ধর্মীয় নেতা এবং রাজনীতিবিদদের চাপে বন্ধ হয়ে গেছে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো যৌনপল্লিটি৷ স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে এই তথ্য৷ ইসলামপন্থিদের চাপে গত কয়েকবছরে একাধিক যৌনপল্লি বন্ধের ঘটনা ঘটলো৷
বিজ্ঞাপন
টাঙ্গাইলের কান্দাপাড়া যৌনপল্লিতে থাকতেন ৭৫০ জনের বেশি যৌনকর্মী৷ দু'শো বছরের পুরনো এই পল্লিটি গত রবিবার বন্ধ হয়ে গেছে৷ পুলিশের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কান্দাপাড়ার বাড়িঘরের মালিকরা যৌনকর্মীদের বের করে দেন৷ এরপর সেটি বন্ধ করে দেয়া হয়৷
টাঙ্গাইল জেলার পুলিশ প্রধান সালেহ মোহাম্মদ তানভীর এই বিষয়ে বলেন, ‘‘গত সপ্তাহে স্থানীয় ধর্মীয় নেতা এবং ‘সিভিল অ্যাক্টিভিস্টরা' যৌনপল্লিটি বন্ধের দাবিতে মিছিল করে৷ এরপরই মালিকরা সেটি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়৷''
বাংলাদেশের যৌনকর্মীদের কথা
পৃথিবীর আদিম এক পেশা পতিতাবৃত্তি৷ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই চালু রয়েছে এই পেশা৷ বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেমন আছেন বাংলাদেশের যৌনকর্মীরা? এই ছবিঘরে তাঁদের অবস্থা কিছুটা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images
যেভাবে যৌনপল্লীতে আগমন
বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার হয়ে যৌনপল্লীতে হাজির হন মেয়েরা৷ প্রত্যন্ত অঞ্চলের অতিদরিদ্র্য পরিবারের সদস্যরা কখনো কখনো অর্থের লোভে মেয়েদের বিক্রি করে দেন বলে জানিয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা৷ এছাড়া ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে কিংবা বিদেশ যাওয়ার লোভ দেখিয়েও মেয়েদের যৌনপল্লীতে আনা হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/Munir uz ZAMAN
যৌনকর্মীদের জন্য ‘গরুর ট্যাবলেট’
ফরিদপুরের সরকার অনুমোদিত যৌনপল্লীর ছবি এটি৷ অভিযোগ রয়েছে, পল্লীর মালিক নতুন আসা যৌনকর্মীদের স্টেরয়েড ট্যাবলেট সেবনে বাধ্য করেন, যা সাধারণত গরুকে খাওয়ানো হয়৷ গরুর স্বাস্থ্য বাড়াতে ব্যবহার করা এই ট্যাবলেট মানুষের দেহের জন্য ক্ষতিকর৷
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ‘ইনজেকশন’
বাংলাদেশের এক যৌনপল্লীর মালিক রোকেয়া জানান, স্টেরয়েড ওষুধ প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ভালো কাজে দেয়৷ কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক, বিশেষ করে ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সি মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি কার্যকর নয়৷ অপ্রাপ্তবয়সিদের স্বাস্থ্য ভালো করতে বিশেষ ধরনের ইনজেকশন ব্যবহার করা হয় বলে জানান ৫০ বছর বয়সি রোকেয়া৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/M. Candela
অধিকাংশ যৌনকর্মী ‘স্টেরয়েড আসক্ত’
আন্তর্জাতিক উন্নয়নসংস্থা একশনএইড ইউকে এক সমীক্ষার ভিত্তিতে ২০১০ সালে জানায় যে, বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ যৌনকর্মী ওরাডেক্সন বা অন্যান্য স্টেরয়েড ট্যাবলেট নিয়মিত গ্রহণ করে৷ তাঁদের গড় বয়স ১৫-৩৫ বছর৷ বাংলাদেশে দু’লাখের মতো যৌনকর্মী রয়েছে বলে ধারণা করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/M. Candela
সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ
স্টেরয়েড ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রচারণা চালাচ্ছে একশনএইড৷ সংস্থাটির বাংলাদেশ অংশের কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার জানিয়েছেন, ‘‘ওরাডেক্সন গ্রহণ করার পর শুরুতে মেয়েদের শরীরে চর্বির পরিমাণ বাড়তে থাকে৷ কিন্তু এটি নিয়মিত সেবন করলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, চামড়ায় ক্ষতসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়৷’’
ছবি: GMB Akash
এইচআইভি সংক্রমণ
বাংলাদেশে যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণ বা এইডস রোগ হওয়ার খবর মাঝে মাঝে পত্রিকায় প্রকাশ হয়৷ তবে ঠিক কতজন যৌনকর্মী এইচআইভি আক্রান্ত তার হালনাগাদ কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি৷ অনেকক্ষেত্রে কনডম ব্যবহারে খদ্দেরের অনীহা যৌনকর্মীদের মাঝে যৌনরোগ ছড়াতে সহায়ক হচ্ছে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: AP
‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ যৌনকর্মী
বাংলাদেশের যৌনপল্লীগুলোতে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের জোর করে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করানোর অভিযোগ রয়েছে৷ আর এই পেশায় যাঁরা একবার প্রবেশ করছেন, তাঁদের জীবনেও নানা ঝুঁকি থাকে৷ পতিতাপল্লীতে হামলার খবর কিন্তু মাঝেমাঝেই শোনা যায়৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
শত বছরের পুরনো পল্লী উচ্ছেদ
মাদারিপুরের পতিতাপল্লীটি ছিল শত বছরের পুরনো৷ গত বছর এই পল্লী উচ্ছেদ করেছেন স্থানীয়রা৷ এমনকি পল্লীটি জোরপূর্বক উচ্ছেদ না করার হাইকোর্টের আদেশও এক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হয়েছে৷ সেখানে পাঁচশ’র মতো যৌনকর্মী বাস করতেন৷ কিছুদিন আগে টাঙ্গাইলের একটি পতিতাপল্লীও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ এ রকম উচ্ছেদের আতঙ্কে রয়েছেন আরো অনেক যৌনকর্মী৷
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
মধ্যপ্রাচ্যে ‘যৌনদাসী’ বাংলাদেশের মেয়েরা!
বাংলাদেশের বেশ কয়েক নারীকে মধ্যপ্রাচ্যে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে৷ তাঁদের পাচার করে সিরিয়ায় নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে একাধিক বার্তাসংস্থা৷ এ সব নারীকে ফিরিয়ে আনতে সরকারি উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে৷ তবে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন পতিতালয়েও বাংলাদেশি নারীদের জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে নিয়োগ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
9 ছবি1 | 9
যৌনকর্মীরা কোনরকম প্রতিবাদ ছাড়াও পল্লি ত্যাগ করেছে বলে জানান পুলিশ প্রধান৷ তবে যৌনকর্মীদের একটি দলের প্রধান মনোয়ারা বেগম স্থানীয় মেয়রকে দোষারোপ করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘মেয়র শনিবার বেশ কয়েকজন তরুণকে পল্লিতে পাঠান৷ লাঠিসোঁটা হাতে তারা আমাদের হুমকি দিয়ে বলে, এক ঘণ্টার মধ্যে পল্লি ছাড়তে হবে৷ আর নাহলে গোটা এলাকায় কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে দেয়া হবে৷''
এই হুমকির পর পল্লির মালিকরা দ্রুত যৌনকর্মীদের বের করে দেন৷ সে সময় পল্লিতে থাকা ৭৭৩ যৌনকর্মীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে৷ এই সুযোগে তাদের টিভি, ফ্রিজসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র লুট করে নিয়ে যায় একদল মানুষ৷
যৌনপল্লি উচ্ছেদের বিষয়ে অবশ্য মেয়রের কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি৷ ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থা অ্যাকশন এইডের বাংলাদেশ অংশ জানিয়েছে, কান্দাপাড়ার যৌনপল্লিটি গত দু'শো বছর চালু ছিল৷ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে এটি প্রতিষ্ঠা হয়৷
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি যৌনপল্লি উচ্ছেদ করে দেয়া হয়েছে৷ গত বছর মাদারীপুরের যৌনপল্লিটি উচ্ছেদ করে স্থানীয় জনতা৷ তারও আগে ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত টানবাজার পল্লি বন্ধ করে দেয়া হয়৷