1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশের যে লজ্জা পাকিস্তানেরও নেই

১৭ জানুয়ারি ২০২০

ওপরের দিকে থুথু দিলে থুথু নিজের গায়েও পড়ে৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে বাংলাদেশ নিয়ে অনেক কথাই লেখা যায়৷ কিন্তু লিখতে গেলে মনে হয়, ‘‘আমাদেরই তো দেশ৷ দেশের অর্জন, ব্যর্থতা, অহঙ্কার আর লজ্জার অংশীদার তো আমরাও৷''

ছবি: Journey/M. Alam

তবু কিছু কথা বলতে হয়, লিখতেও হয়৷ জেনেবুঝে না বলা, না লেখাটা আত্মপ্রবঞ্চনা বা তার চেয়েও খারাপ কিছু

১৯৭৫ সালে আমি প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র৷ তবু পরিষ্কার মনে আছে, মুক্তিযুদ্ধে যোগ না দিয়ে ১৯৭০ সালের ২৫ শে মার্চের পর থেকে ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের কর্মস্থলে থেকে বাড়তি সুবিধা ভোগ করা এক ভদ্রলোক কী মহানন্দে আমার বাবাকে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুসংবাদটা দিয়েছিলেন৷ বাবার সেই সহকর্মী যেন মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধের আনন্দ পাচ্ছিলেন৷ একটু পরেই কাঁদতে কাঁদতে এসে আমার বাবাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, চিকিৎসক আতাউর রহমান চৌধুরী৷ রেডিওতে মেজর ডালিমের কণ্ঠে শোনা যাচ্ছিলো বঙ্গবন্ধু-হত্যার সদর্প ঘোষণা৷একজন শ্রোতা বেড়েছিল একটু পরেই৷আমার বাবার সমবয়সি হয়েও তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ করেননি আবার সরাসরি রাজাকার-আলবদরও হননি, তবে স্বাধীন দেশে নিজের নামটা চেষ্টা-তদ্বির করে ঠিকই তুলেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায়৷ দেশে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেলেও তার মাঝে কোনো হেলদোল ছিল না সেদিন৷

সেদিন ঢাকা থেকে অনেক দূরে এক মফস্বল শহরের মাত্র চার জন মানুষের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু-হত্যার প্রতিক্রিয়া ছিল তিনরকম৷ কেউ ভীষণ বেদনাহত, কেউ খুব খুশি, কেউ আবার আনন্দ-বেদনার মাঝখানে দাঁড়িয়ে সতর্ক হিসেবি পর্যবেক্ষক৷

রাজধানীকে ঘিরে সারা দেশে প্রতিক্রিয়াটা ছিল আরো বেশি চাপা এবং উপরের স্তরে স্বার্থের নানা হিসেব মেলানোর চেষ্টায় বহুমুখী৷

সেটা কেমন? বেশি ব্যাখ্যার দরকার নেই৷

ক্রীড়নকদের নাম আলাদাভাবে বলাও নিষ্প্রয়োজন৷

আগস্টের সেই দিনটিতে তো শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়নি৷ তা হলে স্রেফ একটা অভ্যুত্থানই হয়ত বলা যেতো৷ সেদিন রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কহীন নারীর হত্যা, গর্ভবতী নারী-হত্যা, শিশু-হত্যা সবই হয়েছিল৷ এবং পরে কোনো হত্যার বিচার না করার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল সংসদে৷

কে বা কারা, কিভাবে করেছিলেন তা ৪৫ বছর পর আর অজানা নেই৷ দায় এড়ানোর চেষ্টা কে বা কারা কিভাবে করেছেন, তা-ও অনেকেরই জানা৷

দায় এড়ানোর চেষ্টা তো হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িতরাও একটা সময় করেছেন৷ অন্যদিকে হত্যাকারীদের শাস্তি না দিয়ে পুরস্কৃত করেছে এই দেশেরই ‘শাসনব্যবস্থা'৷ সেই শাসনব্যবস্থার গায়েও লাগানো হয়েছে ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র' নামের পট্টি৷ ক্ষতস্থানে পট্টি বাঁধলেই ক্ষত শুকায় না, সুচিকিৎসা না হলে ক্ষত থাকে, দাগও থাকে৷

১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখানোও পুরোপুরি নিষিদ্ধ ছিল৷ তাঁর ভাষণও শোনা যেতো না কোথাও৷ যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ নামের ভূখন্ডের জন্ম, তিনিই নিষিদ্ধ, ভাবা যায়!

এরশাদ আমলে বিটিভির একটা বই পরিচিতির অনুষ্ঠানের কথা বলি৷ তাতে এ দেশে বঙ্গবন্ধু কীভাবে ‘থেকেও নেই' ছিলেন, তা কিছুটা বোঝা যাবে৷

বাজারে যত ভালো ভালো বই এসেছে হাতে তুলে ধরে ধরে দেখাচ্ছিলেন অনুষ্ঠানসঞ্চালক৷ হঠাৎ হাতে উঠে এলো এম আর আখতার মুকুলের ‘আমি বিজয় দেখেছি'৷ সঞ্চালক বইয়ের প্রচ্ছদের একটা জায়গায় বুড়ো আঙুল চেপে ঐতিহাসিক গুরুত্ববহ বইটি নিয়ে নাতিদীর্ঘ আলোচনা করলেন৷

সেই অনুষ্ঠান নিয়ে সাপ্তাহিক যায় যায় দিন-এ একটা প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল৷ প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘‘আমি বিজয় দেখিনি৷'' কারণ, বিটিভির ওই অনুষ্ঠানে ‘‘আমি বিজয় দেখেছি'' নিয়ে আলোচনার সময় বঙ্গবন্ধুর ছবিটাই কায়দা করে দেখানো হয়নি৷ নিষিদ্ধ তো, দেখালে যদি বিপদ হয়!

বিটিভিকে মানুষ তখন বিশ্বাস করেনি, এখনো করে না৷

গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু আর নিষিদ্ধ নেই৷ বরং তার নামে প্রচার সব ধরনের প্রচারমাধ্যমে সময় বিশেষে একটু বেশিই হয়৷

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতেও প্রচার-প্রচারণা কম হচ্ছে না৷ শতবার্ষিকী উদযাপনে আয়োজনের কমতি নেই৷ তবে মনে হয়, ৪৫ বছর আগের এক মফস্বলের সেই চারজনের প্রতিনিধিত্বই সমাজে বেড়েছে৷ বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা করেন এমন মানুষ যে সংখ্যায় অনেক বেশি তাতে অবশ্য কোনো সন্দেহ নেই৷

এমন মানুষের সংখ্যা ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টেও অনেক বেশিই ছিল৷

আশীষ চক্রবর্ত্তী, ডয়চে ভেলেছবি: DW/T. Mehedi

জানি, এ কথায় আপত্তি জানানোর মানুষ অনেক আছে দেশে৷ তারা নিশ্চয়ই প্রশ্ন করবেন, ‘‘তাহলে সেদিন বা তার পরও সারা দেশে বড় কোনো বিক্ষোভ-মিছিল হয়নি কেন?''

পাল্টা প্রশ্ন করা যায়, ‘‘বিক্ষোভ মিছিল হয়নি বলেই কি ধরে নেয়া উচিত যে দেশের মানুষ এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে মৌন-সমর্থন জানিয়েছিল? শুধু এই মানদণ্ডে কি অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতাবদলকে গণতান্ত্রিক বলা যেতে পারে?''

জানি, তারপরও ইনিয়ে বিনিয়ে কিছু (কু)যুক্তি দেখানো হবে৷

ওসব শুনে যদি প্রশ্ন করি, ২০১৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরও যে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে সারা দেশে কোনো বিক্ষোভ-মিছিল হয়নি সেই বিষয়ে কী বলবেন? আপনি কি মনে করেন, মিছিল হয়নি বলেই নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপেক্ষ বলা উচিত?

বলা বাহুল্য, তখন শুরু হবে বিক্ষোভ-মিছিল না হওয়ার শত কারণ দেখানো৷

নিজের সুবিধামতো সত্যি বা মিথ্যা বলা, ইতিহাস অস্বীকার বা বিকৃত করা, কাউকে বড় করতে গিয়ে অন্যকে ছোট করে দেখানোর প্রবণতায় কখনো ছেদ পড়েনি৷বাংলাদেশে এই প্রবণতার সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে নির্মম, সবচেয়ে করুণ শিকার বঙ্গবন্ধু৷

‘ভুল রাজনীতি' বা ‘ভুল পথের' রাজনীতির সঙ্গী থাকতে থাকতে আমরা আসলে জাতির পিতাকেও একরকম পণ্যই বানিয়ে ফেলেছি৷ তাঁকে অনেকে সমাদরে ব্যবহার করেন, অনেকে আবার প্রকাশ্যে বা গোপনে, সোজা বা বাঁকা কথায়  প্রত্যাখ্যানও করেন৷

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহরও এই অবস্থা করা হয়নি৷ পাকিস্তানে গণতন্ত্র চিরকাল সোনার পাথর বাটি৷কত শাসক এলো-গেল৷ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সামরিক শাসনই চলেছে সব সময়৷ সে দেশে কোন দল কোন দলের বন্ধু তা তিনদিনও স্পষ্ট থাকে কালেভদ্রে৷ এমন এক দেশে মৃত্যুর ৭২ বছর পরও মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ কায়েদ-ই আযম বা মহান নেতা এবং বাবা-ই কওম, অর্থাৎ জাতির পিতাই আছেন৷ তার অমর্যাদা ক্ষমতায় গিয়েও কেউ কোনোদিন করেনি৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

বাংলাদেশ