ঢাকার জার্মান দূতাবাস বাংলাদেশের সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় এগিয়ে এসেছে৷ আর তারা এ জন্য একটি প্রকল্পে মানবাধিকার সংগঠন ‘আর্টিক্যাল ১৯’-এর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করবে৷ এ নিয়ে জার্মান দূতাবাসে একটি চুক্তি সই হয়েছে৷
আর্টিক্যাল ১৯-এর আঞ্চলিক পরিচালক তাহমিনা রহমান ডয়চে ভেলেকে জানান, সাত মাসের এই প্রকল্পে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে৷ সেখানে তাঁদের অধিকারের জন্য আইনি প্রশিক্ষণ যেমন থাকবে, তেমনি তাঁরা কীভাবে ঝুঁকি এড়িয়ে কাজ করতে পারেন – সে বিষয়েও প্রশিক্ষণ দেয়া হবে৷ তাহমিনা জানান, সাংবাদিকদের বাছাই করা হবে সারাদেশ থেকে৷ ঢাকার সাংবাদিকরা যেমন থাকবেন, তেমনি ঢাকার বাইরের সাংবাদিকরাও থাকবেন৷
কেন খুন হয়েছেন সাগর, রুনি?
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে৷ কিন্তু আজও নিহতের পরিবার, শুভানুধ্যায়ী আর সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারলো না, কেন এই হত্যাকাণ্ড? এই বিষয়ে ছবিঘর দেখুন এখানে:
ছবি: DW
সেই কালোরাত
২০১২ সালের এগারোই ফেব্রুয়ারি৷ সেদিন খুব ভোরবেলা জানা গিয়েছিল, ঢাকায় নিজের ভাড়া বাসায় খুন হয়েছেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি৷ একই ফ্ল্যাটে থাকলেও প্রাণে বেঁচে যান তাদের একমাত্র শিশুপুত্র মেঘ৷
ছবি: dapd
সাগর সরওয়ার
দেশি-বিদেশি একাধিক গণমাধ্যমে কাজ করার পর ২০১১ সালে মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন সাগর সরওয়ার (ডানে)৷ সর্বশেষ সেই টেলিভিশন চ্যানেলেই কাজ করেছেন তিনি৷ ২০১২ সালের দশই ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে কাজ থেকে বাসায় ফেরার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই খুন হন সাগর৷
ছবি: DW
মেহেরুন রুনি
একাধিক দৈনিকে কাজ করার পর কয়েক বছর আগে টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলায় কাজ শুরু করেন মেহেরুন রুনি (বামে)৷ মাঝে স্বামীর সঙ্গে বছর দেড়েক জার্মানিতে কাটিয়েছেন তিনি৷ এরপর ২০১১ সালে আবারো ফিরে যান নিজের কর্মস্থলে৷
ছবি: DW
৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার!
১১ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন৷ বলাবাহুল্য, সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি৷
ছবি: DW
সাংবাদিকদের আন্দোলন
বাংলাদেশের বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের মধ্যে মতের অমিল থাকলেও সাগর-রুনি ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের ঘোষণা প্রদান করে সব সংগঠন৷ খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে গত এক বছরে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন সংগঠন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ
সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে গর্জে ওঠে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাঙালিরা৷ জার্মানিসহ কয়েকটি দেশে খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়৷ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনও খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিবৃতি প্রকাশ করেছে৷
ছবি: DW
ব্লগারদের প্রতিরোধ
সাংবাদিক সংগঠনগুলোর আন্দোলনের পাশাপাশি ব্লগাররা এই দম্পতি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে রাজপথে নামে৷ গত বছর এই ইস্যুতে ব্লগ ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ব্লগ৷ সামহয়্যার ইন ব্লগে এখনো রয়েছে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্যানার৷
ছবি: DW
রিপোটার্স উইদাআউট বর্ডার্স
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে রাজপথে ব্লগারদের সক্রিয় আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকাসহ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ইত্যাদি ইস্যুতে ব্লগ লিখে ডয়চে ভেলের দ্য বব্স প্রতিযোগিতার রিপোটার্স উইদাআউট বর্ডার্স অ্যাওয়ার্ড জয় করে আবু সুফিয়ানের বাংলা ব্লগ৷ ছবিতে আন্দোলনরত আবু সুফিয়ান৷
ছবি: DW
নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাটকীয় ঘোষণা
গত অক্টোবর মাসে নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে ‘জড়িত’ আটজনকে চিহ্নিত করে সাতজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানান৷ বাকি একজনকে গ্রেপ্তার করা হয় গত সপ্তাহে৷ ব়্যাব গ্রেপ্তারকৃতদের বলছে ‘সন্দেহভাজন’৷ আর পরিবার মনে করছে, এদেরকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে কার্যত ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজানো হচ্ছে৷
আন্তর্জাতিক তদন্ত চান পরিবার
সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের এক বছর হলেও তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই৷ ধরা পড়েনি মূল অপরাধীরা৷ তাই তাদের পরিবার এখন আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি করেছেন৷ রুনির ভাই নওশের রোমান জানিয়েছেন, তারা (ব়্যাব) তদন্তের চেয়ে হয়রানি করতে বেশি উৎসাহী৷ সাগর রুনির একমাত্র সন্তান মেঘের নিরাপত্তাও প্রত্যাহার করা হয়েছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
জজ মিয়া নাটক চান না সাগরের মা
সাগরের মা সালেহা মনির এখনও কাঁদেন৷ তাঁর দাবি হচ্ছে, প্রকৃত অপরাধীদের ধরতে হবে৷ এক বছর পর দারোয়ান এনামুলকে গ্রেফতার তাঁর কাছে জজ মিয়া নাটক ছাড়া কিছুই নয়৷ তাঁর মতে, এক বছরে নানা টালবাহানা করে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা চলছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
11 ছবি1 | 11
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে সাংবাদিকরা অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশে এবং ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন৷ তাই তাঁদের তথ্য অধিকার, সংবিধান অনুযায়ী মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং এই সংক্রান্ত আইন ও বিধি বিধানের ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা থাকা উচিত৷ একই সঙ্গে এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক নীতি, আইন এবং বিধি সম্পর্কেও তাঁদের ধারণা থাকা দরকার৷ এ সব জানা থাকলে তাঁরা অনেকটাই ঝুঁকি এড়িয়ে কাজ করতে পারবেন৷ এছাড়া সাংবাদিকদের অধিকার, বিশেষ করে তথ্য সংক্রান্ত অধিকার সম্পর্কেও সম্যক ধারণা থাকতে হবে৷'' এই ধারণা তাঁকে তাঁর অধিকার সম্পর্কে সচেতন করবে বলে জানান তাহমিনা রহমান৷
তাহমিনা রহমান বলেন, ‘‘আমরা চাই সাংবাদিকরা ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশে স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা করবেন৷ এই প্রকল্পের মাধ্যমে তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সেভাবেই তাঁদের প্রস্তুত করার চেষ্টা করা হবে৷'' শীঘ্রই এই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে বলেও জানান তিনি৷
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ‘আর্টিক্যাল ১৯' বাংলাদেশে নারী সাংবাদিকদের জন্য এরই মধ্যে একাধিক প্রকল্প শুরু করেছে৷ সেসব প্রকল্পেও নারী সাংবাদিকদের অধিকার এবং তাঁদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ হচ্ছে৷
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান জার্মান সরকার এবং আর্টিক্যাল ১৯-এর এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এতে প্রকারন্তরে বাংলাদেশের গণতন্ত্রই লাভবান হবে৷ কারণ সাংবাদিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত হলে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত হবে৷ তথ্যে নাগরিকদের প্রবেশাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে৷''