1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্ক, ইসরায়েল ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

জুলহাস আলম
২৮ মে ২০২১

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বৈদেশিক সম্পর্কের গতি প্রকৃতি বেশ চমকপ্রদ। নানা দিকে নানা সম্ভাবনার দরজা খোলার চেষ্টা দৃশ্যমান।

Symbolbild: Jerusalem in Israel
ছবি: picture-alliance/N. Alon

ভ্যাকসিন কূটনীতি, অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ, ভারত-চীন টানাপোড়েনের মাঝে মুন্সিয়ানার সাথে ভারসাম্য বজায় রাখা, বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা খাতে অব্যাহত অংশগ্রহণ, সাম্প্রতিক ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে নিজেদের অবস্থান পুণর্ব্যক্ত করা, চীনের বিরুদ্ধে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত জোট ইত্যাদি বিষয়গুলো বেশ দৃষ্টিগোচর হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই। বৈদেশিক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অতি সংবেদনশীলতার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে বলেই মনে করি। চ্যালেঞ্জ সীমাহীন, কিন্তু সম্ভাবনার ক্ষেত্রও বেশ উপস্থিত।

সম্প্রতি  ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনার দিকে একটু দৃষ্টি দেয়া যাক। বিশেষ করে বাংলাদেশি পাসপোর্ট থেকে ইসরায়েলের নাম তুলে দেবার বিষয়টি বেশ আগ্রহ তৈরি করেছে। এর তাৎপর্য কী—এ প্রশ্ন অনেকেরই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন নানা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন এবং আমি মনে করি তা যথাযথভাবেই দিচ্ছেন তিনি। কারণ, এক দিকে রয়েছে জাতীয় সেন্টিমেন্ট, অন্যদিকে হলো বৈশ্বিক বাস্তবতা। কূটনীতিতো জাতীয় রাজনীতিরই বিস্তৃত বহিপ্রকাশ। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। সে হিসেবে ঘরের রাজনীতি ঠিক রেখে এবং জনগণের মনন বিবেচনায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। দক্ষতার সঙ্গে সেটা করা হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে।

পাসপোর্ট থেকে ইসরায়েলের নাম তুলে দেবার পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন, অনুমতি ব্যতীত যদি কোনো বাংলাদেশি ইসরায়েল ভ্রমণ করেন, তাহলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন যে, তাহলে তাইওয়ান ভ্রমণের মতো করে তৃতীয় কোনো দেশ থেকে ভিসা নিয়ে কি ইজরায়েল ভ্রমণ করা যাবে? ইসরায়েলের সাথে তৃতীয় কোনো কোনো পক্ষের মাধ্যমে কি বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে? আবার কেউ কেউ বলছেন তীর্থস্থান হিসেবে কোনো বাংলাদেশি মুসলমান যদি জেরুসালেমের আল আকসা মসজিদে যেতে চান, সেটা কি সম্ভব হবে?

আমরা জানি, ইজরায়েলের সাথে বাংলাদেশের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। জাতিসংঘভুক্ত যে ২৮ টি দেশ ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জাতিসংঘের ১৯২ টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৬৪ টি দেশের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক রয়েছে। গত বছর আরব লীগের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বাহরাইন, আরব আমিরাত, সুদান ও মরক্কোর সাথে চুক্তি করে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে ইজরায়েল। এছাড়া প্রতিবেশী মিশর ও জর্দানের সাথে বহু বছর ধরে পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। ক’দিন আগে হয়ে যাওয়া ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ-বিরতি বাস্তবায়ন হয়েছে মিশরের মধ্যস্থতায়। অন্যদিকে পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইসরায়েলের সখ্য ও কৌশলগত কূটনৈতিক সম্পর্ক, দক্ষিণ এশিয়ার শক্তি ভারতের সাথে ইসরায়েলের উন্মুক্ত সম্পর্ক  বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। তাছাড়া বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অংশীদার চীন বিবদমান ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয়ের  সাথেই ভালো সম্পর্ক রেখে চলে। উচ্চ প্রযুক্তি খাতে ইসরায়েলের অবস্থান বিশ্ব স্বীকৃত এবং তাদের সক্ষমতা থেকে এসব দেশ নানাভাবে উপকৃত হচ্ছে। একদিকে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, অন্যদিকে বাণিজ্য ও প্রযুক্তিগত বাস্তবতা। কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক খেলায়ও কোনো দেশ পিছিয়ে থাকতে চায় না। বাংলাদেশেরও নানা আকাঙ্খা থাকবারই কথা। তাই সার্বিক বাস্তবতায় সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বৈদেশিক সম্পর্কের গতি প্রকৃতিতে কোনো প্রভাব ফেলবে কিনা, সেটা সময়ই বলে দেবে। আপাতত আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া যা তার উপরই নির্ভর করতে চাই। তবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবারও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ফিলিস্তিনীদের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন পুণর্ব্যক্ত করেছেন। এ নিয়ে কোনো সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। তবুও বিটুউইন দ্য লাইনস, কিছু কথা অব্যক্তই থাকুক আপাতত। পররাষ্ট্রমন্ত্রী একজন বিজ্ঞ মানুষ, আন্তর্জাতিক রাজনীতির চোরাগলি পথে কী করে চলতে হয় সেটা তিনি তার অভিজ্ঞতা দিয়েই নির্ধারণ করবেন।

বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জটি মাথা রেখে কাজ করতে হয়,সেটি হলো ভারত ও চীনের সাথে ভারসাম্য বজায় রাখা। নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সাথে রয়েছে অম্লমধুর সম্পর্ক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় প্রতিবেশী দেশের নেতা হিসেবে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে আসছেন।

ভারত যদিও সব সময় ‘হৃদয়বান’ প্রতিবেশীর মতো আচরণ করে না বলে অভিযোগ আছে, তবে বাস্তবতা হলো ভারত নানা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী। দু'দেশের প্রধান সমস্যা দারিদ্র্য। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাসবাদ, প্রতিরক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত ক্রমাগত প্রসারিত করার প্রয়োজন রয়েছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের আগে তৎকালীন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদের একটা বক্তব্য মনে পড়ছে। তিনি এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ইঙ্গিত করে

বলেছিলেন যে, হাজার হাজার মাইল দূর থেকে দেখার চেষ্টা না করে বরং দক্ষিণ এশিয়াকে ভারতের চোখ দিয়ে দেখা উচিত। এ বক্তব্যে প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত ছিল যে, দক্ষিণ এশিয়ার নেতা হিসেবে ভারত তার অবস্থানকে সুসংহত করতে চায়। সে চেষ্টা তার অব্যাহত আছে। চীন-পাকিস্তান ভালো সম্পর্ক ও চীন-ভারতের টানাপোড়্নের সম্পর্কের মধ্যে বাংলাদেশকে দক্ষ খেলোয়াড়ের মতো খেলতে হয়। সেক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, এমনটাই মনে করি। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কও তাই গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের যেখানে সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা, চীনের সাথে সেখান থেকেই শুরু, এটাই বাংলাদেশের সাথে চীনের বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তি। ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকালে একজন সফরসঙ্গী হিসেবে আমি চীনের বিনিয়োগকারীদের ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিদের বাংলাদেশ সম্পর্কে যে আগ্রহ দেখেছিলাম, সেটা ভাবার মতো। মনে হয়েছে, চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক পোক্ত করা সময়ের দাবি। বাংলাদেশ সেটা করে যাচ্ছে। তাছাড়া এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের বাণিজ্য ও কৌশলগত সামরিক আগ্রহ সীমাহীন হওয়ায় বাংলাদেশও তার থেকে পিছিয়ে থাকছে না।সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ তৎপর আছে।

জুলহাস আলম, বাংলাদেশ ব্যুরো চিফ, এপিছবি: privat

কোভিড যুদ্ধে ভারতের সেরাম ইন্স্টিটিউট থেকে ভ্যাকসিন না পেয়ে বাংলাদেশ বসে থাকেনি। জাতীয় প্রয়োজন বিবেচনায় রেখে চীনেস সাথে চুক্তি করেছে, দেড় কোটি ডোজ ভ্যাকসিন আসছে। ভারতের অপরিপক্কতার জন্য বাংলাদেশ বসে থাকতে পারে না, বসে থাকেনি। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করেনি ভারত, কিন্তু চীন এ নদীর জল ব্যবস্থাপনার জন্য এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রেও কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে। বৈদেশিক নীতির আরেকটি বিষয় বেশ লক্ষণীয়, সেটা হলো, বড় বড়  অবকাঠামো নির্মাণে চীনের সম্পৃক্ততা থাকলেও এসব প্রকল্পের ‘রাজনৈতিক’ নিয়ন্ত্রণ কারো হাতে ছাড়েনি। দর কষাকষির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এসব জায়গায় বেশ ভালো করছে। ভবিষ্যতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ ও বঙ্গোপসাগরে বাইরে থেকে এসে কেউ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে বলে মনে হয় না। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য স্বার্থকে বিবেচনায় রেখে খুবই পোক্ত ও কৌশলগত শক্ত অবস্থান বাংলাদেশের রয়েছে।

চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তির বিরুদ্ধে আবার একাট্টা  রয়েছে ভারত ও আমেরিকা। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো কৌশলগত অবস্থান নেয়া। সেটি নিচ্ছেও বাংলাদেশ। একদিকে সহযোগিতার ক্ষেত্র বিস্তৃত করা, অন্যদিকে নানা শক্তির সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা সোজা কথা নয়। নানা প্রতিকুলতার মধ্যেও বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তাই একটি ভালো গল্পের নাম। যেন তা একটা ছোট গল্প, যার শুরু আছে, শেষও আছে, তবুও শেষ হয়েও শেষ হয় না যেন।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ