বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের তত্পরতা চোখে পড়ার মতো৷ তারা নির্বাচন নিয়ে মন্তব্যের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও সুশীল সমাজের সঙ্গে কথা বলছে৷ বিনিয়োগ ও নিরাপত্তার জন্য স্থিতিশীলতা চায় তারা৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা ২৩শে অক্টোবর থেকে তিন দিনের জন্য ভারত সফর করেছেন৷ তাঁর এই সফরকে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতকে তার অবস্থান আবারো পরিষ্কার করতে বলেছে৷ কারণ, বাংলাদেশে উভয় দেশের জন্যই ‘কমন ইন্টারেস্ট'-এর জায়গা আছে৷ আবার আছে কিছু বৈপরিত্যও৷ তাই তারা তাদের সেই স্বার্থের জায়গা সম্পর্কে পরস্পরকে পরিষ্কার করে দিতে চায়৷
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট থামছে না
আগামী বছরের সূচনায় জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু দুই মুখ্য রাজনৈতিক জোটের টানাপোড়েন অব্যাহত৷ অথচ দেশে-বিদেশে অনেকেই চান সংকট নিরসনে দুই বৈরী জোটের মধ্যে আলোচনা৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
ছবি: AP
দু’দলের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়েছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে৷ তবে মুখ্য বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়৷ তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, শাসক আওয়ামী লীগের কাছে যা সংবিধান লঙ্ঘনের সমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
জাতিসংঘ চায় সংলাপ
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই দুই বিবাদী জোটের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ মহাসচিব বান কি-মুন গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় নেতার প্রতি চলতি রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
হাসিনা চান সংসদে আলোচনা
জাতিসংঘ বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মহাসচিবের ফোনালাপের কোনো খুঁটিনাটি প্রকাশ করেনি৷ তবে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসিনা ‘‘জাতিসংঘের প্রধানকে জানিয়েছেন যে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন৷’’ বিরোধীপক্ষ যদি গোটা প্রসঙ্গটি সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব দেয়, তবে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন হাসিনা৷
ছবি: dapd
সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে বিএনপির ‘না’
বান কি-মুনের সঙ্গে ফোনালাপে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও সংকট সমাধানে সংলাপের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘‘বিরোধীপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না৷’’
ছবি: Reuters
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ও কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই পদ্ধতি বাতিল করে৷ বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে৷
ছবি: AP
জার্মানি সংলাপ সমর্থন করে
সংলাপকে বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে জার্মানি৷ ‘ঢাকা কুরিয়ার’ নামক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে বলেছেন, ‘‘দু’টি মুখ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলো বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের একমাত্র পথ৷’’
ছবি: DW/R. Manzoor
ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাক দিলেন
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস একটি ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ (নির্বাচনকালীন) সরকার’’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷ গত ২২ আগস্ট ইউনূস একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নির্বাচন অতি অবশ্য হওয়া উচিত এবং তা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)
হাসিনা সরকারের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু তা শাসকদল এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইসিটি এখন পর্যন্ত ছ’জন অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়েছে৷ বিরোধীপক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবিক উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নয়, পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইসিটি-র সমালোচনা করেছে৷ এইচআরডাব্লিউ বিবৃতিতে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ‘‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’’ ছিল৷ প্রতিক্রিয়া হিসেব সরকারি কৌঁসুলির তরফ থেকে এইচআরডাব্লিউ-এর বিরুদ্ধে আদালতের অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এইচআরডাব্লিউ-এর ‘‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’ রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ট্র্যাক রেকর্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষি খাতে সরকারের সাফল্যের খতিয়ান যাই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হাসিনা সরকারের অন্য সব সাফল্য ঐ একটি কেলেঙ্কারির আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ আগামী নির্বাচনেও পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রসঙ্গটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
অধ্যাপক আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও নিরাপত্তার জন্য দুই দেশের সাধারণ স্বার্থ আছে৷ তারা সেই স্বার্থ নিরাপদ রাখতে চায়৷ কোনো কারণে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা বাধাগ্রস্ত হলে দুই দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ বিশেষ করে, বাংলাদেশে মার্কিন এবং ভারতীয় বিনিয়োগ অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে৷ বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদের বিস্তার হলে পূর্ব-ভারতীয় রাজ্যগুলোর স্থিতিশীলতার জন্য তা বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে৷ আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস বিরোধী অবস্থানে বড় ধরণের ধাক্কা লাগবে৷ আফগানিস্তান, পাকিস্তানের পর বাংলাদেশেও একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তা জন্য হবে তাদের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ৷
অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ভারত একটি জটিল অবস্থানে আছে৷ বর্তমান সরকারের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক কারুর অজানা নয়৷ তাই ভারত নির্বাচন নিয়ে কথা বললেও যেমন দোষ, না বললেও দোষ৷ তাই বার বার ভারতকে বাংলাদেশ সম্পর্কে তার অবস্থান পরিষ্কার করতে হচ্ছে৷ তবে বাংলাদেশে জঙ্গি বা সন্ত্রাসবাদের উত্থানকে কোনোভাবেই ভালো চোখে দেখবে না ভারত৷
এদিকে, ড্যান মোজেনা এখন যুক্তরাষ্ট্রে আছেন৷ তিনি ১০ দিন পর ঢাকায় ফিরবেন৷ তিনি ব্যক্তিগত নয়, ‘অফিসিয়াল' কাজে যুক্তরাষ্ট্র গেছেন৷ ড. আহমেদ মনে করেন, মোজেনা যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় ফিরলে আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে যাবে৷ কারণ, নির্বাচনের বেশি দেরি নেই৷ আর নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দুই দল এখন মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে৷ ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং নিরাপত্তা – এই দুটি ইস্যু নিয়ে একটি অবস্থান নেবে যুক্তরাষ্ট্র৷ সেক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা চাইবে বলেই মনে করেন ড. অধ্যাপক ইমতিয়াজ৷