বাংলাদেশের রাজনীতিকদের ধ্বংসাত্মক নীতি পরিহারের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার নাভি পিল্লাই৷ আর চলমান সহিংসতার কারণে নিরাপত্তার প্রশ্নে ইইউ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক নাও পাঠাতে পারে বলে জানা গেছে৷
ছবি: Reuters/Andrew Biraj
বিজ্ঞাপন
ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দূত উইলিয়াম হানা রবিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করার পর সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশের এখন যা রাজনৈতিক পরিস্থিতি তা চলতে থাকলে ইইউ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবে কিনা সেটা নতুন করে ভাবতে হবে৷ কারণ এখানে নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা এখানে এমন নির্বাচন চাই যা হবে স্বচ্ছ এবং সবার অংশগ্রহণমূলক''৷
এদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার নাভি পিল্লাই এক বিবৃতিতে বাংলাদেশকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে যাওয়ার মতো ধ্বংসাত্মক নীতি পরিহারের জন্য রাজনীতিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন৷ নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো সমাধানে পৌঁছতে ব্যর্থ হওয়ায় রাজনৈতিক সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন৷ তিনি বলেন এই সহিংসতায় বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং অনেক সম্পদের ক্ষতি হয়েছে৷ নাভি পিল্লাই বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের আটক এবং গ্রেফতার প্রক্রিয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন৷ তিনি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের আহ্বান জানিয়েছেন৷
বাংলাদেশ নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ বা জানিপপ-এর প্রধান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ইইউ নিরাপত্তার বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে৷ কারণ তাদের যে কর্মীরা এখানে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আসবেন তাঁদের তারা সহিংস পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিতে পারেন না৷ এখন বাংলাদেশের যা পরিস্থিতি তাতে দেশের নাগরিকরাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন৷ সেক্ষেত্রে বিদেশি পর্যবেক্ষকরা নিরাপদ বোধ করবেন না এটাই স্বাভাবিক৷ শেষ পর্যন্ত ইইউ যদি নির্বাচন পর্যবেক্ষক না পাঠায় তাহলে তা নির্বাচনের পরিবেশ এবং নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করবে বলে মনে করেন তিনি৷
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট থামছে না
আগামী বছরের সূচনায় জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু দুই মুখ্য রাজনৈতিক জোটের টানাপোড়েন অব্যাহত৷ অথচ দেশে-বিদেশে অনেকেই চান সংকট নিরসনে দুই বৈরী জোটের মধ্যে আলোচনা৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
ছবি: AP
দু’দলের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়েছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে৷ তবে মুখ্য বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়৷ তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, শাসক আওয়ামী লীগের কাছে যা সংবিধান লঙ্ঘনের সমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
জাতিসংঘ চায় সংলাপ
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই দুই বিবাদী জোটের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ মহাসচিব বান কি-মুন গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় নেতার প্রতি চলতি রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
হাসিনা চান সংসদে আলোচনা
জাতিসংঘ বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মহাসচিবের ফোনালাপের কোনো খুঁটিনাটি প্রকাশ করেনি৷ তবে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসিনা ‘‘জাতিসংঘের প্রধানকে জানিয়েছেন যে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন৷’’ বিরোধীপক্ষ যদি গোটা প্রসঙ্গটি সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব দেয়, তবে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন হাসিনা৷
ছবি: dapd
সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে বিএনপির ‘না’
বান কি-মুনের সঙ্গে ফোনালাপে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও সংকট সমাধানে সংলাপের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘‘বিরোধীপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না৷’’
ছবি: Reuters
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ও কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই পদ্ধতি বাতিল করে৷ বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে৷
ছবি: AP
জার্মানি সংলাপ সমর্থন করে
সংলাপকে বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে জার্মানি৷ ‘ঢাকা কুরিয়ার’ নামক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে বলেছেন, ‘‘দু’টি মুখ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলো বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের একমাত্র পথ৷’’
ছবি: DW/R. Manzoor
ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাক দিলেন
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস একটি ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ (নির্বাচনকালীন) সরকার’’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷ গত ২২ আগস্ট ইউনূস একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নির্বাচন অতি অবশ্য হওয়া উচিত এবং তা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)
হাসিনা সরকারের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু তা শাসকদল এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইসিটি এখন পর্যন্ত ছ’জন অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়েছে৷ বিরোধীপক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবিক উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নয়, পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইসিটি-র সমালোচনা করেছে৷ এইচআরডাব্লিউ বিবৃতিতে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ‘‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’’ ছিল৷ প্রতিক্রিয়া হিসেব সরকারি কৌঁসুলির তরফ থেকে এইচআরডাব্লিউ-এর বিরুদ্ধে আদালতের অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এইচআরডাব্লিউ-এর ‘‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’ রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ট্র্যাক রেকর্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষি খাতে সরকারের সাফল্যের খতিয়ান যাই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হাসিনা সরকারের অন্য সব সাফল্য ঐ একটি কেলেঙ্কারির আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ আগামী নির্বাচনেও পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রসঙ্গটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
ড. কলিমুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের উদ্বেগ যথার্থ৷ সংস্থাটি গত কয়েকমাস ধরে রাজনৈতিক সমঝোতা আনার চেষ্টা করছে৷ জাতিসংঘ মহাসচিবও উদ্যোগ নিয়েছেন৷ কিন্তু তারপরও রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়াই একটি একতরফা নির্বাচন হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে৷ যার প্রতিক্রিয়ায় ব্যাপক সহিংস কার্যকলাপ শুরু হয়েছে৷ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ৷ তাঁর মতে, জাতিসংঘ হয়তো এখন শেষ চেষ্টা করবে রাজনৈতিক সমঝোতার৷
তবে জানিপপ প্রধান বলেন কোনো নির্বাচন না হওয়ার চেয়ে, নির্বাচন হওয়া ভাল৷ তা যদি একপাক্ষিকও হয় তাহলেও সেটা পরবর্তীতে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের জন্য একটি সুযোগ রাখে৷ কিন্তু নির্বাচন না হলে অনির্বাচিত শক্তি ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ পায়৷ তবে তিনি এখনো আশা করেন বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হবে৷