বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় গত ১৩ আগস্ট চার সন্তানের এক জননীর লাশ হাসপাতালে ফেলে পালিয়ে যান স্বামী। ১৭ আগস্ট স্ত্রীকে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে খুন করেন এক স্বামী। নারীর এমন মৃত্যুর খবর আসছে নিয়মিত!
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ বহু বছর ধরেই এইসব নারী নিপীড়ন চলছে৷ তবে অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে নারীর প্রতি যৌন নিপীড়ন, হয়রানি, হিংসা–বিদ্বেষসহ বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নের ঘটনা বেড়ে চলেছে বলে অভিযোগ তুলছে বিভিন্ন সংগঠন৷ এমনকি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে কটূক্তির পরেও সরকারের কোনো প্রতিবাদ চোখে পড়েনি৷ছবি: Evgeniia Gordeeva/Zoonar/picture alliance
সিলেটের গোলাপগঞ্জে ১৮ জুন স্ত্রীকে হত্যা করে পুকুরে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্বামীর বিরুদ্ধে। এপ্রিলে পারিবারিক কলহের জেরে স্ত্রী, সন্তান ও স্ত্রীর বড় বোনকে হত্যা করে লাশ তিনটি বস্তাবন্দি করে মাটিচাপার ঘটনা ঘটে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে।
একটি দুটি নয়, পারিবারিক সহিংসতার এমন ঘটনা রোজ ঘটছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, দেশে যেসব অপরাধের ঘটনায় মামলা হয়, সেই তালিকায় নারী ও শিশু নিপীড়ন সবার ওপরে।
গুগলে ২১ আগস্ট বিকেল পাঁচটায় ‘স্ত্রীকে হত্যা' লিখে বাংলায় সার্চ দেওয়ার পর এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে এই সংক্রান্ত ঘটনা ও খবরের আট কোটি রেজাল্ট এসেছে। আর ‘স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যা' লিখে সার্চ দেওয়ার পর এসেছে ৪০ লাখ।
‘চট্টগ্রামে মসলা বাটার নোড়া (শিল) দিয়ে আঘাত করে গৃহবধূকে হত্যা', ‘সিলেটেঅন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে পেট্রোল ঢেলে আগুন', ‘স্ত্রীকে হত্যা করে লাশে আগুন', ‘স্ত্রীকে হত্যা করে থানায় স্বামী' এমন সব বর্বরতার অসংখ্য খবর যেগুলো নারীদের ট্রমাগ্রস্ত করে ফেলতে পারে।
পারিবারিক সহিংসতার শেকড় এবং বিস্তার
18:51
This browser does not support the video element.
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও)-র এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের যেসব দেশে স্বামী বা সঙ্গীর হাতে নারী নির্যাতনের হার বেশি সেই তালিকায় বাংলাদেশ চতুর্থ৷ বিশ্বের ১৬১টি দেশ ও অঞ্চলে ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নারী নির্যাতনের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৭ মাসে দেশে ৩৬৩টি পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৩২২ জনের। এর মধ্যে ২০৮ জন নারী ও শিশু। আর আত্মহত্যা করেছেন ১১৪ জন।
সবচেয়ে বেশি হত্যার ঘটনা ঘটেছে স্বামীর হাতে—১৩৩ জন নারী। স্বামীর পরিবারের সদস্যদের হাতে খুন হয়েছেন ৪২ জন। আর ৩৩ জন হত্যার শিকার হয়েছেন নিজ পরিবারের সদস্যদের হাতে।
আসক-এর ২০২৪ সালের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে যেখানে প্রতি মাসে গড়ে ৪৩ টি পারিবারিক সহিংসতার খবর গণমাধ্যমে এসেছে, ২০২৫ সালে সেখানে ৫১ টি পারিবারিক সহিংসতার খবর এসেছে।
২০২৪ সালে যেখানে পুরো বছরে ৪০১ টি ধর্ষণের খবর ছিল, সেখানে এই বছরের সাত মাসেই ৪৯২ টি ধর্ষণ আর ১৭২ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। এর মধ্যে ২৪ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে আর ছয়জন আত্মহত্যা করেছেন। আর ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনার শিকার হয়েছেন অন্তত ১৭২ জন।
এ ছাড়াও এ বছর অন্তত ৫১ টি যৌতুক নিয়ে নিযাতনের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে অন্তত ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এমনকি এসিড নিক্ষেপ করার অন্তত সাতটি ঘটনাও ঘটেছে।
আসক-এর এসব তথ্য বাংলাদেশের প্রধান ১০-১৫ টি গণমাধ্যম থেকে নেওয়া। বাস্তব ঘটনা আরো বেশি, যেগুলো গণমাধ্যমে আসে না, মামলাও হয় না। কাজেই বাংলাদেশে পারিবারিক সহিংসতার কত ঘটনা ঘটে তার পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে যত অপরাধের ঘটনায় মামলা হয়, তার শীর্ষে নারী ও শিশু নিপীড়ন। ২০২৪ সালে নারী ও শিশু নিপীড়নের ঘটনায় ১৭ হাজার ৫৭১ টা মামলা হয়েছে। অপরাধ ও মামলার সংখ্যার দিক থেকে এটি সর্বোচ্চ।
পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে গেল কেন?
গত ৭ মাসে পারিবারিক সহিংসতায় ৩২২জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শুধু স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন ১৩৩জন নারী। পারিবারিক সহিংসতা কি হঠাৎই বেড়েছে? কেন? এ বিষয়ে ডয়চে ভেলেকে নিজেদের মতামত জানিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি, পেশার মানুষ৷
এই সরকার যখন অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিভিন্ন ধারা সংশোধন করে শাস্তি কমিয়ে দিচ্ছে, তখন অন্যায়ের প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। যেমন, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে আগে শারীরিক সম্পর্ক করলে তার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কিন্তু এই সরকার এটা কমিয়ে ৭ বছর কারাদণ্ড করে দিয়েছে। যৌতুকের ধারাগুলোও সংশোধন করা হয়েছে। এসব কারণে পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে।
ছবি: Samir/DW
নারীদের উপর নির্যাতনকে এই সরকার কখনো মব, কখনো ন্যায্য ক্ষোভ বলছে: নুজিয়া হাসিন রাশা, শিক্ষার্থী
পরিসংখ্যান বলছে, অভ্যুত্থানের পর নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে গেছে। অথচ এই অভ্যুত্থান নারীদের হাত ধরেই হয়েছে। টার্নিং পয়েন্টে নারীরা ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এখন নারীরাই সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত। নারীদের উপর নির্যাতনকে এই সরকার কখনো মব, কখনো ন্যায্য ক্ষোভ বলছে। ফলে এরা দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। এই সরকার নারীদের কর্তৃত্বের জায়গায় রাখেনি। বৈষম্য বিরোধী যে কন্ঠস্বর, সেটা দিনে দিনে নাই হয়ে যাচ্ছে।
ছবি: Samir/DW
এমন পদক্ষেপ দেখছি না যে কারণে মানুষের মধ্যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা তৈরি হবে, ফলে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে: নূর খান লিটন, মানবাধিকার কর্মী
সমাজে সব ধরনের অপরাধের মাত্রা বাড়ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। পরিবার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত সব স্তরে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করছে। অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। দৃশ্যমান এমন কোনো পদক্ষেপ দেখছি না যে কারণে মানুষের মধ্যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা তৈরি হবে। ফলে পারিবারিক সহিংসতাসহ অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।
ছবি: Samir/DW
মূলত বিচারহীনতার কারণে যে কোনো অপরাধ বাড়ে, তার প্রতিফলন আমরা দেখছি: তাসনিম আফরোজ ইমি, শিক্ষার্থী
এক বছরে বিচারব্যবস্থা বা আইন-শৃঙ্খলার যে অবস্থা, সেকারণে পারিবারিক সহিংসতা বা নারী নির্যাতন বলেন, সেটা বেড়ে যাচ্ছে। এই সরকার কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। মূলত বিচারহীনতার কারণে যে কোনো অপরাধ বাড়ে, তার প্রতিফলন আমরা দেখছি। অস্থিতিশীল পরিস্থিতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ থাকেন নারীরা। মব, বিচারহীনতা, আইনশৃঙ্খলা সবকিছুই একটার সঙ্গে আরেকটা যুক্ত। বর্তমান সরকারের সক্ষমতা নিয়েও আমার প্রশ্ন আছে।
ছবি: Samir/DW
আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলে পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা কমতে থাকবে: জামিউল আহসান সিপু, সাংবাদিক
নারীর প্রতি পুরুষের, পুরুষের প্রতি নারীর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হওয়ার কারণে পারিবারিক সহিংসতা বা নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলেই পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা অপেক্ষাকৃতভাবে কমতে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।
ছবি: Samir/DW
নারীরা বর্তমানে আরো বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছেন: মামসুরা আলম, ছাত্রদল নেত্রী
নারীদের প্রতি সহিংসতা বা পারিবারিক সহিংসতা অন্য যে কোনো ধরনের অপরাধের থেকে আলাদা। নারীরা বর্তমানে আরো বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছেন। এই কারণে যেমন পরিবারে, তেমনি বাইরেও মবের শিকার হচ্ছেন, হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। কয়েকদিন আগেও দেখলাম একজন নারীর পোশাক ধরে কয়েকজন পুরুষ টানাটানি করছে, সেটা আবার ভিডিও করা হচ্ছে। আশপাশে শত শত মানুষ, কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করছে না। এসব কারণেও নারীরা আরো বেশি অরক্ষিত হয়ে পড়ছে।
ছবি: Samir/DW
পথে-ঘাটে নারীকে পেটাচ্ছে, সরকার যেন চুপ করে তাকিয়ে আছে: শরীফা বুলবুল, সাংবাদিক
মহাভারতে দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের মধ্য দিয়ে যে নারীত্বের অবমাননা হয়েছে, এখনও যেন সেই অবস্থা চলছে। এটা না থামার কারণ হচ্ছে বিচারহীনতা। এ যাবৎ কোনো নারী নির্যাতনের সঠিক বিচার আমরা পাইনি। এই সরকারের আমলে বেশি অরক্ষিত হয়ে পড়েছে নারীরা। পথে-ঘাটে নারীকে পেটাচ্ছে, সরকার যেন চুপ করে তাকিয়ে আছে। আমরা এখন রাস্তায় বের হতেই ভয় পাচ্ছি।
ছবি: Samir/DW
আর্থিক অচ্ছলতা এবং অনেক বেশি মোবাইলে আসক্তির কারণে অনেক পরিবারে অশান্তি হচ্ছে: মো. হানিফ, গার্মেন্টস কর্মী
আর্থিক অচ্ছলতার কারণে পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে। মানুষের হাতে টাকা নেই, আর টাকা না থাকার কারণে পরিবারে অশান্তি শুরু হয়। এর সঙ্গে আছে মোবাইল ফোন। অনেক বেশি মোবাইলে আসক্তির কারণেও অনেক পরিবারে অশান্তি হচ্ছে।
ছবি: Samir/DW
কোনো ধরনের শাস্তির নজির না থাকার কারণে নারী নির্যাতন এত বেড়ে গেছে: তানজিলা তাহসীন, সাংবাদিক
শুধু তো নারী নয়, শিশুরাও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এর সবচেয়ে বড় দায় প্রশাসনের। কোনো ঘটনাতেই প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। কোনো ধরনের শাস্তির নজির না থাকার কারণে নারী নির্যাতন এত বেড়ে গেছে। নারীর পোশাক নিয়ে কটুক্তির কারণে যাকে গ্রেপ্তার করা হলো, তাকে আবার জেল থেকে বের হওয়ার পর ফুলের মালা দেওয়া হচ্ছে। লঞ্চ ঘাটে দুই নারীকে বেল্ট দিয়ে পেটানো হচ্ছে। অথচ প্রশাসন কোনো ব্যবস্থাই নিলো না।
ছবি: Samir/DW
এই সরকারের সময় আইনের শাসন বলতে কিছু নেই: অনিকা বিনতে আশরাফ, শিক্ষার্থী
মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে নারী নির্যাতন বেড়ে যাচ্ছে। নারীর উপর প্রভাব বিস্তার করার প্রবণতা থেকেও নির্যাতন হচ্ছে। এই সরকারের সময় আইনের শাসন বলতে কিছু নেই। এখানে যে কেউ চাইলেই মব সৃষ্টি করতে পারছে। এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই হচ্ছে না। এইসব কারণে নির্যাতনকারীরা সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন।
ছবি: Samir/DW
10 ছবি1 | 10
২০২৫ সালে এই সংখ্যা আরো বেশি। নারী ও শিশু নিপীড়নের এ বছরের জানুয়ারিতে এক হাজার ৪৪০টি, ফেব্রুয়ারিতে এক হাজার ৪৩০টি, মার্চে ২০৫৪টি, এপ্রিলে দুই হাজার ৮৯টি, মে মাসে দুই হাজার ৮৭টি, জুন মাসে এক হাজার ৯৩৩ টি এবং জুলাইতে দুই হাজার ৯৭ টি মামলা হয়েছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে জাতীয় হেল্পলাইন ১০৯ নম্বর রয়েছে। প্রতিদিন এ সেন্টারে গড়ে সাত হাজার কল আসে বলে জানা গেছে। কেউ উদ্ধারের সহযোগিতা চেয়ে, কেউ কল দেন তথ্য পেতে। আবার অনেক কিশোরীই বাল্যবিয়ে রোধে সহযোগিতা পেতে কল দেয়। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে চালু করা হেল্পলাইন ১০৯-এ আসা ফোনকলের অর্ধেকই হলো পারিবারিক সহিংসতাকেন্দ্রিক। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ হেল্পলাইন পরিচালনা করে থাকে।
গত বছর ১০৯ হেল্পলাইনে ১৯ লাখ ৪৫ হাজার ৪২৬ ফোনকল আসে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কল আসে জুলাইয়ে– ৮২ হাজার ৭১টি। এ ছাড়া ২০২৪ সালে পারিবারিক সহিংসতা সম্পর্কিত ৪ লাখ ৬০ হাজার ৩৫৮টি ফোনকল ছিল। বাকি কলগুলো ছিল শারীরিক হেনস্তা, অপহরণের ঘটনায় সাহায্য চেয়ে কল, যৌন হেনস্তা, বাল্যবিয়ে, অগ্নিদগ্ধের ঘটনায় সাহায্য চেয়ে কল, মানসিক নির্যাতন, পাচার, এসিডদগ্ধের ঘটনা এবং অন্যান্য অভিযোগ সম্পর্কিত। অর্থাৎ, গত বছর সবচেয়ে বেশি কল আসে পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারীদের। দিনে গড়ে এ সম্পর্কিত কল এসেছে ১ হাজার ২৬১টি।
জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯'-এর তথ্য অনুসারে, জানুয়ারি থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সাড়ে ৮ মাসে নারী নির্যাতনের ঘটনায় ১৭ হাজার ৩৪১টি কল এসেছে। এর মধ্যে পারিবারিক নির্যাতনের অভিযোগে কল এসেছে ৯ হাজার ৭৪৬টি। এসব কলের মধ্যে শুধু স্বামীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এসেছে ৯ হাজার ৩৯৪টি।
এসব পরিসংখ্যানই বলে দেয় পারিবারিক সহিংসতার চিত্র কতটা ভয়াবহ বাংলাদেশে আর কতটা বিপদে আছে এখানকার নারীরা। আর বিবাহবিচ্ছেদকে যেহেতু এখানে নেতিবাচক ভাবা হয়, ফলে মেয়েদের পরিবার চায় যেভাবেই হোক মেয়ে যেন সংসার টিকিয়ে রাখেন। সন্তান বা পরিবারের কথা ভেবে এই সংসার টিকিয়ে রাখার যে চেষ্টা নারীরা করেন, তাতে কি নির্যাতন থেমে থাকে?
ফাহমিদার কথাই ধরুন। রাজধানীর ইস্কাটনের বাসিন্দা সৈয়দ আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ও নাজমা বেগমের দুই মেয়ের মধ্যে বড় ছিলেন ফাহমিদা (২৬)। তিনি ভিকারুননিসা নূন স্কুলে পড়তেন। স্কুলে খেলাধুলাসহ সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু বিয়ের পর তার আর পড়াশোনা এগোয়নি। প্রায় এক যুগের সংসারে চার সন্তানের জন্ম হয়। ১৩ আগস্ট মধ্যরাতে ফাহমিদার মৃত্যু হয়।
নিহত ফাহিমদার পরিবারের অভিযোগ, সিফাত প্রায়ই ফাহমিদাকে মারধর করতেন। চার সন্তানের কথা ভেবে ফাহমিদা সংসারে মানিয়ে চলছিলেন। কিন্তু ১৩ আগস্ট তাকে মেরে ফেলা হলো। সেদিন রাতে কী ঘটেছিল তা পরিবারের সদস্যরা জেনেছেন ফাহমিদার ১১ বছর বয়সি বড় সন্তানের কাছ থেকে। পরিবারটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, রাত সাড়ে ১১টার দিকে ফাহমিদা রান্না করছিলেন। সে সময় বাইরে থেকে আসেন স্বামী সিফাত। দুজনের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয়। ফাহমিদাকে মারধর শুরু করেন সিফাত। ফাহমিদা বাঁচার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে তাকে ঘরের কক্ষে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন সিফাত। দিবাগত রাত প্রায় দুইটার দিকে ফাহমিদার পরিবারকে ফোন করে তিনি বলেন, ‘‘কেয়া (ফাহমিদার ডাকনাম) খুবই অসুস্থ, আপনারা দ্রুত বাসায় আসেন।'' প্রথমে পরিবারের সদস্যদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে পান্থপথের একটি বেসরকারি হাসপাতালে যেতে বলা হয়। হাসপাতালে গিয়ে মা-বাবা দেখেন, ফাহমিদা বেঁচে নেই। লাশ হাসপাতালে রেখে পালিয়ে যান সিফাত।
ধর্ষণ প্রতিরোধে করণীয় যা হতে পারে
ধর্ষণসহ নারীর প্রতি বিভিন্ন সহিংসতা ঠেকাতে সরকার ও ব্যক্তি পর্যায়ে কী করা যেতে পারে এবং কী করা উচিত, সে বিষয়ে বিভিন্ন পেশার নারীদের সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে৷
ছবি: DW
নাহিদা আকতার, বিজনেস ম্যানেজার
একটি সমাজের শুরু হয় পরিবার থেকে৷ পারিবারিক শিক্ষা অনেক মেয়ের জীবন বাঁচাতে পারে৷ ছেলেমেয়ে সবাইকে এক ছাদে এনে যদি মানবতা, সম্মান আর সমতার পাঠ শেখানো যেত, তাহলে হয়তো ধর্ষণের হাত থেকে অনেক মেয়ের জীবন বাঁচত৷
ছবি: DW
তনুশ্রী, সংগীত শিল্পী
বিচারহীনতার সংস্কৃতি আর সমাজের নিরবতা ধর্ষণের মতো অপরাধকে উৎসাহিত করছে৷ ধর্ষণ প্রতিহত করতে প্রয়োজন অপরাধীর কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যেন সমাজে সচেতনতা বাড়ে, অপরাধীরা আতঙ্কে কাঁপেন আর ভিকটিমরা পান আশার আলো৷
ছবি: DW
ড. নাভিন মুরশিদ, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
ধর্ষণ ‘যৌন ইচ্ছা’ নয়, এটি ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করার নৃশংস হাতিয়ার। এর শিকার কেবল নারীই নয়, শিশু ও পুরুষরাও হন। আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ একদিকে নারীদের ছোট করে দেখে, অন্যদিকে পুরুষদের ‘জোর-জবরদস্তি’ করাকে পুরুষত্ব এবং অধিকার হিসেবে ভাবতে শেখায়—যার কারণে নারীপুরুষ নির্বিশেষে অধিকার খাটাতে ধর্ষণ ব্যাবহার করা হয়। মানুষের মধ্যে অন্যের ‘না’-কে সম্মান জানানোর মানসিকতা তৈরি হয় না।
ছবি: DW
ডাঃ তানজির রশিদ সরণ, মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ
ধর্ষণ প্রতিরোধের জন্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সম্মিলিত ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা দরকার৷ সবার আগে দরকার প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর প্রতি সম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিত করা৷ ধর্ষণ বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং সবার জন্য কঠোর বিচার নিশ্চিত করা৷ ধর্ষণের মতো এমন একটা গর্হিত অপকর্মের জন্য মৃত্যুদণ্ডই সঠিক কিনা এটা ভাববার বিষয়৷
ছবি: DW
কাজী নওশাবা আহমেদ, অভিনেত্রী, পরিচালক এবং সমাজকর্মী
শৈশব থেকেই নিপীড়ন শুরু হয় এবং অনেক সময় সেটি নিজের ঘরেই৷ আত্মীয়ের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার পর পরিবার শেখায় চুপ থাকতে৷ সমাজ লজ্জার বোঝা অপরাধীর নয়, ভুক্তভোগীর কাঁধে তুলে দেয়৷ এই সংস্কৃতি এখনো ভাঙেনি৷ রাষ্ট্র এখনও ধর্ষণের মতো অপরাধে এমন কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারেনি যা দেখে অপরাধী ভয় পাবে৷ এছাড়া বিনোদনের নামে এমন সব কনটেন্ট প্রচার হচ্ছে যা নারীকে অবমাননার মনোভাব উসকে দেয়৷
ছবি: DW
ডা. সিফাত নাহার, মেডিকেল অফিসার
সময়ে মেডিকেল পরীক্ষা না হওয়া তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া পরিচালনায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়৷ অনেক পুরুষই একজন নারীর সাফল্য বা তার স্বাধীন চলাফেরা মেনে নিতে পারে না৷ তখন তারা ধর্ষণকে হাতিয়ারের মতো ব্যবহার করে৷ আধুনিক প্রযুক্তির কারণে আমরা বিভিন্ন ধরনের বিকৃত বিনোদনের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি, যার ফলে ধর্ষণের মতো অপরাধ সংঘটনের প্রবণতা বাড়ছে৷ এই ধরনের অপরাধের শাস্তি সম্পর্কে রাষ্ট্রীয়ভাবে বেশি বেশি প্রচার করতে হবে৷
ছবি: DW
ইসাবা শুহরাত, সংগঠক, শেকল ভাঙার পদযাত্রা
ধর্ষণ প্রতিরোধে দরকার কাঠামোগত পরিবর্তন৷ এর মধ্যে থাকতে পারে বিচার-ব্যবস্থার সংস্কার৷ এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতসহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলকে সর্বোচ্চ কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক করা, ধর্মীয় উসকানি বা নারীবিদ্বেষী বক্তব্যের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে৷ আর ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড জনপ্রিয় দাবি হলেও এটি ভুক্তভোগীর জন্য আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে৷
ছবি: DW
মোছাম্মৎ নাছিমা আকতার, প্রোগ্রাম কর্ডিনেটর
ধর্ষণ প্রতিরোধে শিশু ও তরুণদের জন্য যৌন শিক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও আত্মরক্ষা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন, আলোকিত রাস্তাঘাট, গণপরিবহনে নিরাপত্তা এবং সিসিটিভির ব্যবহার বৃদ্ধি করা উচিত৷ বেশি বেশি করে অপরাধীর তথ্য প্রকাশ করা এবং শাস্তি এমন হওয়া উচিত যা ভবিষ্যতের অপরাধীদের জন্য একটি সতর্ক বার্তা হয়ে দাঁড়ায়৷
ছবি: DW
ইশরাত হাসান, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
জিরো টলারেন্স নীতিই হতে পারে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই সমাধানের পথ৷ ২০২০ সালে সরকারিভাবে আইনি সংশোধনের মাধ্যমে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের সংযোজন করা হয়েছিল৷ কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কঠোর আইন থাকলেও বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, প্রমাণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের আধুনিক পদ্ধতির অভাব, পুলিশের গাফিলতি ও তদন্তে অদক্ষতা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং ভিকটিম-ব্লেইমিং-এর কারণে ধর্ষণের ন্যায়বিচার নিশ্চিত হচ্ছে না৷
ছবি: DW
9 ছবি1 | 9
এমন ঘটনা রোজ কোথাও কোথাও না ঘটছেই, যেগুলো যে-কোনো নারীকে আতঙ্কিত করবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)-র যৌথ জরিপে (নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ ২০২৪) দেখা গেছে, দেশের ৭০ ভাগ নারী তাদের জীবদ্দশায় অন্তত একবার হলেও শারীরিক, যৌন, মানসিক ও অর্থনৈতিক সহিংসতার শিকার হন। পরিবারের অন্য সদস্যদের তুলনায় স্বামীর মাধ্যমে বেশি নির্যাতনের শিকার হন নারীরা।
আবার সঙ্গী বা স্বামীর হাতে নারীদের সহিংসতার শিকার হওয়ার হার দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় তুলনামূলক বেশি। সবচেয়ে বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটছে বরিশাল ও খুলনায়। তবে যেসব এলাকায় কম নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে, সেখানেও নির্যাতনের মাত্রা উচ্চ হারেই রয়েছে।
জীবনসঙ্গী বা স্বামীর মাধ্যমে সহিংসতার মাত্রা বেশি হলেও সহিংসতার শিকার নারীদের প্রায় ৬৪ শতাংশ তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সহিংসতার কথা কাউকে কখনো বলেননি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পরিবারের সুনাম রক্ষা করার আকাঙ্ক্ষা, সন্তানদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বেগ এবং এ ধরনের সহিংসতাকে ‘স্বাভাবিক' বলে মনে করার প্রবণতাসহ বিভিন্ন কারণ থেকে মূলত এই নীরবতা।
বাস্তবের পাশাপাশি, অনলাইনেও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। ‘সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন প্ল্যাটফর্ম'-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে সাইবার সহিংসতার শিকার হওয়াদের মধ্যে ৯৭ শতাংশই নারী ও শিশু।
নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে যে দশটি কাজ করতে পারেন
বিশ্বের সবদেশেই কমবেশি সহিংসতার শিকার হচ্ছেন নারীরা৷ জাতিসংঘের নারী বিষয়ক সংস্থা ইউএন উইম্যান নারীদের সুরক্ষায় সহায়তার দশটি উপায়ের কথা জানিয়েছে৷
ছবি: Daniel Mihaulescu/AFP/Getty Images
ভুক্তভোগীর কথা শুনুন
একজন নারী সহিংসতার শিকার হওয়ার পর মুখ খোলার অর্থ হচ্ছে, তিনি সেই সহিংস পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে প্রথম ধাপ অতিক্রম করেছেন৷ তখন সমাজের সবার উচিত তিনি যাতে তার কথা বলতে পারেন, সেরকম নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা এবং তার কথা শোনা৷ এক্ষেত্রে সহিংসতার শিকার নারীর পোশাক, যৌন পরিচয় বা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ নিয়ে কথা বলার মাধ্যমে ভুক্তভোগীকেই দায়ী করার চেষ্টার বিপরীতে অবস্থান নিতে হবে৷
ছবি: Maurizio Gambarini/dpa/picture alliance
পরবর্তী প্রজন্মকে শেখান
আমরা পরবর্তী প্রজন্মের সামনে যে উদাহরণগুলো তৈরি করবো সেগুলো ভবিষ্যতে লিঙ্গ, সম্মান এবং মানবাধিকার বিষয়ে তাদের মনোভাব সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে৷ যেসব প্রচলিত ধ্যানধারণায় ভুল আছে, সেগুলো সম্পর্কে তাদেরকে সচেতন করতে হবে৷ তাদের মধ্যে যে যেমন, তাকে সেভাবে গ্রহণের মানসিকতা তৈরি করতে হবে৷ পাশাপাশি পৃথিবী সম্পর্কে পরবর্তী প্রজন্মের মতামতও শুনতে হবে৷
ছবি: Aref Karimi/DW
ভুক্তভোগীর সহায়তা পাওয়ার সুযোগ তৈরি করুন
সহিংসতার শিকার হওয়া ব্যক্তি যাতে দ্রুত সহায়তা পেতে পারে সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে৷ দ্রুত সহায়তা বলতে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র, হটলাইন, পরামর্শের মতো বিষয়গুলো, যাতে ভুক্তভোগীর নাগালের মধ্যে থাকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. May
সম্মতির বিষয়টি বুঝতে হবে
একজন মানুষ মুক্তভাবে এবং উৎসাহের সাথে সম্মতি দিচ্ছেন কিনা সেটা নিশ্চিত করতে হবে৷ যৌনতায় একজন নারী সম্মতি দিচ্ছেন কিনা সে বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হবে৷ ‘‘সে এটা চেয়েছিল’’ বা ‘‘ছেলেরা এমনই’’ এ ধরনের কথাবার্তা বলে একজন নারীর সম্মতি প্রদানের বিষয়টি এড়ানোর সুযোগ তৈরি করা যাবে না৷
নিগ্রহের নানা রূপ আছে এবং নির্যাতনের কারণে ভুক্তভোগীর উপর মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক প্রভাব পড়তে পারে৷ আপনার যদি মনে হয় যে, আপনার কোনো বন্ধু নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তাহলে তাকে সহায়তার চেষ্টা করুন৷ আপনার যদি মনে হয় কেউ আপনাকে নিপীড়ন করছে, তাহলে তা প্রতিরোধে সহায়তা নিন৷
ছবি: Imago Images/Panthermedia
আলোচনা করুন
নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা হচ্ছে মানবাধিকার লঙ্ঘন, যা দশকের পর দশক ধরে ঘটছে৷ এই চর্চা বিস্তৃত হলেও অবধারিত নয়, যদি আমরা চুপ না থাকি৷ ফলে নারীর প্রতি সহিংতার বিপরীতে শক্তভাবে অবস্থান নিন৷
ছবি: Frank Hoermann/Sven Simon/imago images
প্রতিবাদ করুন
ধর্ষণ সংস্কৃতি হচ্ছে এমন এক সামাজিক পরিবেশ, যেখানে যৌন সহিংসতাকে স্বাভাবিক এবং গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ যুগ যুগ ধরে চলে আসা লিঙ্গ-বৈষম্য আর লিঙ্গ ও যৌনতা বিষয়ক ভ্রান্ত ধারণার কারণে বিষয়টি এমন হয়েছে৷ ধর্ষণ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে সবার উদ্যোগী হতে হবে৷
ছবি: Christin Klos/dpa/picture alliance
নারী বিষয়ক সংগঠনগুলোকে সহায়তা করুন
নারী অধিকার এবং সহিংসতার বিরুদ্ধে কাজ করা স্থানীয় সংগঠনগুলোকে সাধ্যমতো সহায়তা করতে পারেন৷ জাতিসংঘের নারী বিষয়ক সংস্থা ইউএন উইমেন এই বিষয়ক স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কাজ করছে৷
ছবি: Asif Hassan/AFP/Getty Images
জবাবদিহিতা নিশ্চিত করুন
কর্মক্ষেত্রে বা জনপরিসরে যৌন নিপীড়নসহ সহিংসতা নানাভাবে ঘটতে পারে৷ আপনার সামনে আপত্তিকর কিছু ঘটলে প্রতিবাদ করুন৷ এভাবে সবার জন্য নিরাপদ একটি পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করতে পারেন আপনি৷
ছবি: Beata Zawrzel/NurPhoto/picture alliance
পরিসংখ্যান দেখুন এবং আরো দাবি করুন
লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হলে বিষয়টি আমাদের বুঝতে হবে৷ আর এজন্য এ সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত জানলে সে অনুযায়ী উদ্যোগী হওয়া সম্ভব
ছবি: Michael McCoy/Reuters
10 ছবি1 | 10
বাংলাদেশ বহু বছর ধরেই এইসব নারী নিপীড়ন চলছে৷ তবে অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে নারীর প্রতি যৌন নিপীড়ন, হয়রানি, হিংসা–বিদ্বেষসহ বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নের ঘটনা বেড়ে চলেছে বলে অভিযোগ তুলছে বিভিন্ন সংগঠন৷ এমনকি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে কটূক্তির পরেও সরকারের কোনো প্রতিবাদ চোখে পড়েনি৷
আসলে এই দেশের সমাজ কাঠামোতে পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং কর্তৃত্বের ধারণা এতটাই শক্তিশালী যে নারীর প্রতি সহিংসতাকে এখানে ‘স্বাভাবিক' মনে করা হয়৷ আবার অপরাধের বিচার হয় না বলে বিশেষ করে সরকাররের নির্লিপ্ততায় এই ধরনের ঘটনা আরো বাড়ছে। বিশেষ করে গত এক বছরে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এক বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণের ভয়াবহতা অতীতের সব মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। একের পর এক পারিবারিক সহিংসতার ঘটনায় ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করে নিয়মিত বিবৃতি ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে বিভিন্ন সংগঠন। তারা বলছে, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই অপরাধীরা বারবার এমন নৃশংস অপরাধ করার সাহস পাচ্ছেন।
প্রশ্ন হলো, এই সমস্যার সমাধান কী? আসলে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করতে হলে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, উপাসনালয়সহ সর্বত্র সচেতনতা জরুরি। সহিংসতাকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেওয়ার বা চুপ থাকার সংস্কৃতি ভাঙতে হবে। পাশাপাশি প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগ। রাষ্ট্রকেই এসব বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে।
নারীকে সুরক্ষা দিতে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০' এবং ‘ঘরোয়া সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০' সহ একাধিক আইন আছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ অনুযায়ী, স্বামীর দ্বারা স্ত্রীকে শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, মারধর, পুড়িয়ে দেওয়া কিংবা যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনের অভিযোগে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা যায়। কাজেই নির্যাতিত হলে মামলা করতে হবে। আর নির্যাতনের বিষয়গুলো গোপন না রেখে ছবি, অডিও, ভিডিও, চিকিৎসা রিপোর্ট, প্রতিবেশীর সাক্ষ্য ইত্যাদি সংরক্ষণ করা জরুরি। কারো আদালতে যাওয়ার আর্থিক সামর্থ্য না থাকলে জেলা ও উপজেলা লিগ্যাল এইড অফিস, নারী সহায়তা কেন্দ্র বা বেসরকারি সংগঠনের মাধ্যমে বিনামূল্যে আইনি সহায়তা যেতে পারেন।
মনে রাখতে হবে, পারিবারিক সহিংসতা কোনো ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বিষয় নয়, এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ এবং এগুলো সামাজিক নৈরাজ্য। কাজেই সামাজিক সচেতনতা ও সামাজিক প্রতিরোধ জরুরি। মনে রাখতে হবে, নারী শুধু একা বা পরিবার নয়, গোটা সমাজ ও দেশের অর্ধেক। এই শক্তিকে দমিয়ে রাখা মানে দেশ ও জাতি পিছিয়ে যাওয়া। কাজেই নারীর প্রতি পারিবারিক এই সহিংসতার কাছে হার না মেনে প্রতিরোধ গড়ে তোলাই সময়ের দাবি, যাতে প্রতিটি নারী মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে। আর পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ রাষ্ট্র সরকার সবাইকে এই দায়িত্ব নিতেই হবে।