বাংলাদেশের ব্যাটাররা কেন ছক্কা মারতে পারেন না?
৯ সেপ্টেম্বর ২০২২একেবারেই যে পারে না ব্যাপারটা অবশ্য অমন নয়৷ তবে প্রদীপের অল্প আলোয় অন্ধকার যেমন আরো জমাট হয়, বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের অল্পস্বল্প ছক্কার গল্পে তেমনি ছড়ায় হাহাকার৷ বিশেষত এই আধুনিক ক্রিকেটে৷ বিশেষত টি-টোয়েন্টিতে৷
ওই যে সেদিন নাসিম শাহ, যিনি মূলত বোলার, যার বয়স মাত্র ১৯ বছর, তিনিও ৬ বলে ১১ রানের প্রয়োজনীয়তার সামনে দাঁড়িয়ে দুটো ছক্কা মেরে দিলেন৷ অবলীলায়৷ অনায়সে৷ আফগানিস্তানের বিপক্ষে জেতালেন পাকিস্তানকে৷ অভিন্ন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কেউ কি প্রতিপক্ষের আকাশ থেকে জয়সূর্য ছিনিয়ে আনতে পারতেন অমন করে? যদি তিনি পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যানও হতেন?
এ প্রশ্নের আয়নায় যে উত্তরের প্রতিবিম্ব, সেটাই বাংলাদেশ ক্রিকেটের সত্যিকারের প্রতিচ্ছবি৷
বাংলাদেশ যে ছক্কা মারতে পারে না, এটা কেবলই কথার কথা নয়৷ পরিসংখ্যানের কষ্টিপাথরে যাচাই করা রীতিমতো৷ এই যেমন গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকেই ধরুন না! এ সময়ে কুড়ি-বিশের ফরম্যাটে যে ২০টি পূর্ণাঙ্গ ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ, তাতে ছক্কা ৭০টি৷ অর্থাৎ, প্রতি ইনিংসে গড়ে ৩.৫টি করে ওভার বাউন্ডারি৷
এমনিতে মনে হতে পারে, সংখ্যাটি একেবারে খারাপ না৷ কিন্তু যদি অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে?
ঠিক এই সময়কালে, অর্থাৎ, সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা ৩৩ ম্যাচে মেরেছে ২২৩ ছয়৷ ইনিংসপ্রতি ৭.৭৫টি৷ ওয়েস্ট ইন্ডিজের ২৬ ম্যাচে ২০২ ছয়; ইনিংসপ্রতি ৭.৭৬টি করে৷ পাকিস্তান ম্যাচপ্রতি ছয় ছক্কার গড়ে ১৭ ইনিংসে বল সীমানার ওপারে আছড়ে ফেলেছে ১০২ বার৷ ইংল্যান্ডের ১৭ ম্যাচে ১২৫ ছয়; গড় ৭.৩৫৷ এমনকি আফগানিস্তানও ২০ ম্যাচে ১০৫ ছক্কা মেরেছে; প্রতি ইনিংসে গড়ে ৫.২৫টি করে৷
বাংলাদেশের ইনিংসপ্রতি ৩.৫ ছক্কাকে এখন কী রকম জীর্ণ-শীর্ণ-বিবর্ণ পরিসংখ্যানই না লাগছে, বলুন!
এ হতশ্রী অবস্থা আসলে কেন? দীর্ঘদিন ধরে ক্রিকেট কোচিংয়ে থাকা নাজমুল আবেদীন ফাহিমের কাছে এর কারণ অনেক, ‘‘আমরা তো ঘরোয়াতে খুব আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলি না৷ টি-টোয়েন্টিতে ১৩০-১৩৫ রান করি৷ ৫০ ওভারের ক্রিকেটেও ২৫০-২৬০ রান করি৷ ফলে ব্যাটসম্যানদের মেরে খেলার ওই মনস্তাত্তিক দিকটাতেই পিছিয়ে থাকি৷’’
ক্রিকেট কোচিংয়েও সমস্যা দেখছেন তিনি, ‘‘খেলা শেখানোর জায়গায় আগে ওই টেস্ট যুগে যেভাবে ব্যাটিং শেখানো হতো, এখনও সেভাবেই শেখানো হয়৷ সোজা খেলা, ভি-তে খেলা, টপ হ্যান্ডে খেলা৷ কিন্তু ছয় মারতে গেলে দুটো হাতই লাগে, বটম হ্যান্ডেরও কন্ট্রিবিউশন লাগে৷ তো আমাদের ব্যাটসম্যানদের শেখার মধ্যেই ওই জিনিসটা থাকে না৷ এটা আর পরবর্তীতে পরিবর্তন করতে পারে না৷’’
এই ক্রিকেট সংস্কৃতিটাও ছক্কা মারার ব্যাপারে ক্রিকেটারদের পিছু টেনে ধরছে বলে ফাহিমের দাবি, ‘‘এখনও যেসব ব্যাটসম্যান অনেক বল খেলে কম রান করেন, তাদের ভালো ব্যাটসম্যান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়৷ উৎসাহ দেয়া হয়৷ আবার কেউ আক্রমণাত্মক খেলতে গিয়ে আউট হয়ে গেলে তাকে নিরুৎসাহিত করা হয়৷ ছয় মারতে গিয়ে আউট হয়ে গেলে বলা হয়, কে বলেছে উপরে উঠিয়ে মারতে? এ সংস্কৃতিটা আমাদের মধ্যে আছে৷ যে কারণে ক্রিকেটাররা ঝুঁকির শট কম খেলে৷ তবে এটা হতেই পারে না যে, বাংলাদেশের এত মানুষের মধ্যে ছয় মারতে এত অসুবিধা হবে৷ এটা কখনোই সম্ভব না৷’’
জাতীয় দলের ক্রিকেটার এবং টিম ম্যানেজমেন্টের কাছে একটা কথা প্রায়ই শোনা যায় যে, শারীরিক গঠনের কারণেই ছক্কা মারতে পারছেন না বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা৷ এটা মানতে নারাজ বিকেএসপির ক্রিকেট পরামর্শক ফাহিম, ‘‘শারীরিক শক্তিটা গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক আছে৷ কিন্তু সেটাই শেষ কথা না৷ অনেক দেশেই অনেক ক্রিকেটার আছে, যারা আমাদের চেয়ে শারীরিকভাবে হয়ত একটু পিছিয়েই৷ কিন্তু বড় বড় শট খেলতে পারে৷ আমাদের মধ্যেও আছে৷ যেমন রনি তালুকদার৷ ও যে কোনো সময় ছয় মেরে দিতে পারে৷’’
তাহলে এই শারীরিক শক্তির ব্যাপারটা সামনে নিয়ে আসা হয় কেন? ছক্কা মারায় নিজেদের অদক্ষতা ঢাকার জন্যই কি? এ প্রশ্নের উত্তরে শিষ্য সাকিব আল হাসানকে টেনে আনলেন ফাহিম, ‘‘এটা ওরা বিশ্বাস করে যে, ওদের পক্ষে ছয় মারা সম্ভব না৷ মনে করে, শারীরিকভাবে ওরা সবল আর আমরা দুর্বল বলে আমরা পারি না৷ আমি সাকিবের উদাহরণ দিই৷ ও গত বিপিএলে যেভাবে ছয় মারলো, এর আগের খেলাগুলোতে দেখবেন, ১০টা মারতে ৯টাই বাউন্ডারি লাইনে ক্যাচ হতো৷ কিন্তু বিপিএলে বড় বড় ছয় মারলো৷ সাকিবের এটি ট্রেনিংয়ের পর হয়েছে৷ সে অন্যভাবে ট্রেনিং করেছে৷ আমার মনে হয়, ছয় মারার ব্যাপারে আমাদের টেকনিক্যালি সমস্যা আছে৷ আবার যে ইনটেন্ট, সেখানেও সমস্যা আছে৷’’
অথচ বাংলাদেশ ক্রিকেটের আগের প্রজন্মে মোহাম্মদ রফিকের মতো একজন ছিলেন৷ যিনি ছক্কার নাচনে দর্শকদের নাচাতে পারতেন৷ সেটাও প্রায় টি-টোয়েন্টি-পূর্ব যুগে৷ এখন সেটি না হওয়ার পেছনে কোচদের বড় দায় দিয়েছেন রফিক, ‘‘সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, কোচরা এ বিষয়টা নিয়ে কী করছে? এই টেকনিক নিয়ে তো কাজ করতে হয়৷ কিন্তু আমি মনে করি, এ জায়গাটা ফাঁকা আছে৷’’
শারীরিক শক্তিকে সামনে নিয়ে আসাকে অজুহাত মনে হয় রফিকের কাছে, ‘‘যারা এসব বলে, তারা ‘নন ক্রিকেটার’-এর মতো কথা বলে৷ এটা তাদের কাছে মুখস্ত থাকে৷ একটা কিছু বলে দিলো৷” বিদেশি কোচদেরও কাঠগড়ায় দাঁড় করান তিনি, ‘‘এই টেকনিক (ছক্কা মারার) নিয়ে কাজ করতে হবে৷ গর্ডন গ্রিনিজ ছাড়া আমি বাংলাদেশের আর কোনো কোচকে দেখিনি, এ ধরনের টেকনিক নিয়ে কাজ করতে৷ গর্ডন আমাদের সবাইকে বলতো, কত বড় বড় ছয় মারতে পারো- দেখি৷ এখনকার কোচরা অমন করেন না৷ তারা বলেন, সোজা খেলো, বেসিকে খেলো৷ এই বেসিক ক্রিকেটে টি-টোয়েন্টি চলে না৷ আমাদের প্লেয়াররাও কোচকে খুশি করার জন্য দেখা যায়, বেসিকেই ব্যাটিং করছে৷ এসবে ওসব বেসিক-মেসিক চলে না৷’’
ক্রিকেটারদের তাই অনুশীলনের পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের পরামর্শ বাংলাদেশের হয়ে ৩৩ টেস্ট, ১২৫ ওয়ানডে এবং এক টি-টোয়েন্টি খেলা রফিকের, ‘‘এক ঘণ্টা প্র্যাকটিসে যদি বলা হয়, দেখি কয়টা ছয় মারতে পারো, তাহলে ছয় মারাটা আয়ত্ত্বে আসবে৷ দিনের পর দিন প্র্যাকটিস করতে হবে৷ এখন পাওয়ার ক্রিকেট খেলতে হবে৷ ওভারে ১০ রান করে নিতে হবে৷ প্রথম ৬ ওভারে ৫০-৬০ করতে হবে৷ দুই উইকেট চলে যাক, সমস্যাটা কী? ১০ বলে ২ রান করার চেয়ে আউট হওয়াটা অনেক বেটার৷’’
যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের আন্দ্রে রাসেল, কাইরন পোলার্ডরা উদাহরণ হিসেবে বারবার আসেন বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের কাছে, সে দলে তো একজন নিকোলাস পুরানও রয়েছেন, যার শারীরিক গড়ন গড়পড়তা বাঙালির মতোই৷ অথচ ব্যাট হাতে ছক্কার ঝড়ে কী তাণ্ডবই না চালান প্রায়শ!
বাংলাদেশের ব্যাটাররা কবে তা পারবেন? যত দিন না পারবেন, টি-টোয়েন্টি ব্যাটিং ব্যাকরণের শেষ বেঞ্চের ছাত্র হয়েই যে থাকতে হবে!