‘আইসবার্গ’, অর্থাৎ হিমশৈল থেকে এক ধরণের ‘বিয়ার’ তৈরি হচ্ছে ক্যানাডার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের নিউফাউন্ডল্যান্ডে৷ সেখানে বরফের কমতি নেই৷ তাই সমস্যা নেই সেই বরফ গলা বিশুদ্ধ জল ভিন্নভাবে ব্যবহার করা নিয়ে৷ কিন্তু বাংলাদেশে?
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের মতো বিশুদ্ধ পানীয় জল বিশ্বের অনেক দেশেই দুষ্প্রাপ্য৷ এই যেমন দূষণের কারণে সেখানকার নলকূপগুলোর পানিতে রয়েছে আর্সেনিকের সমস্যা৷ সত্তরের দশকে প্রায় ৪০ লাখ কূপ বসানো হয়েছিল বাংলাদেশে৷ কিন্তু ১৯৯৩ সালে তার মধ্যে বহু কূপের পানিতে আর্সেনিক ধরা পড়ে৷ অর্থাৎ সেই জল পরিণত হয় ‘অপেয়' পানিতে৷
কিন্তু বাংলাদেশে তো বরফ নেই৷ সুতরাং বঙ্গোপসাগরের ‘আইসবার্গ' ধরে পানি সংগ্রহ করার প্রশ্নও ওঠে না৷ তাই তখন ‘গ্রাউন্ডওয়াটার', মানে ভূগর্ভস্থ পানি ছেড়ে ‘সার্ফেস ওয়াটার' বা ভূপৃষ্ঠের পানিতে ফিরতে হয় মানুষকে৷
পানির অপচয় রোধের দশ উপায়
পানির আরেক নাম জীবন৷ অথচ এই পানি, বিশেষ করে বিশুদ্ধ পানি ক্রমশ কমে যাচ্ছে৷ যা জীবনের জন্য এক হুমকি৷ এই হুমকি মোকাবিলায় সচেতন হতে হবে আপনাকেও৷ চলুন জেনে নেই পানির অপচয় রোধের দশ উপায়৷
ছবি: Fotolia/Valua Vitaly
এক কাপ কফি তৈরিতে ১৪০ লিটার পানি!
আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য বা পানীয় তালিকার কিছু পণ্য তৈরিতে অনেক পানি প্রয়োজন হয়৷ যেমন এক কাপ কফি বাগান থেকে আপনার টেবিল পর্যন্ত পৌঁছাতে খরচ হচ্ছে ১৪০ লিটার পানি৷ আর এক লিটার দুধের পেছনে ব্যয় ১,০০০ লিটার পানি৷ তাই এ সব পানীয়র অপচয় কমানোর মাধ্যমে পানির অপচয় রোধ করা সম্ভব৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: Fotolia/dmitrimaruta
মাংস খাওয়া কমাতে পারেন
ওয়াটারফুটপ্রিন্ট ডটঅর্গ-এ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এক কেজি মাংস উৎপাদনে সবমিলিয়ে খরচ হয় ১৫ হাজার লিটারের মতো পানি৷ এই হিসাবের মধ্যে পশুর জন্ম এবং বেড়ে ওঠার সময় প্রয়োজনীয় পানির পরিমাণও বিবেচনা করা হয়েছে৷ এবার ভেবে দেখুন, এক বেলা মাংস না খেয়ে কতটা পানি বাঁচানো সম্ভব?
ছবি: picture-alliance/dpa
পানির ট্যাপের দিকের নজর রাখুন
মুখ ধোয়া বা দাঁত ব্রাশ করার সময় পানির ট্যাপ বন্ধ রাখুন৷ একান্ত যদি গরম পানি পেতে ট্যাপ একটু খুলে রাখতে চান, তাহলে সেই পানি ব্যবহার করতে পারেন ব্রাশ ধোয়ার কাজে৷
ছবি: imago/CHROMORANGE
কাপড় বা থালাবাসন পরিষ্কারে সতর্ক হন
কাপড় ধোয়া বা থালাবাসন পরিষ্কারের মেশিন এখন ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে৷ পুরোপুরি ভর্তি না হওয়া অবধি এ সব মেশিন ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন৷
ছবি: Fotolia/lightpoet
অপ্রয়োজনে ফ্লাশ নয়
অনেকেই যখন-তখন টয়লেট ফ্লাশ করে থাকেন৷ এতে প্রচুর পানি অপচয় হয়৷ তাই একান্ত প্রয়োজন না হলে ফ্লাশ করা থেকে বিরত থাকুন৷
ছবি: by-studio - Fotolia.com
পুকুরে ময়লা ফেলা নয়
বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানুষ সুযোগ পেলেই পুকুর বা খালে ময়লা ফেলে৷ এতে করে পানি দূষিত হয়৷ আর দূষিত পানি পুনরায় পান উপযোগী করে তুলতে খরচ হয় প্রচুর অর্থ এবং বিদ্যুৎ৷ তাই পুকুরে বা খালে ময়লা না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে বা মাটিতে গর্ত করে ময়লা ফেলুন৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
পানির পাইপের দিকে নজর দিন
অনেক সময় পানির পাইপে থাকা বিভিন্ন জোড়া হালকা হয়ে চুইয়ে চুইয়ে পানি বাইরে পরে যায়৷ একটু সতর্ক হলেই এভাবে পানির অপচয় রোধ করা যায়৷ এছাড়া ছাদের ট্যাংকি ভর্তি হয়ে যাতে পানি বাইরে পরে না যায় সেদিকেও খেয়াল রাখুন৷ সময়মতো পানির পাম্প বন্ধ করে দিন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গোসলের সময় অপচয় নয়
বাথরুমে থাকা গতানুগতিক বা পুরনো পানির ঝরনাগুলো সরিয়ে ফেলুন৷ বর্তমানে বাজারে পানি সাশ্রয়কারী ঝরনা পাওয়া যায়৷ সেগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে ২০ থেকে ৬০ শতাংশ পানির অপচয় রোধ সম্ভব৷ আর গোসলের সময় প্রস্রাব করার অভ্যেস তৈরির মাধ্যমে দিনে অন্তত একবার ফ্লাশ করার পানি বাঁচানো সম্ভব৷
ছবি: Fotolia/Valua Vitaly
পানি কখনো ফেলে দেবেন না
পানি পান করার পর যদি গ্লাসের তলায় খানিকটা পানি থেকে যায়, তাহলে তা ফেলে দেবেন না৷ সেটুকু আপনার গাছের গোড়ায় ঢালতে পারেন কিংবা চায়ের কেটলিতে জমাতে পারেন৷
ছবি: mdxphoto - Fotolia.com
সম্ভব হলে বৃষ্টির পানি জমা করুন
বৃষ্টির পানি জমা করে তা বিভিন্ন কাজে ব্যবহার এমনকি পান করাও সম্ভব৷ বর্তমানে বৃষ্টির পানি সংগ্রহের বিভিন্ন সরঞ্জামও বাজারে পাওয়া যাচ্ছে৷ মনে রাখবেন, আপনার সামান্য উদ্যোগ পানির অপচয় রোধে বড় ভূমিকা রাখতে পারে৷ তাই চেষ্টা করে দেখুন না!
ছবি: DW/Karin Jäger
10 ছবি1 | 10
এরপর ২০০৪ সালে একবার বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ মানুষ ‘উন্নততর' পানির উৎসের সঙ্গে যুক্ত৷ একটি নিম্ন আয়ের দেশের পক্ষে এহেন একটা পরিসংখ্যান সত্যিই চমকপ্রদ৷ কিন্তু তারপর আবারো সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে সেই ‘আর্সেনিক' সমস্যা৷
ঢাকার পানি সরবরাহের ৮২ শতাংশ অবশ্য আসে গ্রাউন্ডওয়াটার থেকে; সেই ভূগর্ভস্থ পানি আর্সেনিক মুক্ত৷ কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা রাজধানীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শহরের সম্প্রসারণ এবং পানির ব্যবহার৷ বিশেষজ্ঞরা জানান, ঢাকার নীচে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বছরে দুই থেকে তিন মিটার নেমে যাচ্ছে৷ বলতে কি, শহরটির ভূগর্ভস্থ পানির উচ্চতা গত চার দশকে ৫০ মিটার নেমে গেছে৷ অর্থাৎ, আজ পানি পেতে হলে অন্তত ৬০ মিটার মাটি খুঁড়তে হবে৷
প্রশ্ন হলো, তাহলে ঢাকা তথা বাংলাদেশে বিশুদ্ধ পানীয় জলের সন্ধান কি একেবারেই মিলবে না?
বাংলাদেশে ডিপ টিউবওয়েল বসিয়ে ইলেকট্রিক পাম্প দিয়ে সেচের জল তোলাটা সাধারণ ব্যাপার৷ সরকার একবার পরিকল্পনা করছিল, সেই পানি পানীয় জল হিসেবে বিক্রি করা যায় কিনা৷ আবার ছোটখাটো কারখানার জন্যও সেই পানি বিক্রি করা যেতে পারে৷ আসলে পানি ব্যাপারটা সার্বজনীন: পানি সকলের প্রয়োজন; পানির উৎস আছে, তেমন ব্যবহারও আছে; আর আছে ময়লা পানি এবং পানির দূষণ৷ সর্বক্ষেত্রেই প্রয়োজন পরিবর্তন ও সচেতনতার৷
খাবার যেখানে প্রাণনাশক!
এতকাল বলা হয়েছে, মানবদেহে আর্সেনিক প্রবেশের অন্যতম উপায় পানীয় জল৷ এবার গবেষকরা জানিয়েছেন এক নতুন তথ্য৷ ভাতের মাধ্যমেও নাকি শরীরে ছড়াতে পারে আর্সেনিক, যা শরীরে ক্যান্সারের মতো রোগের কারণ হতে পারে৷
ছবি: FARJANA K. GODHULY/AFP/Getty Images
আর্সেনিক দূষণ
বাংলাদেশের কয়েকটি অঞ্চলে আর্সেনিকের উপস্থিতি ধরা পড়েছে অনেক আগেই৷ পানীয় জলের মাধ্যমে এই আর্সেনিক শরীরে প্রবেশ করে বলেও জানা গেছে বিভিন্ন গবেষণায়৷ এবার ‘‘প্লোস ওয়ান’’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র বলছে, ভাতের মাধ্যমেও শরীরে ছড়াতে পারে আর্সেনিক বিষ৷ ভূগর্ভস্থ পানিতে থাকা আর্সেনিক যে চালের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে, তা নিয়ে এটাই এখন অবধি সবচেয়ে বড় গবেষণা৷
ছবি: FARJANA K. GODHULY/AFP/Getty Images
সহজে মানুষের নাগালে
ভূগর্ভস্থ পানিতে প্রাকৃতিকভাবেই আর্সেনিক বিষের মিশ্রন ঘটে৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সত্তরের দশকে ‘সবার জন্য পানি’ সংক্রান্ত এক প্রকল্পের আওতায় অনেক অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়৷ ফলে মাটির নীচের আর্সেনিকযুক্ত পানি সহজে সাধারণ মানুষের নাগালে চলে আসে৷
ছবি: MUFTY MUNIR/AFP/Getty Images
ভাত বেশি খেলে সমস্যা
‘‘প্লোস ওয়ান’’ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রটি তৈরি করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা ১৮,৪৭০ জন স্বেচ্ছাসেবীর দেওয়া নমুনা পরীক্ষা করেছেন৷ তারা সবাই আর্সেনিক-দূষিত এলাকায় বসবাস করছেন৷ গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে যারা বেশি করে ভাত খান তাদের প্রস্রাবে আর্সেনিকের মাত্রা বেশি৷ অপেক্ষাকৃত কম ভাত খাওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে এই তুলনা করেছেন গবেষকরা৷
ছবি: Suhail Waheed
মানবদেহের ক্ষতির কারণ
ব্রিটেনের লিচেস্টারে অবস্থিত ডি মোন্টফোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিসিন বিশেষজ্ঞ পারভেজ হারিস বলেন, ‘‘গবেষণায় পানিতে আর্সেনিক দূষণ এবং ‘ফুড চেইনে’ তার প্রভাবের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে৷ একইসঙ্গে এটাও পরিষ্কার যে চালের মাধ্যমে পরিবাহিত আর্সেনিক মানবদেহের ক্ষতির কারণ হতে পারে৷ বিশেষ করে চামড়ায় ক্ষতের সঙ্গে এটির সম্পর্ক পাওয়া গেছে৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
জটিল পরিস্থিতি
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ৪১৭টি গ্রামে পরিচালিত এক গবেষণায় সেখানকার মানুষের প্রস্রাবের নালীর কোষের জেনেটিকে ক্ষতির নমুনা পাওয়া গেছে৷ এরফলে একটি কোষ থেকে আরেকটি কোষে ডিএনএ কোড সঠিকভাবে স্থানান্তর হতে পারছে না৷ এধরনের জটিলতা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় বলে মনে করেন গবেষকরা৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
ক্যান্সারের ঝুঁকি
এর আগে প্রকাশিত আরেক গবেষণা থেকে জানা যায়, দীর্ঘ সময় ধরে স্বল্প পরিমাণে আর্সেনিক নিয়মিত শরীরে প্রবেশ করলে মূত্রাশয়, কিডনি, ফুসফুস অথবা চামড়ায় ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে৷
ছবি: Fotolia/Schlierner
ভাত কম খান
বায়োমেডিসিন বিশেষজ্ঞ পারভেজ হারিস বলেন, ‘‘আড়াইহাজার এবং আর্সেনিক দূষণের শিকার অন্যান্য অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে যারা প্রতিদিন গড়ে ১ দশমিক ছয় কেজির বেশি ভাত খান, তাদের প্রতি আমাদের পরামর্শ হচ্ছে আপনারা ক্যালোরির উৎস হিসেবে ভাতের উপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে দিন৷ এক্ষেত্রে বিকল্প হতে পারে গম এবং কম আর্সেনিক দূষণযুক্ত এলাকায় উৎপাদিত চাল৷ সিলেট অঞ্চলের চালে আর্সেনিকের মাত্রা কম৷’’
ছবি: FARJANA K. GODHULY/AFP/Getty Images
অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য
গবেষকরা বলছেন, তাদের এই গবেষণা আর্সেনিক দূষণের ঝুঁকিতে থাকা পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে৷ সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে কম্বোডিয়া, চীন, ভারত এবং ভিয়েতনামে আর্সেনিক নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
8 ছবি1 | 8
যেমন বাংলাদেশের জন্য বৃষ্টির পানিই কিন্তু ‘আইসবার্গ' হয়ে উঠতে পারে৷ অঞ্চলভেদে এখানে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের হার ২০০-২৫০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার৷ এর মধ্যে উপকূল ও পাহাড়ি অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি৷ এ সব অঞ্চলে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করলে সুফল দেবে বৈকি!
এই পানি ধরে রাখা বা সংরক্ষণ করা গেলে, তা থেকেই সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা যেতে পারে৷ পানি বিশেষজ্ঞ ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘‘বাংলাদেশে বছরে সুপেয় পানির চাহিদা ১৬০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার৷ তাই বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করলে বেশির ভাগ পানির কাজই আমরা সেই পানি দিয়ে করতে পারি৷ মোকাবিলা করতে পারি আর্সেনিক সমস্যারও৷''
বলা বাহুল্য, এক্ষেত্রে বরফ গলানোরও প্রয়োজন নেই৷ কারণ আকাশ থেকে সেটা তো গলেই পড়ছে!
বেসরকারি সংগঠন ‘ওয়াটার এইড বাংলাদেশ' বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েট-এর সহযোগিতায় সেরকমই একটা কাজ শুরু করেছে৷ তবে এর জন্য যে আরো সচেতনতা, পানির আরো সদ্ব্যবহার প্রয়োজন৷