‘স্টেট অ্যাক্টরের’ তরফ থেকে গণমাধ্যমের উপর বড় ধরনের হুমকি না থাকলেও ‘নন-স্টেট অ্যাক্টরের’ তরফ থেকে আছে, মনে করেন একুশে টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল৷ ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে একথা বলেন তিনি৷
বিজ্ঞাপন
‘‘বাকস্বাধীনতার প্রসঙ্গটি নানাভাবে আসে’’
05:01
ডয়চে ভেলের গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামে অংশ নিতে সম্প্রতি জার্মানির বন শহরে আসেন বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন সাংবাদিক৷ এ সময় ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের বাকস্বাধীনতা এবং সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে মন্তব্য করেন মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল৷
বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি নানাভাবে আসে৷ আমরা ‘স্টেট অ্যাক্টর' এবং ‘নন-স্টেট অ্যাক্টর' যদি ভাগ করি, তাহলে দেখবো স্টেট অ্যাক্টরের দিক থেকে সাম্প্রতিককালে বড় ধরনের আক্রমণ গণমাধ্যমের উপর আছে এটা বলা যাবে না৷ কিন্তু নন-স্টেট অ্যাক্টরের দিক থেকে নানা ধরনের হুমকি আমরা প্রতক্ষ্য করি৷''
বাকস্বাধীনতা যেখানে যেমন
আপনার দেশে বাকস্বাধীনতা পরিস্থিতি কেমন? ডয়চে ভেলের দুই সাংবাদিক এই প্রশ্ন করেছিলেন সদ্য সমাপ্ত গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামে আগত বিভিন্ন দেশের ব্লগার, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্টদের৷
ছবি: DW/A. S. Brändlin
শাম্মী হক, অ্যাক্টিভিস্ট, বাংলাদেশ
‘‘বাংলাদেশের মানুষ তাদের মনের কথা বলতে পারেন না৷ সেখানে কোনো বাকস্বাধীনতা নেই এবং প্রতিদিন পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাচ্ছে৷ একজন সামাজিক অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার হিসেবে আমি ধর্ম নিয়ে লেখালেখি করি, যা ইসলামিস্টরা পছন্দ করেনা৷ তারা ইতোমধ্যে ছয় ব্লগারকে হত্যা করেছে৷ ফলে আমি দেশ ছাড়তে বাধ্য হই৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ভেনেজুয়েলা
‘‘বাকস্বাধীনতা হচ্ছে এমন এক ধারণা যার অস্তিত্ব আমার দেশে নেই৷ সাংবাদিকরা জরিমানা আর নিজের জীবনের উপর ঝুঁকি এড়াতে সরকারের সমালোচনা করতে চায়না৷ সরকারের সমালোচনা করলে সাংবাদিকদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়৷ এরকম পরিস্থিতির কারণে অনেক সাংবাদিক দেশ ছেড়ে চলে গেছেন৷ দেশটির আশি শতাংশ গণমাধ্যমের মালিক সরকার, তাই সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
রোমান দবরোখটভ এবং একাতেরিনা কুজনেটসোভা, সাংবাদিক, রাশিয়া
রোমান: ‘‘রাশিয়ায় সরকার আপনাকে সেন্সর করবে৷ আমাদের ওয়েবসাইটটি ছোট এবং লাটভিয়ায় নিবন্ধিত৷ ফলে আমি সেন্সরশিপ এড়াতে পারছি৷ তা সত্ত্বেও সরকার মাঝে মাঝে আমাদের সার্ভারে হামলা চালায়৷’’ একাতেরিনা: ‘‘রাশিয়ায় বাকস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ ইউরোপের মানুষ রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে স্বাধীন৷ আমি আশা করছি, রাশিয়ার পরিস্থিতিও বদলে যাবে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, সিরিয়া
‘‘বেশ কয়েক বছর ধরেই সিরিয়ায় বাকস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ এমনকি আসাদের শাসনামল সম্পর্কে অনুমতি ছাড়া মতামতও প্রকাশ করা যায়না৷ এটা নিষিদ্ধ৷ কেউ যদি সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তাহলে খুন হতে পারে৷ আমি যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনামূলক কিছু লিখি, তাহলে বেশিদিন বাঁচতে পারবো না৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
আয়েশা হাসান, সাংবাদিক, পাকিস্তান
‘‘পাকিস্তানে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা’ শব্দ দু’টি খুবই বিপজ্জনক৷ এগুলোর ব্যবহার আপনার ক্যারিয়ার বা জীবন শেষ করে দিতে পারে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
রাবা বেন দউখান, রেডিও সাংবাদিক, টিউনিশিয়া
‘‘আমাদের অভ্যুত্থানের একমাত্র ফল হচ্ছে বাকস্বাধীনতা৷ আমরা এখন আমাদের সরকারের সমালোচনা করার ব্যাপারে স্বাধীন৷ এবং আমি যখন আমাদের অঞ্চলের অন্য দেশের বাসিন্দাদের বাকস্বাধীনতার কথা জিজ্ঞাসা করি, তখন একটা বড় ব্যবধান দেখতে পাই৷ আমাদের দেশে দুর্নীতিসহ নানা সমস্যা আছে সত্যি, তবে বাকস্বাধীনতা কোনো সমস্যা নয়৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
খুসাল আসেফি, রেডিও ম্যানেজার, আফগানিস্তান
‘‘বাকস্বাধীনতা আফগানিস্তানে একটি ‘সফট গান৷’ এটা হচ্ছে মানুষের মতামত, যা সম্পর্কে সরকার ভীত৷ এটা চ্যালেঞ্জিং হলেও আমাদের প্রতিবেশীদের তুলনায় আমাদের অবস্থা ভালো৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
সেলিম সেলিম, সাংবাদিক, ফিলিস্তিন
‘‘ফিলিস্তিনে সাংবাদিকদের খুব বেশি স্বাধীনতা নেই৷ একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, সাংবাদিকরা মুক্তভাবে ঘোরাফেরা করতে পারে না৷ ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করছে৷ তারা যদি ফেসবুকে তাদের মতামত জানায়, তাহলেও সরকার গ্রেপ্তার করে৷ তবে সিরিয়া বা ইরাকের চেয়ে অবস্থা ভালো৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
অনন্য আজাদ, লেখক, বাংলাদেশ
‘‘আমাদের দেশে কোনো বাকস্বাধীনতা নেই৷ আপনি ইসলাম বা সরকারের সমালোচনা করে কিছু বলতে পারবেন না৷ ইসলামী মৌলবাদীরা ঘোষণা দিয়েছে, কেউ যদি ইসলামের সমালোচনা করে, তাহলে তাকে হত্যা করা হবে৷ আমি একজন সাংবাদিক এবং গত বছর আমাকে ইসলামিস্ট জঙ্গিরা হত্যার হুমকি দিয়েছে৷ ফলে আমাকে দেশ থেকে পালাতে হয়েছে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
9 ছবি1 | 9
বাকস্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন আইনকানুন সংস্কারের বিষয়েও কথা বলেছেন বুলবুল৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের পুরনো আইনকানুন সংস্কার হচ্ছে, আবার কোথাও কোথাও নতুন আইনের মধ্যে এমন সব ধারা সংযুক্ত হচ্ছে যেটা নিয়ে আমরা আতঙ্কিত বোধ করি৷''
তবে বাংলাদেশের গণমাধ্যম সরকারের সমালোচনা করতে পার বলে মনে করেন সাংবাদিক নেতা বুলবুল৷ তিনি বলেন, ‘‘গণমাধ্যম কথা বলতে পারে, সরকারের সমালোচনা করতে পারে, কিন্তু নন-স্টেট অ্যাক্টরের দিক থেকে যেটা আছে, সেখানে কথা বলাও যায় না, শোনাও যায় না, তারা তাদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেয়৷ আর তাই, বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে আমরা আংশিক স্বাধীন বলি৷''
সম্প্রতি ব্লগার, অ্যাক্টিভিস্টদের উপর হামলাকে নন-স্টেট অ্যাক্টরের কাজ বলে মনে করেন করেন বুলবুল৷ তিনি বলেন, ‘‘মেয়েদের বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান কাভার করতে যেতে মানা করা হচ্ছে, এগুলো হচ্ছে নন-স্টেট অ্যাক্টরের কাছ থেকে আমরা হুমকিটা পাচ্ছি৷'' মানুষের মত প্রকাশের উপর হামলা প্রতিরোধে সরকারের সাফল্যের মাত্রা খুব বেশি নয় বলে মনে করেন এই সাংবাদিক নেতা৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার নিজের নামও নন-স্টেট অ্যাক্টরদের হত্যার তালিকায় আছে৷''
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডকে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের জন্য খুবই দুঃখজনক ঘটনা আখ্যা দিয়ে বুলবুল বলেন, ‘‘আমরা সাংবাদিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে সরকারের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখছি৷ এবং দুঃখজনকভাবে আমাদের একটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা উচ্চতর আদালতে স্বীকার করলো, যে তারা এটা (খুনিদের শনাক্ত) করতে ব্যর্থ হয়েছে৷ কিন্তু সেই ব্যর্থতার জন্য সংস্থাটিকে কোনোভাবে বিচারের বা জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা গেল না৷''
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷