বাংলাদেশের তাপমাত্রা গত তিন দশকে দ্রুত বেড়েছে৷ সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিইজিআইএস আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলছে, শীতকাল আরো বেশি শুষ্ক এবং বর্ষাকাল আরো বেশি আর্দ্র হচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
গেল তিন দশকে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা তার আগের তিন দশকের চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে৷ জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ২৭ উপলক্ষে প্রকাশিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান বা জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনায় এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে৷
সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফর্মেশন সার্ভিসেস বা সিইজিআইএসের হিসেবে, ১৯৬১ থেকে ১৯৯০ সালে প্রতিবছর গড়ে তাপমাত্রা বেড়েছে ০.০০৬৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ আর ১৯৯১ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত তাপমাত্রা বেড়েছে প্রতিবছর গড়ে ০.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ অর্থাৎ আগের তিন দশকের তুলনায় গত তিন দশকে গড় তাপমাত্রা বেড়েছে এর প্রায় সাড়ে চার গুণ৷
সিইজিআইএসের হিসেবে আরো দেখা যায়, যতই সময় গড়াচ্ছে তত তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার বাড়ছে৷ যেমন, গত তিন দশকের মধ্যে ১৯৯১ থেকে ২০০০-এর মধ্যে তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০০১ থেকে ২০১০ পর্যন্ত বেড়েছে বছরে গড়ে ০.৫৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গড়ে ১.০৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷
বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া
শীত ও বর্ষায় সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা যথাক্রমে বছরে বেড়েছে ০.৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও ০.৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ অর্থাৎ, শীতকাল ক্রমে উষ্ণতর হচ্ছে৷
একইসঙ্গে বৃষ্টিপাতের ধরনও বদলে যাচ্ছে৷ যেমন, দেশ জুড়ে গড়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ গড়ে ৮.৪ মিলিমিটার বেড়েছে৷ শীতকালে অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এবং প্রাক বর্ষা মৌসুমে অর্থাৎ মার্চ থেকে মে মাসে বৃষ্টিপাত বছরে কিছুটা কমেছে৷ অন্যদিকে, বর্ষা ও বর্ষার পর, অর্থাৎ, জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বৃষ্টির পরিমাণ বেড়েছে৷ এর অর্থ শীতকাল আরো বেশি শুষ্ক ও বর্ষা মৌসুম আরো বেশি আর্দ্র হচ্ছে৷
ভবিষ্যৎ কোন দিকে?
এদিকে, জাতিসংঘের জলবায়ু সংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেল আইপিসিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, যেভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হচ্ছে তাতে সারা পৃথিবীতে তাপমাত্রা ২০৩০ সাল নাগাদ শিল্পযুগের শুরু থেকে দেড় ডিগ্রি বাড়বে৷ আর ২০৫০ সাল নাগাদ ১.৭ ডিগ্রি থেকে ২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে৷ দীর্ঘমেয়াদে, অর্থাৎ শতাব্দীর শেষে তাপমাত্রা বাড়তে পারে ১.৮ ডিগ্রি ৪.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ তাদের হিসেবে, বাংলাদেশের তাপমাত্রা ২০৩০ সাল নাগাদ তাপমাত্রা শিল্পযুগের শুরুর চেয়ে ০.৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ০.৬৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারে৷ ২০৫০ সাল নাগাদ ১.৩ ডিগ্রি থেকে ২ ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়তে পারে৷
তাপমাত্রা বাড়লে কী হবে?
আইপিসিসির গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে অতিবৃষ্টির হার বাড়ে ৭ ভাগ৷ বাড়ে শক্তিশালী সাইক্লোনের হার৷ প্রতিবেদনটি বলছে, পৃথিবীর তাপমাত্রা আর ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে প্রতি শতকে দুই থেকে তিনবার ভয়ঙ্কর অতিবৃষ্টির কবলে পড়বে পৃথিবী৷ প্রতি দশকে একবার প্রচণ্ড খরায় অধিকাংশ জমি শুকিয়ে যাবে এবং চারবার উর্বরতা হারাবে৷ হিট ওয়েভ বা তাপপ্রবাহের ঘটনা এরই মধ্যে বেড়েছে ২.৮ গুণ৷ আর একটি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়লে তা ৯.৪ গুণ বাড়বে এবং তাপমাত্রা বাড়বে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷
‘‘এই প্রতিবেদনটি হলো বাস্তবতা,'' বলেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং আইপিসিসির ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্য ভেলেরি ম্যাসন-ডেলমট৷ প্রতিবেদনটি বলছে, জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করে মানুষ পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রাকশিল্পযুগের চেয়ে এরই মধ্যে প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়িয়ে ফেলেছে (০.৮ ডিগ্রি সে. থেকে ১.২ ডিগ্রি সে.)৷ এর অর্থ গড়ে প্রতি দশকে মানবসৃষ্ট কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে ০.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷
‘‘রিপোর্টের ফল দেখে এটা নিশ্চিত যে, আমরা এরইমধ্যে একটি জলবায়ু সংকটের ভেতর পড়ে গেছি,'' বলেন জুরিখভিত্তিক বিজ্ঞানী সোনিয়া জেনেফিরাটনে৷
বাংলাদেশের জলবায়ু বিশেষজ্ঞ সালিমুল হক বলেন, ‘‘ আইপিসিসির প্রতিবেদনে এটি পরিষ্কার যে, মানবসৃষ্ট কারণে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ফলে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হচ্ছি৷ এর ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে৷ বেড়েছে দুর্যোগের সংখ্যা ও তীব্রতা৷''
কপ-২৭: মিশরের আলোচনায় প্রধান ভূমিকা রাখবে যারা
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী ১৯৭টি দেশের সবারই নিজস্ব উদ্বেগ ও লক্ষ্য রয়েছে৷ কিন্তু কিছু দেশ ও গ্রুপ এই আলোচনায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে৷ তাদের নিয়ে এই ছবিঘর৷
ছবি: Fabian Bimmer/Reuters
চীন
বিশ্বের সবচেয়ে বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশ চীন৷ এ বছরই দেশটিতে গ্রীষ্মে সবচেয়ে উষ্ণ তাপমাত্রার রেকর্ড হয়েছে৷ কিন্তু জ্বালানি নিরাপত্তার কথা বলে কয়লার ব্যবহার বাড়াচ্ছে দেশটি৷ তবে কয়লার ব্যবহারে স্বচ্ছতা নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে চীন৷ জ্বালানি নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক রাজনীতিও বড় ভূমিকা রাখছে৷ তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক জলবায়ু আলোচনা বাতিল করেছে চীন৷
ছবি: AFP/Getty Images/A. Wallace
যুক্তরাষ্ট্র
চীনের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম কার্বন নিঃসরণকারী দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র৷ সম্প্রতি দেশটি কিছু আইনী পরিবর্তন এনেছে৷ এর ফলে দেশটিতে সবুজ জ্বালানি এবং পরিবহণে কয়েক লাখ কোটি ডলার বিনিয়োগ সম্ভব হবে৷ আগস্টে ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্টে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সই করার ফলে দেশটির ন্যাশনাল গ্রিডে সবুজ বিদ্যুৎ বাড়বে৷ এই দশকের শেষ থেকে বছরে ১০০ কোটি টন কার্বন নিঃসরণ কমানো সম্ভব হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷
ছবি: Erik McGregor/Pacific Press/picture alliance
ইউরোপীয় ইউনিয়ন
ইউরোপের ২৭ দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের আট শতাংশের জন্য দায়ী৷ তবে এর পরিমাণও অনেক বছর ধরেই কমছে৷ ২০৩০ সালের মধ্যে ১৯৯০ সালের তুলনায় কার্বন নিঃসরণ ৫৫% কমানোর আইন পাস করেছে এই জোট৷ কিন্তু কীভাবে এই লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়, এ নিয়ে এখনও আলোচনা চলছে৷ জলবায়ু সম্মেলনে একক গ্রুপ হিসাবে আলোচনায় অংশ নেয় ইইউ৷
ছবি: Fabian Bimmer/Reuters
যুক্তরাজ্য
রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিদ্যুৎসংকটের ফলে গতবারের জলবায়ু সম্মেলন আয়োজক দেশটির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হুমকিতে পড়েছে৷ ২০৫০ সালের মধ্যে নেট-জিরো কার্বন নিঃসরণে পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দেশটি৷ নতুন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের নেতৃত্বে কীভাবে দেশটি জলবায়ুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে, তা স্পষ্ট নয়৷ যুবরাজ থাকা অবস্থায় জলবায়ু নিয়ে সোচ্চার থাকা বর্তমান রাজা চার্লস মিশরের সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন না বলে জানানো হয়েছে৷
ছবি: Justin Ng/Avalon/picture alliance
‘বেসিক’ রাষ্ট্র
এই ব্লকে রয়েছে ব্রাজিল, সাউথ আফ্রিকা, ভারত এবং চীনের মতো দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ৷ ২০২১ সালের সম্মেলনে চীনের মতো ভারতও কয়লার ব্যবহার বন্ধের ঘোষণা দিতে অস্বীকৃতি জানায়৷ ব্রাজিল কার্বন ক্রেডিট মার্কেটের নিয়ম নির্ধারণে আলোচনা চালিয়ে যেতে চায়৷ সাউথ আফ্রিকা জীবাশ্ম থেকে সবুজ জ্বালানিতে রূপান্তরের জন্য সাড়ে আট হাজার কোটি ডলারের চুক্তি নিয়ে আলোচনা করবে ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে৷
ছবি: Anushree Fadnavis/REUTERS
জি-৭৭ + চীন
চীন এবং অন্য ৭৭টি দেশের এই জোট মনে করে ভিন্ন ভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব রয়েছে৷ কপ-২৭ সম্মেলনে এই গ্রুপের নেতৃত্ব দেবে বন্যায় বিপর্যস্ত পাকিস্তান৷ এই গ্রুপের অন্যতম দাবি, ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ নিয়ে একটি স্থায়ী তহবিল গঠন করা৷
ছবি: AFP/Getty Images/A. Ali
আমব্রেলা গ্রুপ
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে থাকা উন্নত দেশগুলোর জোট এটি৷ এতে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, জাপান, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো৷
ছবি: Getty Images/AFP/C. Triballeau
আফ্রিকা গ্রুপ
জাতিসংঘের সদস্য আফ্রিকার দেশগুলোর দাবি, আরো বেশি জলবায়ু অর্থায়ন৷ উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিদ্যুৎ সক্ষমতা বাড়াতে জীবাশ্ম জ্বালানি প্রয়োজন বলেও মনে করে এই গ্রুপ৷ মিশরসহ বেশকিছু আফ্রিকান দেশ রূপান্তর জ্বালানি হিসাবে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত গড়ে তুলতে চায়৷ রাশিয়া থেকে আমদানি করা গ্যাসের বিকল্প হিসাবে ইউরোপকে এই গ্যাস সরবরাহও করতে চায় দেশগুলো৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/N. Manie
ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা ৫৮টি দেশের এই গ্রুপে রয়েছে বাংলাদেশও৷ এই গ্রুপের প্রধান দাবি হচ্ছে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’-এর ভিত্তিতে ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর জোট
এই জোট আওসিস নামেও পরিচিত৷ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উপকূল ক্ষয়ের কারণে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে এই দেশগুলো৷