নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ বাংলাদেশে একটি বড় খবর৷ তাই সোমবার সন্ধ্যার সেই অনুষ্ঠান এবং তার খবর জানার আগ্রহও ছিল বেশ৷ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও সাধারণ মানুষ এ নিয়ে কথা বলেছেন, মন্তব্য করেছেন সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে৷ একই সঙ্গে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে ঢুঁ মেরেছেন তাঁরা খবর জানতে৷ বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমও এ নিয়ে সর্বশেষ খবর পরিবেশনে ছিল ব্যস্ত৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ড. শান্তনু মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই আগ্রহ স্বাভাবিক৷ ভারত আমাদের সবচেয়ে বৃহৎ এবং ক্ষমতাধর প্রতিবেশী৷ এছাড়া কংগ্রেসের পর বিজেপি ক্ষমতায় আসায় এই আগ্রহ বেড়ে গেছে৷ কারণ নতুন একটি দল ভারতের ক্ষমতায় এসেছে৷ তাই দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন কোনো অবস্থা সৃষ্টি হবে কিনা – সে প্রশ্ন আছে অনেকের মনেই৷’’
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reutersমোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: APদাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNIভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: APভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpaনির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd ‘‘তবে প্রশ্ন এবং সংশয় যাই থাকুক না কেন, এটা একটি অমোঘ সত্য যে আমরা চাইলেই প্রতিবেশী পরিবর্তণ করতে পারব না৷ তাই আমরা চাই বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সমতার ভিত্তিতে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠুক৷’’
শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘‘মোদী সরকার বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কী পদক্ষেপ নেয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়৷ তিস্তার পানি, সীমানা চিহ্নিতকরা, সীমান্ত হত্যা বন্ধ – এই বিষয়গুলো অনেক দিন ধরে ঝুলে আছে৷ নতুন সরকার তা ঝুলিয়ে রাখবে না সমাধান করবে – তা আমাদের জানা দরকার৷’’
তাঁর মতে, ‘‘ভারতের নতুন সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারের আদর্শিক দূরত্ব থাকতে পারে৷ তবে তা সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের পথে বাধা হওয়া উচিত নয়৷’’
অন্যদিকে সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং কূটনীতিক কাজী আনোয়ারুল মাসুদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের একটা ধারাবাহিকতা আছে৷ আছে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট৷ দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্কও বহুমাত্রিক৷ তাই সম্পর্কের ধারাবাহিকতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু তারপরও নতুন সরকারের সিদ্ধান্ত এবং কাজ না দেখে আগাম কোনো মন্তব্য করা কঠিন৷’’
তিনি বলেন, ‘‘ভারতের নতুন এই সরকারটির রাজনৈতিক আদর্শ আগের সরকারের থেকে ভিন্ন৷ কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের নীতি ভিন্ন হবে কিনা – তা বলার সময় এখনো আসেনি৷’’ তাই তিনি জানান, ‘‘শুধু রাজনীতিবিদরাই নয়, কূটনীতিক এবং বিশ্লেষকরাও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন৷ তাঁরা বোঝার চেষ্টা করছেন ভারতে সরকার পরিবর্তন কতটা গুণগত আর কতটা প্রচারণামূলক৷’’
আনোয়ারুল মাসুদের কথায়, ‘‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের কতগুলো ‘কমন’ ইস্যু আছে৷ পানি, সীমান্ত, নিরাপত্তা, বণিজ্য – এ সব৷ আর এই সব ইস্যুই হবে সম্পর্কের নিয়ামক৷ কারণ এই ইস্যুগুলোর সঙ্গে নাগরিকরা সরাসরি জড়িত৷ এর মাধ্যমে ভোটের হিসাব হয়৷ মোদী যেমন ভোটের হিসাব করেছেন৷ বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরাও তাই করেন৷’’