বাংলাদেশে শ্রমিক আন্দোলন কখনো উজ্জ্বল আবার কখনো নেতিবাচক চরিত্র নিয়ে এগিয়েছে৷ পোশাক খাতে শ্রমিক আন্দোলনের যেমন বড় ভূমিকা আছে, তেমনি ব্যাংক ও সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানে সিবিএকে ক্ষমতা, বিত্তের উৎস মনে করা হয়৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের এখন শ্রমিক শাখা রয়েছে৷ ওই দলগুলোর নামে কেন্দ্রীয় থেকে শুরু করে ইউনিট পর্যন্ত শ্রমিক সংগঠনের শাখা রয়েছে৷ শ্রমিক নেতারা এখন মন্ত্রী হন, অতীতেও হয়েছেন৷ পাটকলগুলোর শ্রমিক সংগঠন এক সময় খুব প্রভাবশালী ছিল৷ তাদের নেতারা জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতেন৷ এখন সেই জায়গা নিয়েছে পরিবহণ শ্রমিকদের সংগঠন৷ নৌমন্ত্রী শাহজাহান খান একই সঙ্গে মন্ত্রী এবং পরিবহণ শ্রমিকদের শীর্ষ নেতা৷ তাঁর প্রভাবের কারণে সড়ক পরিবহণ নিয়ে জনবান্ধব আইন করা যায় না বলেও অভিযোগ রয়েছে৷
এক সময় আদমজী পাটকলে প্রতিদ্বন্দ্বী শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ এবং হত্যাকাণ্ড নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছিল৷ কিন্তু সেই আদমজী পাটকল বন্ধ হওয়ার সময় নেতাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ বাংলাদেশের সরকারি ব্যাংকগুলোতে সিবিএ আছে৷ অভিযোগ আছে, ওইসব ব্যাংকের সিবিএ নেতাদের কাছে ব্যাংকের সর্বোচ্চ প্রশাসন অসহায়৷ তাঁদের চাপ আর ধমকের মুখে থাকতে হয় কর্মকর্তাদের৷ এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকেরও একই অবস্থা৷ তাঁরা গভর্নরকেও পরোয়া করেন না বলে অভিযোগ আছে৷ এমনকি কিছু অপ্রীতিকর ঘটনায় ওই সিবিএ নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে৷ আর হবেই বা না কেন? সম্প্রতি সোনালী ব্যাংকের এক ঘটনায় সিবিএ নেতাদের পক্ষে অবস্থান নেন একজন মন্ত্রী কাম শ্রমিক নেতা৷ তিনি কোনো অনুমতি ছাড়াই ব্যাংকের ভিতরে সভা করে কর্তৃপক্ষকে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলার পরামর্শ দেন৷
নিজেদের অধিকার সম্পর্কে শ্রমজীবী মানুষদের কথা
বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে খেটে খাওয়া মানুষরা পদে পদে বঞ্চিত হচ্ছেন শ্রম অধিকার থেকে৷ কয়েকটি ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের অধিকারসচেতনতা এবং এ প্রসঙ্গে তাঁদের মতামত জেনে নিন এই ছবিঘরে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
ঝর্ণা আক্তার, পোশাক শ্রমিক
শ্রম অধিকার বলতে আমার কাজের ন্যায্য পারিশ্রমিক পাওয়াকে বুঝি, কিন্তু সেটা আমি পাই না৷ মাসে বেতন পাই ছয় হাজার টাকা, ওভার টাইম নিয়ে সেটা নয় হাজার টাকার মতো হয়৷ এই টাকা দিয়ে বহু কষ্টে খেয়ে-পড়ে বেঁচে আছি৷ অনেক সময় বেতন বকেয়া রেখেই চাকরি থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
মুকুলি বেগম, গৃহকর্মী
শ্রম অধিকার কী জিনিস তা বুঝি না৷ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে যাই৷ সপ্তাহে কোনো ছুটির দিন নেই৷ ছোটখাট অসুখ-বিসুখ হলেও কাজে যেতে হয়৷ এর বাইরে পদে পদে খারাপ ব্যবহার পেতে হয় বাড়ির মালিকের কাছ থেকে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
মোহাম্মদ রিপন, নির্মাণ শ্রমিক
শ্রম অধিকার বুঝি না৷ দিন শেষে পারিশ্রমিক পেলেই খুশি৷ সপ্তাহে সাতদিনই কাজ করি৷ কাজ করলে টাকা পাই, না করলে পাই না৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
মোহাম্মদ নূরুদ্দিন, দিনমজুর
শ্রম অধিকার বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই৷ সারাদিন খেটে ৩০০-৪০০ টাকা পাই৷ এ টাকা একটু বাড়লে ভালো৷ এই বাজারে এই টাকায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
রাশেদ, বাস চালক
শ্রম অধিকার নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই৷ দিনে ১৬ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাই৷ মালিকের টার্গেট পূরণ হওয়ার পর যা পাই, সেটা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
জসিম উদ্দীন, বাসের হেলপার
শ্রম অধিকার হলো কাজের সঠিক পারিশ্রমিক পাওয়া৷ সেটা আমি পাই না৷ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটানা কাজ করি৷ সপ্তাহে একদিনও ছুটি পাই না৷ বাড়ি গেলে কাজ ছেড়ে যেতে হয়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
আসাদুল, রিকশা-ভ্যান চালক
শ্রম অধিকার কী বুঝি না৷ কাজ করলে টাকা পাই, না করলে পাই না৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
মোহাম্মদ রাজু, অটো রিকশা চালক
শ্রম অধিকার হলো আমার কাজের ন্যায্য পারিশ্রমিক পাওয়া৷ আমি সেটা পাই না৷ গাড়ির মালিকের জমা, পুলিশের অযথা হয়রানি, পথে পথে যাত্রীদের দুর্ব্যবহার – এ সব নিয়েই দিন চলে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
সোহেল হাওলাদার, রিকশা চালক
আমাদের আবার অধিকার কী? মানুষ আমাদের মানুষই মনে করে না৷ সবাই ভাড়া কম দিতে চায়৷ অনেক যাত্রীই খারাপ ব্যবহার করে, অনেকে গায়ে হাত তোলে৷ কিন্তু আমাদের কথা বলার কোনো জায়গা নেই৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
বাবলু মিয়া, রং মিস্ত্রী
শ্রম অধিকার কী জিনিস বুঝি না৷ কাজ শেষে টাকা পেলেই খুশি৷ সেটা পাইও৷ তবে অনেক ঝুঁকি নিয়ে বড় বড় বিল্ডিংয়ে কাজ করি৷ কোনো রকম দুর্ঘটনা হলে কোথাও থেকে কোনো সাহায্য পাই না৷ কাজ না থাকলে না খেয়ে থাকতে হয়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
10 ছবি1 | 10
ওয়াসা, ডেসা, বিদ্যুৎ বিভাগ, তিতাস গ্যাস, বিমান, প্রতিটি সেক্টরেই আছে সিবিএ বা কর্মচারি কল্যাণ সমিতি৷ অভিযোগ আছে, সিবিএ নেতারা প্রকৃতই শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণে যত না ব্যস্ত, তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত নিজেদের আখের গোছাতে৷ আর সবখানেই সরকার সমর্থক সিবিএ-র দাপট থাকে৷ প্রতিপক্ষরা থাকে কোণঠাসা৷ সরকার বদল হলে পরিস্থিতিও বদলে যায়৷
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের সংগঠন এবং আন্দোলন এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত৷ রানা প্লাজা ধসের পর থেকে শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করতে দেয়ার আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে৷ কিন্তু সাড়ে পাঁচ হাজারের মতো পোশাক কারখানা থাকলেও মাত্র ৬শ'র মতো কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়ন আছে৷
২০০৬ সালের জুন মাসে পোশাক শ্রমিকরা বড় ধরনের আন্দোলনের মাধ্যমে প্রথম তাঁদের অধিকার নিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়৷ মাসিক মাত্র ১,৬৬২ টাকা ৫০ পয়সা মজুরি নির্ধারণের বিরুদ্ধে তাঁরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন৷ কোনো শ্রমিক সংগঠন ওই মজুরি মানেনি৷ তখন তাঁরা তিন হাজার টাকার ন্যূনতম মজুরির দাবিতে আন্দোলন করেন৷ সরকার রানা প্লাজা ধসের পর পাঁচ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে৷
কলাম লেখক শাহ মো. জিয়াউদ্দিনের লেখা থেকে জানা যায়, শ্রমিকদের অধিকার ও দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে মে দিবস পালিত হয়৷ স্বাধীনতার পর মে দিবস রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে মহান মে দিবস উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে মে দিবসকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন৷
‘শ্রমিক আন্দোলন শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে তেমন নেই’
স্বাধীনতার পর দেশের শ্রম আন্দোলনে তৈরি হয় নানা বিভাজন৷ ১৯৭৩ সালে কর্ণফুলী কমপ্লেক্সে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়৷ এই শ্রমিক অসন্তোষে বহু শ্রমিক আহত হয়৷ ওই সময়ে টঙ্গী শিল্প এলাকায় শ্রমিক লীগ এবং শ্রমিক ফেডারেশনের মাঝে দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা দেয়৷ শ্রমিক সংগঠনগুলো নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়৷ ১৯৭৩ সালে প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যে সংঘাত চলতে থাকে৷ এই সংঘাতের জের ধরে চট্টগ্রামের বারবকুন্ড শিল্প এলাকায় অনেক শ্রমিক নিহত হয়৷ ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সদস্য পদ লাভ করে৷ ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের পর সারাদেশে একটি শ্রমিক সংগঠন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়৷ ওটাই ছিল একক জাতীয় শ্রমিক সংগঠন৷ তার নামকরণ হয় জাতীয় শ্রমিক লীগ৷
গবেষক আলতাফ পারভেজ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিক সংগঠনগুলো বড় ভূমিকা রাখে৷ এরপর শ্রমিকদের অধিকার আন্দোলনের বাইরেও আশির দশকে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) স্বৈরাচার এরশাদ সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়৷ তারা রাজনৈতিক দলের সমান্তরাল কর্মসূচি দেয়৷ কারণ, তারা তখন মনে করেছিল দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকলে শ্রমিকদের অধিকার আদায় করা সম্ভব নয়, সম্ভব নয় শ্রমিক আন্দোলন৷ কিন্তু এরশাদ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক সরকার শ্রমিক আন্দোলন এবং শ্রমিক নেতাদের দলীয় নেতায় পরিণত করে৷ ফলে শ্রমিক আন্দোলন বিভ্রান্ত হয়ে রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিতে পরিণত হয়৷ শ্রমিক নেতারা নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে শ্রমিকদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের স্বার্থে কাজ করে৷ সরকারের স্বার্থে কাজ করে৷ একই সঙ্গে শ্রমিক সংগঠন কিছু বামপন্থি নেতাদের হাতে চলে যায়৷ স্বাধীন শ্রমিক সংগঠন অস্তিত্ব হারায়৷ সরকার ও শিল্পপতিরা মনে করেন, এতেই শিল্পের লাভ৷ আশির দশকে যে পোশাক কারখানা বিকশিত হয়, তাতেও শ্রমিক সংগঠন বিরোধী মনোভাব স্পষ্ট হয়৷ আর কিছু শ্রমিক নেতার জনস্বার্থবিরোধী কাজের কারণে শ্রমিক আন্দেলনকে নেতিবাচক হিসেবে দেখা হয় তখন৷''
Moserafa Misu - MP3-Stereo
তিনি বলেন, ‘‘এরশাদের সময় শ্রমিক নেতাদের একাংশ এরশাদের হয়ে কাজ করেন৷ আদমজী জুট মিল এলাকায় তখন প্রায়ই শ্রমিক সংঘর্ষ হতো৷ ওই সময়ে শ্রমিক নেতাদের দ্বন্দ্বের শিকার হয়ে অনেক শ্রমিক নিহত হন৷ আদমজী জুট মিলকে তখন অস্ত্রাগারের সঙ্গে তুলনা করা হয়৷'' ওই সময় আলোচিত শ্রমিক নেতা কাজী জাফর আহমেদ এরশাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে মন্ত্রী হন৷
আলতাফ পারভেজ বলেন, ‘‘একসময় শ্রমিক আন্দোলন ছিল তেজগাঁ, টঙ্গী ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক৷ কিন্তু সেই অবস্থা এখন আর নাই৷ আর শ্রমিক আন্দোলনও শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে তেমন নেই৷''
শাহ মো. জিয়াউদ্দিনের লেখায়, ‘‘১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর শ্রমিক শ্রেণির সংগঠনগুলোতে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আদর্শিক চর্চার চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায় দলীয় রাজনৈতিক আদর্শিক ধারার চর্চা৷ ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করতে শুরু করলে শ্রমিক সংগঠনগুলোতে তার প্রতিফলন ঘটে, জামায়াতের মতাদর্শের ‘শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন' নামে শ্রমিক সংগঠন গঠিত হয়৷ এভাবেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিতে শ্রমিক সংগঠনগুলো জড়িয়ে পড়ে৷ ফলে শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থ রক্ষার পরিবর্তে শ্রমিক সংগঠনগুলো রাজনৈতিক নেতাদের গদি রক্ষা এবং গদিতে নেয়ার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত থাকে৷ এর ফলে দেখা যায়, শ্রমিক রাজনীতির নেতৃত্ব আর শ্রমিক শ্রেণির হাতে নেই৷''
গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ষাট, সত্তর এবং আশির দশকে পাট ও টেক্সটাইল কারখানাভিত্তিক শ্রমিক আন্দোলন ও ট্রেউ ইউনিয়নের ধারা ছিল ইতিবাচক৷ তখন মালিকপক্ষও এর তেমন বিরোধী ছিল না৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ব্যাংক ও সেবাখাতের ট্রেড ইউনিয়ন বা সিবিএ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়৷ কিন্তু আশির দশকে যখন তৈরি পোশাক কারখানার বিকাশ ঘটতে শুরু করে, তখন থেকেই এই খাতে ট্রেড ইউনিয়নবিরোধী মনোভাব ছিল প্রবল৷ হয়ত শতভাগ রপ্তানিমুখী হওয়া একটা কারণ হতে পারে৷ কিন্তু মালিকদের মনোভাব এতই নেতিবাচক হয় যে, যাঁরা পোশাক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়নের উদ্যোগ নেয়, তাঁদের ছাঁটাই করে, মামলা দেয় এবং নির্যাতন করে৷''
তিনি বলেন, ‘‘তাজরীন ফ্যাশান ও রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর পোশাক কারখানায় আন্তর্জাতিকভাবে ট্রেড ইউনিয়নের চাপ আসে৷ সরকার তা মেনেও নেয়৷ কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো, এখনও ৭৯ ভাগ কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়ন নেই৷''
মিশু বলেন, ‘‘পোশাক কারখানার মতো এখন অন্যান্য শিল্পেও শ্রমিক ইউনিয়নবিরোধী মনোভাব স্পষ্ট হয়েছে, যা অতীতে ছিল না৷ বিশেষ করে রি-রোলিং মিল, নির্মাণ শিল্পসহ অন্যান্য অনেক শিল্পে এই অবস্থা বিরাজ করছে৷''
বাংলাদেশের ২০১৩ সালের সংশোধিত শ্রম আইনে শ্রমিক নয়, এমন কেউ শ্রমিক ইউনিয়নের কাজে সরাসরি অংশ নিতে পারেন না৷ ফলে শ্রমিকদের সংগঠিত করায় শিক্ষিত লোকের সংকট দেখা যাচ্ছে৷ আবার সব রাজনৈতিক দলের নিজস্ব শ্রমিক সংগঠন থাকায় তাঁরা দলীয় সিদ্ধান্তে কাজ করেন৷ বিশেষ করে যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁদের শ্রমিক সংগঠন সরকারের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে৷ ফলে শ্রমিকদের জন্য স্বাধীন সংগঠন বিলুপ্ত প্রায়৷
আলতাফ পারভেজ বলেন, ‘‘স্বাধীন শ্রমিক সংগঠন শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য সহায়ক৷ শ্রমিক সংগঠন বা বার্গেইনিং এজেন্ট না থাকলে শিল্প প্রতিষ্ঠানে অনিয়ন্ত্রিত শ্রমিক আন্দোলন হতে পারে, যা প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকর৷ সরকার বিষয়টি ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে৷ মালিকরাও বুঝবেন আশা করি৷''আর মোশারেফা মিশু বলেন, ‘‘উৎপাদনে পুঁজির মতো শ্রমিকও একটি অংশ, তাই শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের কল্যাণ নিশ্চিত করেই উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা দরকার৷''
ঐতিহাসিক কয়েকটি শ্রম আন্দোলন
মে দিবসের চেতনা শ্রমিকদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে ১৮৯০ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মে দিবস পালনের সূচনা হয়৷ ছবিঘরে দেখে নিন বিশ্বের অন্যতম কয়েকটি শ্রম আন্দোলনের কথা৷
ছবি: picture alliance / Tass/dpa
হে মার্কেটের শ্রমিকদের আন্দোলন
১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা নেমেছিলেন তুমুল আন্দোলনে৷ তাঁদের দাবি ছিল, উপযুক্ত মজুরি এবং দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি কাজ নয়৷ মে মাসের প্রথম দিনেই শ্রমিকরা ধর্মঘটের আহ্বান জানায়৷ প্রায় তিন লাখ শ্রমিক যোগ দেয় সেই সমাবেশে৷ বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের রুখতে মিছিলে পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি চালায়৷ বহু শ্রমিক হতাহত হন৷
ছবি: picture-alliance/KPA/TopFoto
মে দিবস
পরে আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অপরাধে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় গ্রেপ্তারকৃত ছয় শ্রমিককে৷ কারাগারে বন্দিদশায় এক শ্রমিক নেতা আত্মহত্যাও করেন৷ পরের বছর প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে দিনটিকে মে দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস
বর্তমানে মে মাসের প্রথম দিনটিকে পুরো পৃথিবীতে পালন করা হয় ‘মে দিবস’ হিসেবে৷ পৃথিবীর সব শ্রমিকের লড়াই-সংগ্রাম-পরিশ্রমের প্রতি সম্মান জানানো হয় এই দিনে, শ্রদ্ধা জানানো হয় তাঁদের আত্মত্যাগের পুণ্যস্মৃতির উদ্দেশ্যে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. U. Zaman
শ্রমজীবী মানুষের সংগঠন
অ্যামেরিকা স্বাধীন হওয়ার আগে শ্রমজীবী মানুষের প্রথম সংগঠন গড়ে ওঠে ১৬৮৪ সালে৷ ঠেলাগাড়ির চালকরা প্রথম ঠেলা শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে তোলেন৷ ১৮৪২ সালে অ্যামেরিকায় শ্রমিক শ্রেণি ট্রেড ইউনিয়ন ধর্মঘট করার অধিকার পায়৷ বিশ্বের প্রথম নারী শ্রমিকদের ধর্মঘট পালিত হয় অ্যামেরিকায় ১৮২৩ সালে৷ বিশ্বের শিল্প-কারখানাগুলোয় শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয় ১৮২৮ সালে৷
ছবি: M. Cardy/Getty Images
আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সংগঠন
ঊনবিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রমিক শ্রেণি নিজ নিজ দেশে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলে৷ ১৮৬৪ সালে মার্কস- এঙ্গেলসের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি৷ ইতিহাসে এটাই প্রথম আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সংগঠন নামে খ্যাত৷
ছবি: AP
প্যারিস কমিউন
১৮৭১ সালের ১৮ মার্চ প্যারিসের শ্রমিকরা শহর থেকে বুর্জোয়া শাসকদের হটিয়ে নিজেদের হাতে ক্ষমতা নিয়ে নেয়৷ দশ দিন পরে ২৮ মার্চ তারিখে শ্রমিকরা গঠন করেছিল পৃথিবীর প্রথম প্রলেতারিয়েত রাষ্ট্র প্যারিস কমিউন৷
অক্টোবর বিপ্লব
অক্টোবর বিপ্লবকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত অঞ্চলগুলোয় বলা হয় ‘মহান অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’৷ ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়ায় বলশেভিকরা ক্ষমতা দখল করে, শুরু হয় ‘লাল’ আর ‘সাদা’-দের মধ্যে গৃহযুদ্ধ৷ অক্টোবর বিপ্লবের বিজয় রাশিয়াকে রাজনৈতিকভাবে একটি অগ্রসর রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পুঁজিবাদী দাসত্ব থেকে মুক্তি
এই বিপ্লব জনগণকে পুঁজিবাদী দাসত্ব থেকে মুক্ত করেছিল৷ এই বিপ্লব শ্রমিক শ্রেণি ও মেহনতি কৃষকের জন্য শুধু সামাজিক মুক্তিই আনেনি, রাশিয়ার গণতান্ত্রিক সমস্যাগুলোও সমাধান করতে সক্ষম হয়েছিল৷ লেনিন স্বয়ং ১৯২৪ সালে পরলোকগমন করেন, কিন্তু রুশ বিপ্লব, সোভিয়েত রাশিয়া বা কমিউনিজম, এ সবের সঙ্গে তাঁর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷
ছবি: picture-alliance/akg
তেভাগা আন্দোলন
১৯৩০ সালে বাংলার কয়েকটি জেলায় কৃষকরা তেভাগার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলেন৷ তেভাগা আন্দোলনের মূল দাবি ছিল, ভাগচাষিকে ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ দিতে হবে৷ এই আন্দোলনটি ছিল সম্পূর্ণ বর্ণ হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমান ও নমঃশূদ্র চাষিদের অসহযোগ আন্দোলন৷ এ আন্দোলনে জমিদারদের পাইক-বরকন্দাজদের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ করতে হয়েছিল কৃষকদের৷ ১৯৪৬ সালেও আর এক দফা আন্দোলন হয়েছিল৷
ছবি: AFP/Getty Images/R. Gacad
দক্ষিণ আফ্রিকা
দক্ষিণ আফ্রিকার খনি শ্রমিকদের ওপর নানা নির্যাতন, মজুরি বৃদ্ধি, থাকা-খাওয়া ও জীবনমান উন্নয়ন ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং ১৯৪৬ সালে ৭০ হাজার শ্রমিকের অংশগ্রহণে ধর্মঘট পালিত হয় কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে৷ এএনসি এই আন্দোলনে যোগদানের বিষয়ে নীরব থাকলেও ম্যান্ডেলা পরিচিত কয়েকজনকে নিয়ে কমিউনিস্ট নেতা জেবি মার্কসের সঙ্গে দেখা করে এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন৷
ছবি: dapd
জার্মানির শ্রমিক আন্দোলন
১৯৫৩ সালের ১৭ জুন তৎকালীন পূর্ব জার্মানির সরকারের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছিল শ্রমিকসহ সাধারণ জনগণ৷ বড় কোম্পানিগুলো জাতীয়করণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পূর্ব জার্মান সরকার, যার প্রতিবাদে ১৬ জুন থেকে আন্দোলন শুরু করেছিল কয়েকশ’ শ্রমিক৷ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে প্রায় ৭০০ শহরে৷ ১৭ জুন আন্দোলন থেকে সরকারের পদত্যাগ, স্বাধীন নির্বাচন অনুষ্ঠান ও দুই জার্মানির একত্রীকরণের দাবি ওঠে৷ সেনাদের গুলিতে নিহত হয় ৫০ জন৷
ছবি: Getty Images
শ্রমিক বিক্ষোভে উত্তাল ইউরোপ
স্পেন ও পর্তুগালে ২০১২ সালের ১৪ নভেম্বর বুধবার পালিত হয়েছিল সাধারণ ধর্মঘট৷ কর্মবিরতি পালন করেছিলেন গ্রিস ও ইটালির শ্রমিকরা৷ এই আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানায় বেলজিয়াম, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ডসহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো৷ এতে বিভিন্ন দেশের শিল্প-কারখানা অচল হয়ে পড়ে৷ বাতিল হয় ইউরোপের অনেক ফ্লাইট৷ চার দেশে একযোগে ধর্মঘট পালনের ঘটনা ইউরোপে এটিই প্রথম৷
ছবি: Reuters
ফ্রান্সে শ্রমিক আন্দোলন ২০১৬
একবিংশ শতাব্দীতে এসেও ফ্রান্সে সর্ববৃহৎ শ্রমিক বিদ্রোহ দেখা গিয়েছে ২০১৬ সালে৷ শ্রম আইন সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে অসন্তোষের জের ধরে জেনারেল কনফেডারেশন অব লেবার (সিজিটি) ইউনিয়নের ডাকে ধর্মঘটে ফ্রান্সের প্রায় সব বিভাগের শ্রমিকরাই অংশ নিয়েছিলেন৷ এ ধর্মঘটের একপর্যায়ে প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিক রাস্তায় নেমে আসেন৷ তাদের সঙ্গে শামিল হয় ছাত্র ও তরুণরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘট
হয়েছিল ১৯৮২ সালের ১৯শে জানুয়ারি সেই ধর্মঘট ছিল বৃহৎ, ঐতিহাসিক এবং সবদিক দিয়ে সফল৷ পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরালায় সর্বাত্মক বন্ধ পালিত হয়েছিল৷
ছবি: Reuters/D. Siddiqui
ভারতে শ্রমিক বিক্ষোভ
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ন্যূনতম মাসিক মজুরি ১৮ হাজার রুপি করা এবং শিল্প-কারখানার বেসরকারিকরণ ঠেকানোসহ ১৪ দফা দাবিতে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতজুড়ে সাধারণ ধর্মঘট পালন করেন সেবা খাতের লাখ লাখ শ্রমিক৷ ১৫ কোটির বেশি শ্রমিক এ বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন বলে সংগঠনগুলোর দাবি৷
ছবি: AP
15 ছবি1 | 15
বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলন আসলে কোন পথে? লিখুন নীচের ঘরে৷