্রি
বেআইনি ভাবে পেট্রোলিয়াম বিক্রি আইএস-এর আয়ের প্রধান উৎস৷ সিরিয়া ও ইরাকে বেশ কিছু বড় তৈলকূপ আপাতত তাদের দখলে৷ মূলত তুরস্কের মধ্য দিয়েই তারা চোরাচালানের কাজ চালিয়ে থাকে৷ মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতে, কালোবাজারে তেল বিক্রি করে আইএস-এর মাসে প্রায় ৪ কোটি ডলার আয় হয়৷
ছবি: Getty Images/J. Moore
ব্যাংক ডাকাতি
সিরিয়া ও ইরাকে কোনো এলাকা দখলের পর আইএস সবার আগে ব্যাংকগুলি কবজা করে ফেলে৷ মার্কিন প্রশাসনের ধারণা, এভাবে তারা ৫০ থেকে ১০০ কোটি ডলার আত্মসাৎ করেছে৷ শুধু মোসুল শহর দখল করেই তারা নাকি ৬২ কোটি ডলার লুট করেছিল৷ বছরে প্রায় ৫০,০০০ জিহাদি কর্মীর বেতন দিতে এই অর্থ যথেষ্ট৷
ছবি: Getty Images/S. Platt
কর আদায় ও চাঁদাবাজি
আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকার প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষকে ৫ থেকে ১৩ শতাংশ আয়কর দিতে হয়৷ জার্মান সরকারের সূত্র অনুযায়ী, আইএস অ-মুসলিমদের কাছ থেকে জিজিয়া করও আদায় করে৷ তাছাড়া চাঁদাবাজিও তাদের আয়ের আরেকটি উৎস৷
ছবি: DW/Andreas Stahl
প্রাচীন সামগ্রী বিক্রি
‘জিহাদিরা’ আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ ধ্বংস করতে অভ্যস্ত৷ তবে বেশি দামি অ্যান্টিক সম্পদ সযত্নে সরিয়ে ফেলে কালোবাজারে বিক্রি করে তারা৷ প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছ থেকেও অমূল্য সম্পদ কেড়ে নিয়ে বিক্রি করতে পিছপা হয় না এই গোষ্ঠী৷ তবে বিক্রিমূল্যের সঠিক অঙ্ক জানা নেই৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eid
মুক্তিপণ ও প্রচারণা
মানুষজনকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় আইএস-এর দু-মুখী চাল৷ একদিকে এটা আয়ের একটা উৎস, অন্যদিকে এর মাধ্যমে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রচারণার কাজও হয়ে যায়৷ কিছু ‘মূল্যবান’ জিম্মির শিরশ্ছেদ করে সেই ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়ে প্রচারণার ক্ষেত্রে বিপুল সাফল্য পায় আইএস৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
সহানুভূতি দেখাতে চাঁদা
আইএস-এর প্রতি সহানুভূতিপ্রবণ মানুষ গোটা বিশ্বেই ছড়িয়ে রয়েছে৷ তারা এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তহবিলে আর্থিক অবদান রাখে৷ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সূত্র অনুযায়ী সৌদি আরবে ২০১০ সাল থেকে ৮৬০ জন ব্যক্তিকে সন্ত্রাসের কাজে আর্থিক সাহায্য দেবার অভিযোগে শাস্তি দেওয়া হয়েছে৷ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ সেখানে ১০০ জনের শাস্তি হয়েছে৷