1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশের নীতিহীন ফুটবল এবং অন্ধকার ক্রীড়জগত

আজাদ মজুমদার
১৯ মে ২০২৩

সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ঠাঁই নেওয়া খেলাধুলার জন্য একটু কষ্টসাধ্যই৷ অপ্রত্যাশিত কিংবা বড় কোনো সাফল্য এলেই মূলত এটা ঘটে৷ অথবা খেলাধুলার কেউ যখন বড় ধরনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যায়৷

আবু নাঈম সোহাগ৷
দুর্নীতির অভিযোগে বাফুফে সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে একরকম প্যান্ডোরার বাক্সই খুলে দিয়েছে ফিফা৷ছবি: Abu Sadat

তবে জনপ্রিয় এবং সফল খেলা বলেই হয়তো ক্রিকেটের বিতর্ক গুলো যতোটা সামনে আসে, অন্য খেলার বিতর্ক গুলো সেভাবে আসে না৷ খেলার পাতার কোনো এক কোণে পড়ে থাকে৷ ক্রীড়াঙ্গনের বাইরেও সেসব নিয়ে তেমন একটা আলোচনা হয় না৷

কিছুদিন ধরে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কার্যক্রমগুলো বলতে হবে বিরল ব্যতিক্রম৷ দেশে তো বটেই, বিদেশেও তারা আলোচিত, সমালোচিত হচ্ছেন৷ নারী ফুটবল দলকে অলিম্পিক বাছাই পর্বে পাঠানোর ব্যর্থতা দিয়ে শুরু৷ তারপর সেটা নিয়ে বাফুফে সভাপতি কাজী সালাহউদ্দিন ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের অহেতুক বাহাস৷ বিষয়টা এখানেই থেমে গেলেও চলতো৷ থামেনি ঘটনার অব্যাবহতি পরেই ফিফার এক ঘোষণায়৷ না, সালাহউদ্দিন-পাপনের ঝগড়ায় ফিফা নাক গলায়নি৷ তারা যেটা করেছে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে তার প্রভাব অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী৷ দুর্নীতির অভিযোগে বাফুফে সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে একরকম প্যান্ডোরার বাক্সই খুলে দিয়েছে ফিফা৷ 

নিষেধাজ্ঞা ব্যক্তির বিরুদ্ধে হলেও এর সঙ্গে দেশের নাম জড়িয়ে থাকায় স্বভাবতই সমালোচনার ঝড় উঠেছে৷ বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে এতদিন যারা খুব একটা খোঁজ খবর রাখেনি তারাও এটা নিয়ে সমালোচনায় মুখর৷ এই সমালোচনাটা মোটেও অন্যায্য নয়৷ দেশের ফুটবলে যে অনেক কিছুই ঠিক-ঠাক চলছেনা, মাঠের ফলাফল দেখেই  কেবল এতদিন সবাই অনুমান করে এসেছেন৷ ফিফার নিষেধাজ্ঞা কিছু অনিয়মের দালিলিক এক প্রমাণ হিসেবে সবার কাছে হাজির হয়েছে৷ 

কোনো বিষয়ে কেবল একটা প্রমাণ যদিও সার্বিক চিত্র নির্দেশ করে না৷ ঘটনা বুঝতে আরো কিছু চাই৷ সোহাগ-কাণ্ডে বাফুফে যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে তাতেই অনিয়মের মাত্রাটা কিছুটা বোঝা যাচ্ছে৷ সোহাগ নিষিদ্ধ হওয়ার পরই তারা ঘটনা তদন্তে ১০ সদস্যের এক কমিটি করে৷ ভাবখানা এমন ফিফার কথায় তারা সবাই আকাশ থেকে পড়েছেন৷ ফিফার তদন্ত কয়েক বছর ধরে চললেও বাফুফে ভান ধরেছে এতদিনে এসে মাত্রই তারা এসব জেনেছে৷ তদন্ত চলতে সময় আইনজীবীসহ জুরিখ গিয়ে বাফুফে সম্পাদক আত্মপক্ষ সমর্থন করে এসেছেন৷ সেটাও নাকি বাফুফে নীতিনির্ধারকদের অগোচরে হয়েছে৷ 

তারা তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আরো একবার সব তদন্ত করে দেখা হবে৷ বাংলাদেশে তদন্ত-তদন্ত খেলা কোনো নতুন কিছু নয়৷ ছোটখাট সড়ক দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে গাছ থেকে পড়ে কেউ মারা গেলেও এদেশে তদন্ত কমিটি হয়৷ মানুষ জানতে চায় ভিকটিমকে গাছে তুললো তবে কে? বাফুফে সম্পাদক এখানে ভিকটিম নন, অভিযুক্ত৷ কিন্তু যে অপরাধে তাকে ফিফা শাস্তি দিয়েছে সেটাও আসলে গাছে না উঠলে করা যায় না৷ একটা তদন্ত তাই হতেই পারে, গাছে তবে তাকে তুললো কে? তবে  সমস্যা হচ্ছে, বেশির ভাগ তদন্তের ফলাফল এদেশে কেউই জানতে পারে না৷

কোনো বিষয়ে তদন্তের কথা শুনলে বাংলাদেশে মানুষের মনে আশার বদলে সন্দেহ বেশি জাগে৷ তদন্ত এদেশে কখনো কখনো হয়ে যায় ছোট ঘটনাকে সামনে এনে বড় কোনো সত্য আড়াল করার অপচেষ্টা৷ এখানেও সেই সন্দেহটা জাগছে এবং সেটা মূলত তদন্ত কমিটির আকার দেখে৷ অভিযোগ যতই গুরুতর হোক কোনো তদন্ত কমিটির আকার এখানে কখনো দুই অঙ্ক ছুয়েছে বলে খুব একটা শোনা যায় না৷

দুজন সদস্য কাজ করতে অপরাগতা প্রকাশ করায় সংখ্যাটা যদিও পরে আটে নেমে এসেছে৷ তা স্বত্বেও এটাকে মোটামুটি দশাসই তদন্ত কমিটিই বলা যায়৷ একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, কমিটির সব সদস্যই ফুটবল ফেডারেশনের কোনো না কোনো পদে আছেন৷ তো কি তদন্ত করবেন তারা? ফিফার তদন্তের পর সোহাগকে নিয়ে তাদেরই অধিভুক্ত আরেকটি সংস্থার তদন্ত বেমানান৷ আপাতত তাই ধরে নেওয়া যায়, সোহাগ-কাণ্ডে তার সঙ্গে আরো কেউ জড়িত কি-না সেটা বের করাই হবে এই তদন্ত কমিটির কাজ৷

এটাকেই বোধ হয় বলে শুটকির বাজারে বেড়াল চৌকিদার৷ সোহাগ যদি তার অপকর্মে কাউকে দোসর হিসেবে পেয়েও থাকেন সেটা ফেডারেশনের লোকজনেরই হওয়ার কথা৷ এখন তারাই যদি এর তদন্ত করে থাকে সেই দোসর কি আর খুঁজে পাওয়া যাবে?  মোটামুটি পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির দুই একজনকে এই দায়িত্ব দিলে অন্তত এটা বলা যেতে পারতো তদন্ত কাজে তাদের সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি নেই৷ কিন্তু ঢালাও ভাবে যখন ফেডারেশনের প্রায় সবাইকে তদন্ত কমিটির সদস্য করে দেওয়া হয় এটাকে উদ্দেশ্যমূলক ছাড়া আর কিছু বলার উপায় থাকে না৷

নিজেদের সদস্যদের দিয়ে যে কোনো তদন্ত যে ঠিকঠাক ভাবে হয় না সেটা বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফাও জানে৷ আর জানে বলেই এ বিষয়ে তারা কিছু নির্দেশনা আগেই দিয়ে রেখেছে৷ এই নির্দেশনা অনুসারে বাফুফের তিনটা উপ কমিটিতে নিজেদের কোনো লোকই রাখার সুযোগ নেই৷  এই তিন কমিটির একটি হচ্ছে এথিকস ও ফেয়ার প্লে কমিটি৷ সোহাগ-কাণ্ডের পর দেখা যাচ্ছে, ঘর কিংবা পর, কোনো লোক দিয়েই এই কমিটি করা হয়নি গত দুই বছর৷ অর্থাৎ, কাজী সালাহউদ্দিন চতুর্থ মেয়াদে দায়িত্বে আসার পর এই কমিটির কোনো অস্তিত্বই নেই, যদিও গঠনতন্ত্র অনুসারে এই কমিটি রাখতে তারা বাধ্য৷

কেন এথিকস কমিটি নেই, তার একটা ব্যাখ্যা সালাহউদ্দিন যদিও সংবাদ মাধ্যমে দিয়েছেন৷ বলেছেন, বিনে পয়সায় শ্রম দিবেন এমন লোক না-কি খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ তাছাড়া, আগের মেয়াদে যখন এই কমিটি ছিলো, তাদের তেমন কিছু করতে হয়নি৷ এবার তাই তারা এই কাজে তেমন তাগাদা অনুভব করেননি৷ যদিও সালাহউদ্দিনের আগের মেয়াদেও এই কমিটি আদৌ ছিলো কি-না, যদি থাকে সেটা ওবা কতো দিনের জন্য সেসব নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে৷ সোহাগ যাকে আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন সেই আজমালুল হক কেসি একসময় এই এথিকস কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে ছিলেন বলে শোনা যায়৷ কিন্তু তিনি দাবি করেছেন তিনি মাত্র বছর খানেক এই কমিটির দায়িত্বে ছিলেন, এখন আর নেই৷

বাফুফের মেয়াদ যদি চার বছরের হয়, তার উপ কমিটির মেয়াদ কিভাবে একবছর হয় সেটা কারো বোধগম্য নয়৷ এথিকস কমিটির কাজ নেই বলে সালাহউদ্দিন যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটাও অনভিপ্রেত৷ যে দেশে পাতানো খেলার দায়ে ক্লাব কর্তা, কোচ, খেলোয়াড় অনেকে এক সঙ্গে নিষিদ্ধ হয়ে যান, সে দেশের ফুটবলের সবাই নীতিবান এটা ভাবা কঠিন৷

আসলে অন্ধকার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে ফুটবলকে অনেক দিন ধরেই৷ এই অন্ধকার যে কেবল মতিঝিলের ফুটবল ভবনে তাও নয়৷ ফেডারেশনের অনেক কর্মকর্তার মনেও জেঁকে বসেছে অন্ধকার৷ ফেডারেশনে ঢোকার জন্য সাংবাদিকদের বাবার জুতার ছবি চাওয়া কিংবা অন্তর্বাস পরখ করার কথা তারা বোধকরি এজন্যই বলতে পেরেছেন৷

আজাদ মজুমদার, সাংবাদিকছবি: Mahmud Shanto

ফিফা এই অন্ধকারে আলো ফেলেছে বলেই ফুটবল সংশ্লিষ্ট অনেকের কদর্য চেহারাটা বেরিয়ে এসেছে৷ বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, সম্ভাবনাময় এমন আরো অনেক খেলা আছে যেখানে আলো ফেলার তেমন কেউ নেই৷ আর্থিক অনিয়মের সুযোগ অন্য সব খেলায় কম, কারণ ফুটবল ক্রিকেটের বাইরে অন্যদের হাতে তেমন অর্থই নেই৷ কিন্তু শৃঙ্খলা, নীতি-নৈতিকতা, যা-কিনা খেলাধুলার মূলমন্ত্র সেখানে যথারীতি অন্যরাও পিছিয়ে আছে৷

আর এই কারণেই অপার সম্ভাবনাময় আর্চার রোমান সানা নিষিদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন নারী সতীর্থের গায়ে তুলে৷ কমনওয়েলথ গেমস খেলতে গিয়ে নিজেদের ইভেন্ট ভুলে টেবিল টেনিস খেলোয়াড় চলে যাচ্ছেন আত্মীয় বাড়ী বেড়াতে৷ কিংবা নিজের ইভেন্টের আগে রাত জাগায় বাংলাদেশি বক্সারের বেড়ে যাচ্ছে রক্তচাপ৷

তবে বাংলাদেশের খেলাধুলায় এসব বিতর্ক এখন এক রকম গা সওয়া৷ ক্রীড়ামোদীদের রক্তচাপ এখন আর কোনো কিছুতেই বাড়ে না৷ দুই একটি ঘটনায় খেলোয়াড়েরা শাস্তি পান বটে৷ ফিফার মতো কঠোর কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকলে সোহাগের মতো দুএকজনও শাস্তি পান৷ কিন্তু বেশির ভাগ অপকর্ম আড়ালেই থেকে যায়৷ শাস্তির আওতার বাইরে থেকে যান এসব অপকর্মের ধারক-বাহকেরা৷ কখনো যুগ পেরিয়ে যায়, তারা রয়ে যান ধরা ছোঁয়ার বাইরে৷স্বপ্ন দেখেন চেয়ার আগলে রাখবেন আরো এক মেয়াদ৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

বাংলাদেশ