বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক বলে মনে করে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র বা ‘আসক’৷ সংগঠনটি দেশে মানবাধিকার পরিস্থতির অবনতির জন্য প্রধানত রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়ী করেছে৷
বিজ্ঞাপন
আসক মনে করছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হলে বাংলাদেশে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উত্থান হতে পারে৷
সংগঠনটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে ৮৪৮টি রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে৷ যাতে নিহত হয়েছেন প্রায় ৫০৭ জন৷ আর আহত ২২,৪০৭ জন৷ নিহতদের মধ্যে ১৫ জন পুলিশ এবং দু'জন বিজিবি সদস্যও রয়েছেন৷
রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক কারণে পেট্রোল বোমা হামলায় আহত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিত্সাধীন ৯৭ জনের মধ্যে ২৫ জন মারা গেছেন৷ সন্ত্রাসী তত্পরতায় নতুন সংযোজন গুম বা গুপ্ত হত্যা৷ ২০১৩ সালে এ ধরণের গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছেন ৫৩ জন৷ এছাড়া, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৭২ জন৷
আসক-এর ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে জানান, তারা মনে করেন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সহিংসতার কারণে ২০১৩ সালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেশি ঘটেছে৷ এর জন্য প্রধানত দায়ী সরকার ও বিরোধী দলীয় প্রধান দুই রাজনৈতিক জোট৷ তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে সহিংস রাজনীতির চর্চা শুরু করায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷
সাফল্য, ব্যর্থতার ২০১৩
বাংলাদেশের জন্য ঘটনাবহুল এক বছর ২০১৩৷ রানা প্লাজায় ধস, নির্বাচন নিয়ে সহিংসতা, মানুষ পোড়ানো, ব্লগার হত্যাসহ হতাশার খবর অনেক৷ তবে সন্তুষ্টিও আছে৷ ২০১৩ সালের আলোচিত ১৩ ঘটনা নিয়ে ছবিঘর৷
ছবি: REUTERS
‘বিজয়চিহ্ন’
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে পাঁচ ফেব্রুয়ারি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা হয় জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার৷ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই রায় ঘোষণার পর ‘বিজয়চিহ্ন’ দেখান মোল্লা৷ তার এই বিজয়চিহ্নের প্রতিবাদে শাহবাগে গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
গণজাগরণ মঞ্চ
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কাদের মোল্লাসহ অন্যান্য অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে পাঁচ ফেব্রুয়ারি রাতে শাহবাগে সমবেত হন অসংখ্য মানুষ৷ ব্লগারদের আহ্বানে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে এধরনের বিশাল প্রতিবাদ কর্মসূচি আগে কখনো দেখা যায়নি বাংলাদেশে৷ শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর থেকে যাত্রা শুরু করা গণজাগরণ মঞ্চ এখনো বিভিন্ন দাবিতে রাজপথে সক্রিয় রয়েছে৷
ছবি: REUTERS
ব্লগার হত্যা, কারাদণ্ড
গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে হত্যা করে একদল দুর্বৃত্ত৷ ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে তাঁকে নিজের বাড়ির সামনে জবাই করে হত্যা করা হয়৷ এই হত্যাকাণ্ডের পরপরই ইন্টারনেটে একটি মহল রাজীবকে নাস্তিক ব্লগার হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে৷ চলতি বছর আরেক ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনও (ছবিতে মাঝে) হত্যাচেষ্টার শিকার হন৷ পরবর্তীতে তিনিসহ কয়েক ব্লগার কারাভোগও করেছেন৷
ছবি: Babu Ahmed
জিল্লুর রহমানের চিরবিদায়
২০১৩ সালের ২০ মার্চ সিঙ্গাপুরে চিকিৎসারত অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান৷ তাঁর মৃত্যুর পর এক প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘‘তিনি ছিলেন একজন আজীবন গণতন্ত্রী মানুষ৷ তাই সবার কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল৷’’ জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন আবদুল হামিদ৷
ছবি: AFP/Getty Images
ভবন ধসে সহস্রাধিক প্রাণহানি
পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ভবন ধসের ঘটনা ঘটে বাংলাদেশের সাভারে৷ ২৪ এপ্রিল সকাল ৯ টায় সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অবস্থিত নয় তলা ‘রানা প্লাজা’ ধসে পড়লে সহস্রাধিক মানুষ প্রাণ হারান৷ রানা প্লাজায় কয়েকটি গার্মেন্টস কারখানা ছিল৷ তাই হতাহতের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন গার্মেন্টস কর্মী৷ এই ঘটনায় গোটা বিশ্বেই সমালোচনার ঝড় ওঠে৷
ছবি: Reuters
হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ
কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ বিভিন্ন দাবিতে পাঁচ মে ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশ করেন কয়েক লাখ হেফাজতে ইসলাম সমর্থক৷ তবে সেদিন তারা মতিঝিল ত্যাগ না করে সেখানে অবস্থান করতে চাইলে নিরাপত্তা বাহিনী রাতের আধারে অভিযান চালিয়ে তাদের সরিয়ে দেয়৷ এই অভিযানে ঠিক কতজন প্রাণ হারিয়েছে তা এখনো এক অমীমাংসিত বিষয়৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
সতের দিন বেঁচে থাকা
রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে সতের দিন আটকে ছিলেন পোশাককর্মী রেশমা৷ ১০ মে তাঁকে উদ্ধারে সক্ষম হয় উদ্ধারকারী দল৷ এভাবে আটকে থেকেও বেঁচে থাকার ঘটনা গোটা বিশ্বে বিরল৷ রেশমা বর্তমানে ঢাকার ওয়েস্টিন হোটেলে কাজ করছেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
বিশ্বকাপে সিদ্দিকুর
চলতি বছর গলফ খেলায় বাংলাদেশকে এক নতুন আসনে নিয়ে গেছেন সিদ্দিকুর রহমান৷ প্রথমবারের মতো গলফ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের নাম লেখান তিনি৷ এছাড়া ভারতের নতুন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হিরো ইন্ডিয়া ওপেন গলফ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হন সিদ্দিকুর রহমান৷
ছবি: Getty Images
১৫২ জনের ফাঁসি
ঢাকার পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর সদর দফতরে এক বিদ্রোহের মাধ্যমে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার দায়ে পাঁচ নভেম্বর ১৫২ জনকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত৷ বাংলাদেশের ইতিহাসে একসঙ্গে এত মানুষের ফাঁসির আদেশ আর কখনও হয়নি৷
ছবি: Reuters
মানুষ পোড়ানোর রাজনীতি
২০১৩ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার আগুনে পুড়ে নিহত হয়েছেন অনেক মানুষ৷ যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রমের বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবিরের বিভিন্ন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে প্রাণহানিও কম নয়৷ এছাড়া পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মী নিহত হয়েছে৷ চলতি বছর রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রাণহানির সংখ্যা দু’শোর বেশি৷
ছবি: Mustafiz Mamun
কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ১২ ডিসেম্বর জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়৷ মোল্লাকে এভাবে ফাঁসি না দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন, জার্মানি সহ অন্যরা৷ জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকরা তাকে ‘শহিদ’ আখ্যা দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় গায়েবানা জানাজার আয়োজন করে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
‘‘সবচেয়ে বড় মানব পতাকা’’
পৃথিবীর ইতিহাসে ‘‘সবচেয়ে বড় মানব পতাকা’’ তৈরির ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ৷ স্বাধীনতার ৪২ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ঢাকার জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে এই মানব পতাকা তৈরি করেন প্রায় ত্রিশ হাজার সেনা সদস্য, স্কুল শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ৷
ছবি: Reuters
বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের শাস্তি
গত বছর ডিসেম্বরে বিরোধী দলের অবরোধের সময় ঢাকায় নিহত দোকান-কর্মচারী বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় ছাত্রলীগের ৮ কর্মীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত৷ এছাড়া ১৩ জনকে দেয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড৷ ১৮ ডিসেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার আদালত এই রায় ঘোষণা করেন৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
13 ছবি1 | 13
কিন্তু তারা সহিংস হচ্ছে কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে নূর খান বলেন, জনগণের ওপর আস্থা না রেখে ক্ষমতায় টিকে থাকা ও যাওয়ার জন্য তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে৷ কারণ নির্বাচনকালীন সরকার এবং নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে ঐক্যমত না থাকায় কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না৷ চাইছে যে যার সুবিধা অনুযায়ী নির্বাচন করতে৷
নূর খান বলেন, বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক জোট যদি সমঝোতায় আসতে না পারে তাহলে বাংলাদেশে সশস্ত্র ধর্মীয় জঙ্গি এবং সশস্ত্র সন্ত্রাসী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর উত্থান ঘটতে পারে৷ যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে টিকে থাকার জন্য ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং সশস্ত্র রজনীতির দিকে মানুষের ঝুঁকে পড়ার যথেষ্ঠ কারণ আছে৷ তাদের কাছে আত্মরক্ষার জন্য এই পথকে আকর্ষণীয় মনে হতে পারে৷ তিনি বলেন, বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই জঙ্গি এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তত্পর৷ আর তাদের সহায়তা দিতে বাইরের অপশক্তিও কাজ করছে৷
নূর খানের কথায়, রাজনৈতিক সহিংসতার যাঁরা শিকার হয়েছেন তাঁদের বড় একটি অংশ সাধারণ মানুষ৷ রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি তাঁদের কোনো যোগাযোগ নেই৷ সহিংসতার শিকার হয়ে যাঁরা নিহত হয়েছেন বা আহত হয়েছেন, তাঁদের রক্ষায় সরকার ব্যর্থ হয়েছে৷ এমনকি যাঁরা বোমা ও আগুনে দগ্ধ হয়েছেন, তাঁরাও ঠিকমতো চিকিত্সা সুবিধাও পাচ্ছেন না৷ শুধু তাই নয়, অনেকে রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন৷ তাই সরকারের দায়িত্ব হলো তাঁদের নিরাপত্তা, চিকিত্সা এবং আবাসের ব্যবস্থা করা৷ তাছাড়া সহিংসতার শিকার পরিবারগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করাও প্রয়োজন৷
নূর খান বলেন, এবার রাজনৈতিক সহিংসতা দেশের মানুষের মধ্যে নিরপত্তাহীনতা তৈরি করেছে৷ সৃষ্টি করেছে আতঙ্কের পরিবেশ৷