বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় হাইকোর্টে খালাস পাওয়া তিনজন গতকাল কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছে৷ এ খবরে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিন্দার ঝড় উঠেছে৷ অনেকেই একে দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির আর এক দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর পুরান ঢাকায় অবস্থিত গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার থেকে ঐ তিনজন মুক্তি পান৷ এরা হলেন এএইচএম কিবরিয়া, গোলাম মোস্তফা এবং সাইফুল ইসলাম৷ উচ্চ আদালতের আদেশ মঙ্গলবার দুপুরে কারাগারে পৌঁছার পর যাচাইবাছাই শেষে বিকাল সোয়া চারটার দিকে তাদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে৷ ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ওই তিনজনসহ এ মামলার পাঁচ আসামিকে কারাগারে পাঠানো হয়৷ এ মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্য দুই আসামি নাহিদ ও শাকিল এই কারাগারে রয়েছেন৷
বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় নিম্ন আদালত আট জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়৷ এদের মধ্যে এএইচএম কিবরিয়া ও গোলাম মোস্তফাকে যাবজ্জীবন এবং সাইফুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ড হয়৷ পরে হাইকোর্ট এ তিনজনকে খালাস দেয়৷
এই তিন অপরাধীর খালাসকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ক্ষোভ জানিয়েছেন অনেকে৷ তারা অনেকেই ব্যঙ্গ করেছেন আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থাকে৷
শারমিন জান্নাত ভীষণ ক্ষোভে লিখেছেন, ‘‘বিশ্বজিৎ ছেলেটা তো আসলে নাটক করেছে৷ ও বেঁচে থাকতে কেউ ওকে চিনতো না বলে, মরে একটু জনপ্রিয় হতে চেয়েছে! তাই লাইক, কমেন্ট আর শেয়ারের আশায় সে এত নাটক করেছে৷ সোনার টুকরো তিনটি ছেলেকে আসামি ডেকে যে অপবাদ দেয়া হচ্ছে তা তো কোনভাবেই মানি না....সবার মুক্তি চাই অবিলম্বে!''
ছাদেকুর রহমান জাতিসংঘকে আহ্বান জানিয়েছেন ‘ক্ষমা দিবস' চালু করার৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘সেদিন সারা বাংলাদেশের অপরাধীরা ক্ষমা পেয়ে দু'পাটির ৩২ দন্ত কেলিয়ে হাসতে হাসতে কারাগার হতে বেরিয়ে আসবে৷ এই দিবসের রূপকার হিসেবে বাংলাদেশ বিচার বিভাগ কে নোবেল দেয়া যায়!'' তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, ‘‘বিচার বিভাগের দীনতা না হলে প্রকাশ্য দিবালোকে একজন মানুষকে নির্মম ভাবে হত্যাকারীরাও ছাড়া পায় কীভাবে?''
সবশেষে লিখেছেন, ‘‘অভাগা বিশ্বজিৎ মরে বেঁচে গেছে৷ আমাদের কপাল খারাপ, কারণ আমরা বেঁচে থেকেও মরে গেছি৷''
অজন্তা দেব রায় ব্যঙ্গ করে লিখেছেন, ‘‘মাত্র তিনজনকে ছাড়লেন? ছাত্রলীগ বলে কথা!'' ‘‘বাকি আসামিদেরও এক্ষুনি খালাস দিয়ে দিন৷ আমরা মেনে নেবো, নো ওয়ান কিলড বিশ্বজিৎ৷ সে নিজেই নিজের গায়ে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আত্মহত্যা করেছে৷''
হুমায়ূন কবীর রকির প্রশ্ন, ‘‘বিচার বলতে কি কিছু আছে? জনসম্মুখে সবার সামনে হত্যা করা হলো৷ তারপরও তারা নির্দোষ হয় কীভাবে?''
ইভান মিশুও লিখেছেন, ‘‘নো ওয়ান কিল্ড বিশ্বজিৎ!''৷ তিনি ব্যঙ্গ করে লিখেছেন, ‘‘ছাড়া পাওয়া আসামিরা এখন মানহানির মামলা করলে কেমন হয় বিশ্বজিতের পরিবারের বিরুদ্ধে! অদ্ভুত উটের পিঠে চলেছে দেশ৷''
সালমান সামিলের বক্তব্যও অনেকটা এরকম৷ ‘‘জ্বি, বিশ্বজিৎ তার নিজের দোকানের শাটারের নীচে চাপা পড়ে মারা গিয়েছিল, ভিডিও টিডিও সব এডিট করা৷ অতএব মামলা খালাস!'
আব্দুল্লাহ আল ইসহাক খান লিখেছেন,‘‘যতদূর মনে পরে মোট ২১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছিল, এর ভেতর ১৩ জন পলাতক আর বাকিদের সবার মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছিলেন আদালত৷ বছর ঘুরতে না ঘুরতেই একের পর এক খালাস পাওয়া শুরু করল খুনি কুলাঙ্গারগুলো৷ এর মানে দাঁড়াচ্ছে পলাতক ১৩ জন ছাড়া বাকিরা সবাই নির্দোষ! কি বিচিত্র কি অদ্ভুত! বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম চাঞ্চল্যকর মামলার আসামিরা কীভাবে পলাতক থাকে এটাও এক সহজ সমাধানযোগ্য কিন্তু ইচ্ছাকৃত অমিমাংসিত রহস্য৷ এইসব ইচ্ছাকৃত অমিমাংসিত রহস্যের বেড়াজাল থেকে আমাদের মুক্তি নেই! কারণ মুক্তিদাতারাই আজ প্রাচীর ভাঙার বদলে প্রাচীর নির্মাণে ব্যস্ত৷''
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিশ্বজিৎ দাসকে ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷
সংকলন: অমৃতা পারভেজ
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ
বিচার পাওয়ার আশা যেন দুরাশা
‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ বাংলাদেশে এখন একটি অতি উচ্চারিত শব্দযুগল৷ বিচার হচ্ছে না কিংবা বিচারের অপেক্ষায় আছে এমন কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: dapd
ব্লগার হত্যা
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি টিএসসির সামনে দুর্বৃত্তরা মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এরপর একে একে হত্যার শিকার হন ব্লগার নীলাদ্রী নিলয়, অনন্ত বিজয় দাশ, ওয়াশিকুর বাবু, প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন৷ এ সব হত্যাকাণ্ডের কোনোটির বিচারে ‘উল্লেখযোগ্য’ অগ্রগতি না হওয়ায় সম্প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান৷
ছবি: Privat
সাংবাদিক দম্পতি হত্যা
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ভাড়া বাসায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনিকে হত্যা করা হয়৷ গত চার বছরে এই মামলার তদন্ত থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ হয়ে র্যাব-এর হাতে পৌঁছেছে৷ গত মে মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘সাম্প্রতিক সময়ে আমরা প্রত্যেক হত্যাকাণ্ড তদন্তের মাধ্যমে তার বিচার করতে পেরেছি৷ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড অন্য কথা৷ ওটা এখানে না আসাই ভালো৷’’
ছবি: DW
ধর্ষণের বিচার
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে ৬৬০ জন নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ অথচ কোনো ঘটনারই বিচার হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/E. McGregor
ত্বকী হত্যা
নারায়ণগঞ্জ গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তা রফিউর রাব্বির ছেলে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে ২০১৩ সালের ৬ মার্চ হত্যা করা হয়৷ হত্যার দুদিন পর শীতলক্ষ্যার একটি খালে তার লাশ পাওয়া যায়৷ রাষ্ট্রের অনিহা থাকায় এই হত্যাকাণ্ডের বিচার থমকে আছে বলে সম্প্রতি অভিযোগ করেন রফিউর রহমান রাব্বি৷ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাংসদ শামীম ওসমানের পরিবারের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: Facebook/Taqi.Mancha
তনু হত্যা
চলতি বছরের ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর মৃতদেহ পাওয়ার পর দেশব্যাপী প্রতিবাদ উঠেছিল৷ দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি উঠেছিল৷ কিন্তু এখনও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি৷ তবে তদন্তকাজ চলছে৷
ছবি: Twitter
শিল্প কারখানায় দুর্ঘটনা
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে সাভারের রানা প্লাজা ধসে এগারশ’র বেশি মানুষের প্রাণ যায়৷ এর মধ্যে বেশিরভাগই পোশাক শ্রমিক ছিল৷ তিন বছরেরও বেশি সময় পর গত জুলাইতে এই ঘটনায় করা হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়৷ ঢাকার এক অনলাইন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৬ বছরে উল্লেখ্যযোগ্য শিল্প দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৮টি৷ এর কোনোটিরই বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি৷ প্রতিবেদনটি পড়তে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Reuters
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা
১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর বনানীর ১৭ নম্বর রোডের আবেদীন টাওয়ারে ট্রাম্পস ক্লাবের নীচে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ ঘটনার দিনই তাঁর ভাই গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেছিলেন৷ এই অভিনেতা খুন হওয়ার পর চলচ্চিত্র প্রযোজক ও ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠলেও এখনও মামলার বিচার শুরু করা যায়নি৷ আরও তথ্য জানতে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: bdnews24.com
সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা
২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে আওয়ামী লীগের জনসভা শেষে ফেরার পথে গ্রেনেড হামলায় মারা যান সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ পাঁচজন৷ এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা – দু’টিই হবিগঞ্জে দায়ের হলেও পরে সিলেটে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়৷
ছবি: Facebook/Justice-for-Shah-AMS-Kibria
হতাশ রামুর ক্ষতিগ্রস্তরা
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের রামু উপজেলায় কোরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে বৌদ্ধপল্লীতে হামলা চালিয়ে ১২টি বৌদ্ধ মন্দির ও ৩০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে একদল লোক৷ ঐ ঘটনার চার বছর পরও মামলা গতিশীল না হওয়ায় হাতাশা প্রকাশ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা৷ পিপি মমতাজ আহমদ সম্প্রতি বলেন, এই হামলার ঘটনায় দায়ের করা ১৯টি মামলায় ইতোমধ্যেই অভিযোগ গঠন করা হয়েছে৷ আরও তথ্য জানতে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: AFP/Getty Images
নারী নির্যাতনের মামলা ৫,০০৩টি, রায় ৮২০টির
২০১৫ সালে প্রকাশিত মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক জরিপ বলছে, গত নয় বছরে দেশের নয়টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২২,৩৮৬ জন নারী ধর্ষণসহ বিভিন্ন নির্যাতনের ঘটনায় চিকিৎসা নেন৷ এই ঘটনাগুলোর বিচারিক প্রক্রিয়ায় দেখা গেছে এ সব ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ৫,০০৩টি৷ রায় ঘোষণা হয়েছে ৮২০টি, শাস্তি হয়েছে ১০১ জনের৷ শতকরা হিসাবে রায় ঘোষণার হার ৩.৬৬ এবং সাজা পাওয়ার হার ০.৪৫ শতাংশ৷