বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের খবর ভারতীয় গণমাধ্যমে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে৷ নাগরিকপঞ্জি নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগ উপেক্ষা করা একেবারেই ঠিক হবে না বলে এক সম্পাদকীয়তে লিখেছে ‘দ্য হিন্দু'৷
বিজ্ঞাপন
‘বেস্ট ফ্রেন্ডস ফর নাও: অন নিউ দিল্লি-ঢাকা টাইজ' শীর্ষক এই সম্পাদকীয়তে তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে এখনও কোনো অগ্রগতি না হওয়াকে ব্যর্থতা হিসেবে দেখানো হয়েছে৷ এজন্য পশ্চিমবঙ্গ ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে উত্তেজনাকে দায়ী করা হয়েছে৷ নাগরিকপঞ্জি সম্পর্কে দ্য হিন্দু লিখেছে, নতুন দিল্লি ও নিউইয়র্কে বৈঠকের সময় বাংলাদেশ নাগরিকপঞ্জি নিয়ে যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, সে বিষয়টিও ভারতীয় সরকারের উপেক্ষা করা একেবারেই ঠিক হবে না৷
এদিকে কলকাতার প্রভাবশালী আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে নরেন্দ্র মোদী ও শেখ হাসিনা তাঁদের নতুন ইনিংসে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার এক নতুন অধ্যায় শুরু করলেন৷
‘সাত চুক্তি সই করল ঢাকা-দিল্লি' শিরোনামের খবরে পত্রিকাটি কূটনীতিকদের বরাত দিয়ে লিখেছে, ভারত গত পাঁচ বছরে ধারাবাহিকভাবে একটি মাত্র প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক ধরে রেখেছে, সেটা বাংলাদেশ৷
স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোর মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি পাওয়ার বিষয়টি সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দিতে চাইছে বলে জানিয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা৷ গুরুত্বের দিক দিয়ে এরপরেই আছে ফেনি নদীর চুক্তি৷ এর ফলে ত্রিপুরার সাব্রুম মহকুমার মানুষ আর্সেনিক-দুষ্ট পানীয় জলের পরিবর্তে বাংলাদেশের ফেনি নদীর জল পান করতে পারবেন বলে পত্রিকা বলছে৷
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ইতিবৃত্ত
ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন? এক কথায় তার মূল্যায়ন কঠিন৷ বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশী দেশটির সম্পর্ক মধুর যেমন বলা চলে, তেমনি আবার কিছু তিক্ততাও আছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A.M. Ahad
বিপদের বন্ধু
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অকৃত্রিম বন্ধুর ভূমিকায় ছিল ভারত৷ ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি তাঁর সরকারের পূর্ণ সমর্থন দেন৷ পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতে বাঙ্গালীদের জন্য খুলে দেয়া হয় দেশটির সীমান্ত৷ নভেম্বরে গঠন হয় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ড, যার পথ ধরে আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা৷
ছবি: Getty Images/AFP/
মৈত্রী চুক্তি
দুই দেশের শান্তি ও পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী৷ আঞ্চলিক অখণ্ডতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার মোট ১২ টি ধারা ছিল এতে৷ ১৯৯৭ সালের ১৯ মার্চ মেয়াদ শেষ হওয়ার পর চুক্তিটি আর নবায়ন হয়নি৷
ছবি: Getty Images/G. Crouch
বন্ধনে সংস্কৃতি
ভারতের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে অবিচ্ছেদ্য এক সাংস্কৃতিক সম্পর্ক৷ এক সময় পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশ ছিল একই অঞ্চল৷ দুই বাংলার মানুষের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিতেও আছে মিল৷ আছে পারস্পরিক যোগাযোগ৷ দুই দেশের মধ্যে সরকারিভাবে সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তিও রয়েছে৷
ছবি: Getty Images
যোগাযোগে মৈত্রী
ভারতের সাথে বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু আছে বহুদিন থেকে৷ কলকাতা-ঢাকা, শিলং-ঢাকা এবং ঢাকা হয়ে আগরতলা-কলকাতা নিয়মিত বাস যাতায়াত করে৷ ৬টি রেল লাইন ছাড়াও দু’টি ব্রডগেজ রেল সংযোগ আছে দুই দেশের মধ্যে৷ কলকাতা ও ঢাকার মধ্যে 'মৈত্রী এক্সপ্রেস' চলে সপ্তাহে চারদিন৷ ২০১৭ সালে চালু হয়েছে খুলনা-কলকাতা ‘বন্ধন এক্সপ্রেস’৷ এছাড়া বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি রেলযোগাযোগ চালুর কাজও চলছে৷
ছবি: DW/P. Mani
ভারসাম্যহীন বাণিজ্য
দুই দেশের বাণিজ্যের আকার ৯১৪ কোটি ডলার৷ ২০১৭-১৮ অথর্বছরে ভারত থেকে ৮৪৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ আর রপ্তানি করেছে মাত্র ৬৮ কোটি ডলারের পণ্য৷ রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশিরভাগ পণ্যে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা পেলেও ভারতের বিরুদ্ধে অশুল্ক বা শুল্কবহির্ভূত বাধা তৈরির অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Dutta
বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ
২০১৭ সালে বাংলাদেশে ভারতের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৫১ কোটি ডলার৷ টেলিযোগাযোগ, ঔষধ, অটোমোবাইলসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে দেশটির প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা আছে৷ এছাড়া ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের সময় ভারতের সঙ্গে ১০ বিলিয়ন ডলারের ১৩টি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. U. Ekpei
বিদ্যুৎ আমদানি
বর্তমানে ভারতের ত্রিপুরা থেকে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ৷ ভারতের জাতীয় তাপবিদ্যুৎ কর্পোরেশন (এনটিপিসি) ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)-র অংশীদারিত্বে রামপালে নির্মিত হচ্ছে বিতর্কিত কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র৷ এছাড়াও ২০১৭ সালের এপ্রিলে শেখ হাসিনার দিল্লি সফরকালে দুই দেশের মধ্যে ৩৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন, সরবরাহ ও অর্থায়ন সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. Malukas
জ্বালানি সহযোগিতা
বাংলাদেশে যেসব দেশের প্রতিষ্ঠান পরিশোধিত তেল সরবরাহ করে তার একটি ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড৷ সেখান থেকে ডিজেল আমদানির জন্য শিলিগুড়ি থেকে পার্বতীপুর পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে দুই দেশের সরকার৷ ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভিডিও কনফারেন্সে এর উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী৷
ছবি: Reuters/E. Gaillard
সমুদ্র বিরোধের নিষ্পত্তি
বঙ্গোপসাগরে ২৫,৬০২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিরোধ ছিল৷ তার মধ্যে ২০১৪ সালের জুলাই মাসে নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী সালিশি আদালতের রায়ে ১৯,৪৬৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকা পেয়েছে বাংলাদেশ৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/Str
ছিটমহল বিনিময়
২০১৫ সালের জুলাইতে দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়ন হয়৷ ভারতের ১১১টি ছিটমহল যুক্ত হয় বাংলাদেশের সাথে আর সেখানকার বাসিন্দারা পায় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব৷ একইভাবে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলও লীন হয়ে যায় দেশটির সাথে৷
ছবি: AFP/Getty Images
প্রাণঘাতী সীমান্ত
দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও সীমান্তে দেশটির আচরণে তার প্রতিফলন নেই৷ গত ১০ বছরে ২৯৪ বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ৷ সীমান্ত পারাপারে অস্ত্র ব্যবহার করবে না দুই দেশ, ২০১১ সালে বিজিবি-বিএসএফ পর্যায়ে এমন চুক্তি হলেও বন্ধ হয়নি সীমান্ত হত্যা৷
ছবি: AP
ফারাক্কা বাঁধ
গঙ্গা নদীতে বাংলাদেশ সীমান্তের ১৮ মাইল উজানে ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করে ভারত৷ ১৯৬১ সালে শুরু হয়ে কাজ শেষ হয় ১৯৭৫ সালে৷ শুস্ক মৌসুমে বাঁধের গেট বন্ধ রেখে বাংলাদেশে পানি প্রবাহে বাধা তৈরি করে ভারত৷ অন্যদিকে বর্ষায় খুলে দেয়া হয় সবগুলো গেট, যার ফলে উত্তরাঞ্চলে দেখা দেয় বন্যা৷
তিস্তা চুক্তি
১৯৮৭ সালের পর থেকে তিস্তার পানি নিয়ে ভারতের সাথে কোনো চুক্তি নেই বাংলাদেশের৷ একতরফাভাবে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে দেশটি৷ ফলে বাংলাদেশ অববাহিকায় পানিসংকট চলছে৷ ২০১১ সালের ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর ঢাকা সফরে এই বিষয়ে চুক্তি সই হওয়ার কথা থাকলেও এখনো তা হয়নি৷
ছবি: DW/A. Chatterjee
রোহিঙ্গায় পাশে নেই
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে নেই প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি৷ শুরু থেকেই এ বিষয়ে মিয়ানমারের অবস্থানকেই বরং সমর্থন জানিয়ে আসছে দিল্লি৷ এমনকি সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের (ইউএনএইচআরসি) অধিবেশনে রোহিঙ্গাদের নিয়ে এক ভোটাভুটিতেও বাংলাদেশের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে দেশটি৷
ছবি: Getty Images/P. Bronstein
নতুন জটিলতা এনআরসি
সম্প্রতি হালনাগাদ নাগরিকঞ্জি প্রকাশ করে ভারতের আসাম রাজ্য৷ তাতে রাতারাতি নাগরিকত্ব হারিয়েছেন ১৯ লাখেরও বেশি মানুষ, যাদের বেশিরভাগ মুসলিম৷ বাদ পড়াদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে অভিহিত করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কথা বলে আসছে ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতারা, যা বাংলাদেশের জন্য নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Nath
ক্রিকেটের উত্তেজনা
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ক্রিকেটের সম্পর্কটাও রাজনীতির মতোই ঐতিহাসিক৷ টাইগাররা ঢাকায় প্রথম টেস্ট খেলেছিল ভারতের বিপক্ষেই, ২০০০ সালে৷ তবে ভারতে টেস্ট খেলার সুযোগের জন্য ১৭ বছর অপেক্ষা করতে হয় বাংলাদেশকে৷ দুই দলের মধ্যে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্ট অবশ্য হয়েছে অনেক৷ সেখানে বেশ কিছু টানটান উত্তেজনার ম্যাচও হয়েছে৷ আগামী নভেম্বরে এই প্রথম দুই টেস্টের সিরিজ খেলতে ভারত সফরে যাবে বাংলাদেশ দল৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. Singh
16 ছবি1 | 16
এদিকে, ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া' রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের সহায়তা চাওয়ার বিষয়টি শিরোনাম করেছে৷ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব শহিদুল হকের একটি মন্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে৷ তিনি দুই দেশের সম্পর্ককে ‘বেস্ট অফ রিলেশন্স' বলেছেন৷
একই পত্রিকা আরেক প্রতিবেদনে আসামের নাগরিকপঞ্জি নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগ প্রকাশের বিষয়টি তুলে ধরেছে৷ দুই দেশের আলোচনার সময় এই বিষয়টি এক টুকরো বিব্রতকর পরিস্থিতি নিয়ে আসে বলে পত্রিকাটি জানাচ্ছে৷ তবে বিষয়টি ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ' ব্যাপার বলে নরেন্দ্র মোদী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছেন বলেও জানাচ্ছে ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া'৷
‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস' পত্রিকার বাংলা সংস্করণে সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকের খবর প্রকাশিত হয়েছে৷ এই সময় শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সোনিয়া, রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে আমন্ত্রণ জানান বলে পত্রিকাটি জানিয়েছে৷ সোনিয়া গান্ধী হাসিনার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন বলেও জানাচ্ছে পত্রিকাটি৷