বার্লিনে বাংলাদেশ ফোরাম
২৬ এপ্রিল ২০১২দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও আধুনিক জাতিগঠন ইউরোপের মতো হয়নি৷ এখানে ব্রাহ্মণ-মোগল-পাঠান এবং ইংরেজি বা আরবি-উর্দু শিক্ষিত বাঙালি আর বৃহত্তর কৃষক-কারিগর-ব্রাত্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সমাজ ও জাত এক নয়৷ তার ওপর দেশে রাষ্ট্র ও নাগরিকদের মধ্যে ঔপনিবেশিক বৈষম্য, শাসক ও শাসিতের মধ্যে প্রভু ও অধীন সম্পর্ক, জাতীয় ও আঞ্চলিকের মধ্যে কেন্দ্র ও প্রান্তিক বিভাজন একটা নতুন মাত্রা দিয়েছে৷ এর ফলে কি জনগণের একটি বড় অংশের সম্মতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র এখানে কাজ করে না?
বিশ্ব ধনতন্ত্রের মধ্যে একটি প্রান্তিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ
বাংলাদেশের অন্যতম গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস বাংলাদেশ'-এর নির্বাহী পরিচালক মেঘনা গুহঠাকুরতার কথায়, ‘‘যে বিভাজনের কথা বলা হচ্ছে, সেটা নতুন কোনো বিভাজন নয়৷ তবে ইদানিংকালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে যেভাবে দাঁড়িয়ে আছে, সেটা একটি ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র৷ কিন্তু একই সঙ্গে এটা বিশ্ব ধনতন্ত্রের মধ্যে একটি প্রান্তিক রাষ্ট্র৷ তাই সেখানে অনেক নতুন নতুন শ্রেণি তৈরি হচ্ছে৷ কেউ কেউ হয়তো এটাকে উন্নয়ন বলবে৷ আবার অপরজন বলবে যে, এখানে উন্নয়নটা একটা দ্বন্দ্ব তৈরি করছে৷ এবং সেই নতুন ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে হয়তো প্রান্তিক জনগোষ্ঠী একটা দ্বন্দ্বে লিপ্ত হচ্ছে৷ আর সে কারণেই নতুন উন্নয়ন ধারার মধ্যে তারা শরিক হতে পারছে না৷''
তাই দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, অধিকার রক্ষা কিংবা দারিদ্র্য বিমোচন তো দূরের কথা – বহু ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নিজেই দখলদারদের সহযোগী হয়ে উঠেছে৷ গত এক শতকের উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের ফল যদি এই হয়, তাহলে আজ একে চ্যালেঞ্জ জানাবার সময় এসেছে বৈকি৷ বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে সহস্র বছরের বঞ্চনা, অপমান আর দাসত্বের ঘেরাটোপ থেকে বেরোনোর৷ কিন্তু তার জন্য হয়তো আগে রাজনীতি বুঝতে হবে৷ পেতে হবে শিক্ষা৷
শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দিতে হবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে
মেঘনা গুহঠাকুরতা জানান, ‘‘আমি বলবো যে বাংলাদেশের জনগণ রাজনৈতিকভাবে বেশ সচেতন৷ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে৷ তবে তারা এই সচেতনতা দিয়ে কী করতে পারে, কতোটুকু নিজেদের সংগঠিত করতে পারে – এ ব্যাপারটার এখানে ঘাটতি আছে৷ শিক্ষা অবশ্যই জরুরি৷ প্রশ্ন হলো, সেটা কোন ধরনের শিক্ষা? প্রত্যেকটা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীরও কিন্তু স্কুল-কলেজে যাওয়ার অধিকার আছে৷ কিন্তু বহুক্ষেত্রেই তাদের মাতৃভাষা বাংলা নয়৷ তাই তারা প্রাথমিক অবস্থাতেই অনেকটা পিছিয়ে পড়ছে৷ তাই সাধারণ উন্নয়নের মধ্যে দিয়ে এদেরকে সামনের দিকে নিয়ে আসা সম্ভব নয়৷ তাই যতক্ষণ না এদেরকে, বিশেষ করে নারী আর আদিবাসী বা প্রান্তিক গোষ্ঠীকে ‘ফোকাস' করে আমরা নতুন একটি শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারবো, ততক্ষণ নতুন প্রজন্ম কিন্তু একটি নতুন বাংলাদেশ দেখতে পারবে না৷''
উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে এনজিও, মিডিয়া
বলা বাহুল্য, তিরিশের দশক থেকে ভূমি সংস্কার, জাতীয় মুক্তি, সার্বভৌমত্ব, সাম্য, জাতীয়তাবাদ, শিল্পায়ন, মেহনতির মুক্তি ইত্যাদি প্রত্যয় রাজনীতির আবেগ ও নির্দেশনা হিসেবে হাজির হলেও, আজ নিপীড়িত শ্রেণী ও জনগোষ্ঠীর বিকাশে এহেন দাবিগুলোকে নিজস্ব অ্যাজেন্ডা দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছে শাসক শ্রেণি৷ শিক্ষিত সমাজের বৃহৎ অংশের ওপর তাদের এসব চিন্তার আধিপত্যও প্রতিষ্ঠা হয়েছে৷ এক্ষেত্রে মিডিয়া ও এনজিও'গুলোর ভূমিকা কী? মেঘনা বললেন, ‘‘সরকার একান্তভাবে এগুলো একা করতে পারে না৷ এর জন্য ‘ইমপ্লিমেন্টেশন'-এর ক্ষেত্রে সরকারেরও সহকারী দরকার হয়৷ সেক্ষেত্রে এনজিও-রা সরকারের সহকারী হতে পারে৷ কিন্তু তার জন্য তাদের আগে সমস্যাগুলোকে উপলব্ধি করতে হবে এবং পরবর্তীতে সমাধানগুলো ‘ডেলিভারি'-র জন্য নিজেদেরকে পাকাপোক্ত করতে হবে৷ সত্যি যদি তারা জনপ্রতিনিধিত্ব করতে চায়, তবে জনগণের চাহিদাগুলি কি - সেটা তাদের বুঝতে হবে৷''
স্বাভাবিকভাবেই, এর জন্য চাই এনজিও'গুলোর সঙ্গে জনগণের একটা সম্পৃত্ততা৷ আবার একইভাবে মিডিয়ারও একটা বড় ভূমিকা আছে বলে জানান মেঘনা গুহঠাকুরতা৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘কোথায় কোথায় জনগণ সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে – সেগুলোকে তুলে ধরার কিন্তু একটা ব্যাপার আছে৷ আবার কোথাও কোনো ভালো শিক্ষা পদ্ধতি চালু হলে – সেটাও প্রচার করার প্রয়োজন আছে৷''
প্রতিবেদন: দেবারতি গুহ
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন