‘বাংলাদেশের ঋণ না নিয়ে উপায় নেই’
২৮ জুলাই ২০২২অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের এখন যা অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তাতে বিদেশি ঋণ লাগবেই৷ বিশেষ করে ডলারের রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে বড় আকারের বৈদেশিক ঋণ দরকার৷ আইএমএফ-এর চেয়ে বড় কোনো বিকল্প উৎস বাংলাদেশের কাছে নেই৷
ঋণ কেন প্রয়োজন
অর্থনীতির একটি ‘বিশেষ অবস্থা' চলছে৷ বিশেষ করে ডলার সংকট আমদানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে৷ আর এবার বাজেট বাস্তবায়নেও ঋণ সহায়তা প্রয়োজন৷ ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার চলতি বাজেটে মোট ঘাটতি আছে দুই লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা৷ ঘাটতি মেটাতে বিদেশি উৎস থেকে ৯৮ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে৷ বৈদেশিক উৎস বাদে বাকি এক লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকার মধ্যে দেশের ব্যাংক খাত থেকে নেয়া হবে এক লাখ ছয় হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা৷
ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি চাপে আছে৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, এখন রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নীচে নেমে গেছে৷ ফলে এ দিয়ে পাঁচ-ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব৷ কিন্তু রিজার্ভের প্রধান উৎস প্রবাসী আয়, যা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে কমে ৪৯.৬ বিলিয়ন ডলার হয়েছে৷ রপ্তানি ঠিক থাকলেও আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে৷
গত অর্থ বছরের জুলাই থেকে মে ১১ মাসে আমদানি হয়েছে৭৫.৭ বিলিয়ন ডলারের, যা আগের তুলনায় ৩৯ শতাংশ বেশি৷ এই সময়ে রপ্তানিও বেড়েছে, তবে তা আমদানির তুলনায় কম৷ ৪৪.৪২ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি হয়েছে এই সময়ে৷ বেড়েছে ৩৩ শতাংশ৷ গত অর্থ বছরে রেমিট্যান্স এসেছে দুই হাজার ১০৩ কোটি ডলার৷ আর তার আগের অর্থ বছরে রেমিট্যান্স আসে দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ডলার৷
নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছেই৷ বিবিএস-এর হিসেবে সেটা এখন রেকর্ড ৭.৫৬ ভাগ৷
যে সব শর্ত পূরণ করতে হবে
পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশকে আইএমএফ-এর ঋণ পেতে যেসব শর্ত পূরণ করতে হবে, তার মধ্যে রয়েছে রিজার্ভের হিসাব আইএমএফ-এর ফর্মুলা অনুযায়ী করতে হবে৷ তাদের হিসেবে বাংলাদেশের রিজার্ভ আরো সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার কম ধরতে হবে৷ কারণ, বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড, শ্রীলঙ্কাকে ঋণ, বাংলাদেশ বিমানকে ঋণ, গ্রিন ট্রান্সফর্মেশন ফান্ডসহ আরো কয়েকটি খাতে যে ডলার দিয়েছে, তা ওই রিজার্ভের হিসাবে ধরা হয়েছে, যার পরিমাণ সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার৷ এটা হিসাবের বাইরে রাখতে হবে৷
আইএমএফ বাংলাদেশের রাজস্ব খাতে সংস্কার করে রাজস্ব আরো বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে৷ বিশেষ করে ভ্যাট সংস্কার করতে হবে৷ আর কিছু খাতে ট্যাক্স রেয়াতের তারা বিরোধী৷ তারা ডলারের দাম ওপেন মার্কেটের ওপর ছেড়ে দিতে বলছে৷ খোলা বাজারেই ডলারের দাম নির্ধারণ করতে বলছে তারা৷ এখন বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম বেঁধে দেয়৷ বাংলাদেশে এখন খোলা বাজারে ডলারের দাম ১১০ টাকা হলেও ব্যাংক রেট ৯৪ টাকার কিছু বেশি৷ তারা ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সংস্কার চায়৷ তারা ব্যাংক সুদের হার ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দিতে বলছে৷
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও কৃষি খাতে তারা ভর্তুকি পুরোপুরি তুলে দিতে বলছে৷ আর সর্বোপরি তারা দুর্নীতি বন্ধের কথা বলছে৷
সব শর্ত খারাপ নয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘‘আইএমএফ-এর ঋণ না নিয়ে বাংলাদেশের আর কোনো উপায় নেই৷ এখন তো বিশ্বব্যাংক ও এডিবি থেকেও ঋণ নেয়ার চেষ্টা করছে৷ বাজেট বাস্তবায়নে যেমন বিদেশি ঋণ লাগবে৷ তেমনি এখনকার পরিস্থিতি সামাল দিতেও এই ঋণ লাগবে৷”
তিনি বলেন, ‘‘আমরা এখন বিদ্যুৎ দিতে পারছি না৷ লোডশেডিং করতে হচ্ছে৷ জ্বালানি আমদানি কমিয়ে দেয়া হয়েছে৷ আমদানি কমানো হচ্ছে৷ টাকার অবমূল্যায়ন করতে হচ্ছে৷ মূল্যস্ফীতি বাড়ছে৷ তারপরও সাশ্রয়ী কতটা হতে পারবো? কারণ, আমাদের আমদানির ৭৫ ভাগ শিল্পের কাঁচামাল এবং ১১ ভাগ ভোগ্যপণ্য৷ বাকিটা বিলাস পণ্য৷ তাহলে আমদানি খুব বেশি কমানো যাবে না৷ আর আমাদের রপ্তানির প্রবৃদ্ধি নির্ভর করবে যেসব দেশে রপ্তানি করি, তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর৷ কিন্তু সারাবিশ্বই তো ঝামেলায় আছে৷ ফলে আমাদের ঋণ না নিয়ে উপায় নেই৷”
তার কথা, ‘‘আইএমএফ যে সব শর্ত দিচ্ছে তা যে সব খারাপ তা তো নয়৷ রাজস্ব আয় তো বাড়াতে হবে৷ ব্যাংকিং খাতে তো অনেক ঝামেলা আছে৷ সেটা তো দূর করতে হবে৷ আর বিদ্যুৎ, জ্বালানিতে আসলেই আমরা কতদিন ভর্তুকি দিতে পারবো তা ভাবার সময় এসেছে৷ কৃষি খাতে ভর্তুকি হয়ত আমরা তুলে নিতে পারবো না৷”
সিপিডির গবেষণা পরিচালক, অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘এই সময়ে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি স্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ৷ তার জন্য আমাদের বড় আকারের বিদেশি ঋণ লাগবেই৷ আইএমএফ যে পরিমাণ ঋণ দিতে চায়, তা পেলে আমাদের জন্য স্বস্তির কারণ হবে৷ অন্য যে উৎসগুলো আছে, তা স্বল্পকালীন৷ আমাদের বড় আকারের ঋণ লাগবেই৷ সেটা হলে আমদানি স্থিতিশীল হবে৷ অর্থনীতির বিশেষ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে পারবো৷”
তিনি মনে করেন, ‘‘যে শর্তগুলো আইএমএফ দিচ্ছে, তা নতুন নয়৷ স্বাভাবিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকারও সেই শর্তগুলো অর্থনীতির জন্য পূরণ করতে চায়৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখন অর্থনীতির একটি বিশেষ অবস্থা চলছে৷ তাই সরকারকে এখন বার্গেইন করতে হবে ঋণ পাওয়ার পর অর্থনীতি স্বাভাবিক হলে শর্তগুলো পূরণ শুরু করবে৷ এটা হতে পারে প্রথম কিস্তির ঋণ পাওয়ার পর দ্বিতীয় কিস্তি থেকে শুরু করবে৷”
তার কথা, ‘‘এখন রিজার্ভ আইএমএফ-এর শর্ত মেনেকম দেখালে ঋণ পেতে হয়ত সমস্যা হবে না৷ তবে আমাদের ঝুঁকি বেড়ে যাবে৷ তখন শর্ত বেড়ে যেতে পারে৷”