‘বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক দায়মুক্তি পেয়েছে’
১৩ এপ্রিল ২০২২
২০২১ সালে বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যাপক দায়মুক্তি দেয়ার খবর পাওয়া গেছে বলে মঙ্গলবার জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র৷ নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক হত্যা ও নিপীড়ন তদন্তে বাংলাদেশ সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বলেও জানিয়েছে দেশটি৷
বিজ্ঞাপন
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মঙ্গলবার প্রকাশ করা ২০২১ সালের ‘কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিসেস’ প্রতিবেদনে এসব মন্তব্য করা হয়৷ রিপোর্টে বাংলাদেশসহ ১৯৮টি দেশ ও অঞ্চলের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়৷
রিপোর্টের বাংলাদেশ অংশের সারসংক্ষেপের শুরুতে বলা হয়, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের চোখে অবাধ ও নিরপেক্ষ বলে বিবেচিত হয়নি৷ নির্বাচনের সময় বিরোধী দলের পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো এবং ব্যালট বাক্স ভর্তি করার খবর পাওয়া গেছে৷
২০২১ সালে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব বিশ্বাসযোগ্য খবর পাওয়া গেছে তার একটি তালিকা প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র৷ এর মধ্যে আছে:
অবৈধ ও নির্বিচারে হত্যা, যার মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড রয়েছে
গুম
সরকার বা সরকারের পক্ষে কাজ করা এজেন্ট কর্তৃক অমানবিক ও পাশবিক অত্যাচার
নির্বিচারে গ্রেপ্তার বা আটক
রাজনৈতিক বন্দি
অন্য দেশে বাস করা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রতিশোধ গ্রহণ
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে মারাত্মক সমস্যা
একজন ব্যক্তির অপরাধের জন্য পরিবারের সদস্যদের শাস্তি দেয়া
বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের উপর গুরুতর বিধিনিষেধ
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা কিংবা সহিংসতার হুমকি
সাংবাদিকদের অযৌক্তিকভাবে গ্রেপ্তার করা
ইন্টারনেট স্বাধীনতার উপর গুরুতর বিধিনিষেধ
শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়া ও মিলিত হওয়ার উপর উল্লেখযোগ্য হস্তক্ষেপ
বেসরকারি ও সুশীল সমাজের সংগঠন পরিচালনা ও তহবিল জোগাড়ের ক্ষেত্রে অত্যধিক সীমাবদ্ধ আইন
সরকারি দুর্নীতি
অভ্যন্তরীণ মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে হয়রানি ইত্যাদি
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে৷ আসক জানিয়েছে, গত বছর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে কমপক্ষে ৮০ জন নিহত হয়েছেন৷ এর মধ্যে ৫১ জন ‘বন্দুকযুদ্ধ’ কিংবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে ‘ক্রসফায়ারে’ মারা গেছেন৷
আরেক মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের মতে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭১টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে৷ এর মধ্যে ৩৫ জন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে৷ ৩০ জনকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি করেছে এবং ছয় জন কারা হেফাজতে থাকা অবস্থায় নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন৷
জেডএইচ/কেএম (মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়)
তথ্য, পরিসংখ্যানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
একটি মানবাধিকার সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে গত দুই দশকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন৷ তবে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধের মতো ঘটনাগুলো ঘটেনি৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Wire/M. Rakibul Hasan
দুই দশক
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০০১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তিন হাজার ৩৬৪ জন৷ বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে এ ধরনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছিল ২০০৫-০৬ সালে৷ ২০০৫ সালে ৩৭৭ জন এবং ২০০৬ সালে ৩৬২ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন৷ তবে আরেক মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাবে দুই দশকে এমন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা চার হাজারের বেশি৷
ছবি: Shahidul Alam/Drik/Majority World
আওয়ামী লীগের ইশতেহার
সেসময় ক্রসফায়ার নামে পরিচিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ছিল আওয়ামী লীগের৷ ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে দলটি এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেয়৷ সুশাসন প্রতিষ্ঠার অনুচ্ছেদে ৫.২ নং অঙ্গীকারে বলা হয়েছিল, ‘‘বিচারবিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে৷ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে৷’’
ছবি: Mustafiz Mamun
কথা রাখেনি সরকার
ক্ষমতায় এসে নির্বাচনী ইশতেহারে দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখেনি আওয়ামী লীগ সরকার৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বছরে ২০০ জনের বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন৷ ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে মারা গেছেন আড়াই হাজারের বেশি মানুষ৷ (২০১৮ সালের ডিসেম্বরের ছবি)
ছবি: picture-alliance/dpa/AP Photo/A. Nath
নির্বাচন ও ক্রসফায়ার
আসক এর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাংলাদেশ নির্বাচনী বছর ও তার আগের বছরে বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে৷ নির্বাচনের আগের বছর ২০১৩ সালে প্রতিমাসে গড়ে ২৭ জন বা মোট ৩২৯ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে৷ ২০১৮ সালের ৪৬৬ টি ঘটনা ঘটে যা আগের বছরের চেয়ে তিনগুণ বেশি৷ ২০১৯ সালে এমন ঘটনা ঘটেছে ৩৮৮ টি৷
ছবি: DW/A. Islam
২০২১ সাল নিম্নমুখী
আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২২২টি৷ সেখানে গত বছর এমন ঘটনা ঘটেছে মোট ৮০টি৷ এর মধ্যে ৩০টির সঙ্গে জড়িত র্যাব, ২৪টিতে পুলিশ, দুইটিতে র্যাব ও পুলিশ এবং ১৭টি ঘটনায় বিজিবির নাম এসেছে৷ ৪৮টি ক্ষেত্রেই গেপ্তারের আগে ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনা ঘটেছে৷
ছবি: Getty Images
নানা নাম
তবে এগুলোকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবে স্বীকার করে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ কখনও ক্রসফায়ার, কখনও বন্দুকযুদ্ধ কখনওবা এনকাউন্টার হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়ে বিবৃতি দেয়া হয় বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে৷ সম্প্রতি র্যাব দাবি করেছে তাদের সদস্যদের সঙ্গে ‘ধস্তাধস্তিতে’ গাজীপুরে এক ব্যক্তি মৃত্যু হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Wire/M. Rakibul Hasan
একরামুল হত্যা
২০১৮ সালে ২৬ শে মে র্যাবের ‘মাদক বিরোধী অভিযানে’ কথিত 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হন কক্সবাজারের কাউন্সিলর একরামুল হক৷ কিন্তু স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে নিহত হওয়ার আগ মুহূর্তের মোবাইলের কথোপকথন ফাঁস হওয়ার পর র্যাবের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ ওঠে৷ এই ঘটনায় একরামুলের পরিবার মামলা করতে পারছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: DW/S. Kumar Dey
মেজর সিনহা হত্যা
বাংলাদেশে বিচার বহিভূত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর একটি মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা৷ ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি৷ টেকনাফ থানার বহিষ্কৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ নয় পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড় বোন৷ ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে আরো শতাধিক এমন হত্যার অভিযোগও রয়েছে৷
ছবি: bdnews24
র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের এলিট ফোর্স হিসেবে পরিচিত র্যাব ও এর সাবেক-বর্তমান কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র৷ এই নিষেধাজ্ঞা দেয়ার আগের পাঁচদিনে ‘ক্রসফয়ারে’ পাঁচজন নিহত হয়েছেন৷ কিন্তু এরপর আর এমন ঘটনা ঘটেনি৷
ছবি: DW
সরকারের বক্তব্য
তবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে কিছু হয় না বলে বারবারই দাবি করে আসা হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে৷ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পরও সরকার এই কথা জোর দিয়ে বলে আসছে৷ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশে কোনো ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি৷ এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে কোনো প্রকার আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ না দিয়ে এমন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে৷’’