বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা : তৃতীয় হামলাতেও ‘বাহিনী' আসে না
৮ এপ্রিল ২০২৫
ফিলিস্তিনের মানুষদের প্রতি সংহতি এবং ইসরায়েলের হামলার প্রতিবাদ জানাতে সোমবার দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল হয়। বিক্ষোভের সময় কেএফসি, পিৎজা হাট, বাটা-সহ এক ডজনের বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট চলে। এমন ঘটনা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর ব্যর্থতা তাই নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
পুলিশ কেন হামলাকারীদের প্রতিহত বা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেনি- এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এত মানুষের মধ্যে অল্প সংখ্যক পুলিশের কী করার ছিল? খুলনার ভিডিওটির মধ্যে দেখবেন ১০-১২ জন পুলিশ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু বিক্ষোভে ছিলেন কয়েক হাজার মানুষ। এত মানুষকে পুলিশ কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে? তবে হ্যাঁ, আমরা গুলি ছুড়তে পারতাম। কিন্তু গত ১৫ বছরের সেই পুলিশিং তো এখন নেই। আমরা তো জনতার উপর গুলি করি না। কোনো দেশে যদি ৯০ ভাগ মানুষ ভালো হয় আর ১০ ভাগ মানুষ খারাপ হয়, সেখানে পুলিশ সেই অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। এখন এই ধরনের কার্যকলাপে যদি ৯০ ভাগ মানুষই অংশ নেয়, পুলিশ সেখানে কী করবে? পরবর্তীতে কিন্তু আমরা ৫৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছি। ভিডিও দেখে দেখে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।”
সোমবার সন্ধ্যায় খুলনা শহরের ময়লাপোঁতা এলাকায় অবস্থিত কেএফসি ও ডোমিনোজ পিৎজা এবং শিববাড়ী এলাকায় অবস্থিত বাটা শোরুমে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। কেএফসি ও ডোমিনোজ পিৎজা রেস্টুরেন্ট একই ভবনে অবস্থিত। একই সময়ে শিববাড়ী মোড়ের টাইগার গার্ডেন হোটেলের নীচে থাকা বাটা শোরুমে ভাংচুর করা হয়।
সিলেটে একদিনে তিনবার
সোমবার সিলেটও বিভিন্ন বিক্ষোভ কর্মসূচিতে উত্তাল ছিল। বিকেলের দিকে নগরের মিরবক্সটুলা এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল থেকে কেএফসিতে ব্যাপক ভাংচুর চালানো হয়। এরপর বাটা, ইউনিমার্ট, আলপাইন রেস্তোরাঁসহ প্রায় ১০টি প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়।
সিলেটে কেএফসি যে ভবনে সেই ভবনটির মালিক ফয়সাল আহমেদ চৌধুরী। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "প্রথম দফায় বিক্ষোভকারীরা কেএফসি ভেঙে গেছে। বুঝলাম আবেগ থেকে কেএফসি ভেঙেছে। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় এসে তারা বিল্ডিংয়ের সামনের সবগুলো গ্লাস ভেঙে ফেলেছে। এরপর তৃতীয় দফায় আরো প্রস্তুতি নিয়ে রড-শাবল হাতে এসে আমার রয়েল মার্ক হোটেল ভাংচুর করেছে। এই যে তিন দফায় হামলাকারীরা ভাংচুর করে গেল, তখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কোথায় ছিল? প্রথমে না হয় তারা বোঝেনি- বুঝলাম। কিন্তু পরেও তো তারা আসেনি। কিছু উচ্ছৃঙ্খল ছেলে নির্বিচারে তিন দফা এসে ভেঙে গেল, কেউ কিছু বলল না।”
গাজীপুরে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট
গত সোমবার শুধু সিলেট এবং খুলনার মতো গাজীপুরের বোর্ডবাজার এলাকাতেও প্রতিবাদ মিছিল হয়। বোর্ডবাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে থেকে শুরু হওয়া মিছিলটি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক হয়ে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি) গেট পর্যন্ত গিয়ে আবার বোর্ডবাজারে এসে শেষ হয়। বিক্ষোভ মিছিল থেকে এক পর্যায়ে বাটার শোরুম ও কয়েকটি রেস্তোরাঁয় হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট চালানো হয়।
চট্টগ্রামে কাচের দেয়ালও রক্ষা পায়নি
সোমবার বিক্ষোভের সময় চট্টগ্রাম নগরের জিইসি এলাকায় পাঁচটি দোকানে ভাঙচুর ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে একদল লোক। এ সময় চারটি রেস্তোরাঁ ও একটি জুতার দোকানে ব্যাপক ভাংচুর চালানো হয়। দুটি রেস্তোরাঁর বাইরের কাচের দেয়ালও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
কক্সবাজার : মিছিলের সামনে-পিছে পুলিশ, মাঝখানে হামলাকারী
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল জোনে পাঁচটি রেস্তোরাঁয় ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে ভাংচুর চালানো হয়। আগে-পিছে পুলিশ থাকলেও মিছিলের মাঝখানে থাকা কিছু লোক রেস্তোরাঁগুলোতে ভাংচুর চালায়।
হামলা প্রতিহত করায় ব্যর্থতার দায়
দেশের বিভিন্ন স্থানে এমন হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট প্রতিরোধের মূল দায়িত্ব পুলিশের হলেও ব্যর্থতার দায় সেনাবাহিনীও এড়াতে পারে না বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জাহেদ উর রহমার। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "এখন তো ম্যাজিষ্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে সেনাবাহিনী মাঠে আছে। তারা কী করছেন? এই ঘটনাগুলোর মাধ্যমে আমরা বিশ্বকে কি বার্তা দিচ্ছি? এখানে সরকারের কোনো অবস্থান আছে বলে কি মনে হচ্ছে? কেউ কেউ বলছেন, বিনিয়োগ সম্মেলন চলাকালে এই ঘটনা বিশ্বে খারাপ বার্তা যাচ্ছে। আসলে এখানে বিনিয়োগের পরিবেশ বহুদিন ধরেই নেই। ঠিকভাবে জ্বালানি সরবরাহ করা যায় না, মূদ্রা বাজার অস্থিতিশীল, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তো আছেই। এর বাইরে অল্প কয়েকদিনের জন্য থাকা এই সরকারের আশ্বাসে বিদেশিরা কেন বিনিয়োগ করবেন? ফলে সেই আলোচনা বাদ দিলেও বিক্ষোভের মধ্যে আইএসের পতাকা উড়ানো নিয়ে মারামারিসহ নানা রূপ আছে।”
তবে এই ঘটনার মাধ্যমে বিশ্বে অত্যন্ত খারাপ বার্তা যাওয়ার কথা উল্লেখ করলেও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের চেয়ারম্যান, নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল আ. ন. হ. মুনিরুজ্জামান মনে করেন ব্যর্থতার দায় সেনাবাহিনীকে দেয়া ঠিক হবে না, "সেনাবাহিনীকে দায় দিলে হবে না। পুলিশের কাজ তো সেনবাহিনী করবে না। যে পরিমাণ সেনাসদস্য মাঠে কাজ করছেন, তারা তো পুলিশের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। একটা জেলায় কয়জন সেনাসদস্য আছে? তারপরও দেখেন, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনী সিলেটের ওই ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। অথচ এটা করার কথা ছিল পুলিশের।'' তিনি মনে করেন, ‘‘পুলিশ চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। পুলিশ যে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত নয়, সেটা এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আরেকবার প্রমান হলো।”
বিনিয়োগ সম্মেলন চলার সময় এসব হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটের এসব ঘটনা প্রসঙ্গে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, "এমন এক সময়ে যখন আমরা বাংলাদেশকে বিনিয়োগের গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরার জন্য একটি শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করছি, তখন আমাদের দেশবাসীর কাছে এ ধরনের দুঃখজনক উদাহরণ স্থাপন করা দুঃখজনক। এসব ব্যবসার বেশিরভাগই স্থানীয় বিনিয়োগকারী, কেউ কেউ বিদেশি, যারা বাংলাদেশকে বিশ্বাস করতেন। তারা সবাই দেশের তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। যারা এই জঘন্য ভাংচুর করেছে, তারা কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতার প্রকৃত শত্রু।”
ফরেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাষ্ট্রির নির্বাহী পরিচালক টিআইএম নুরুল কবীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এই ধরনের হামলার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। বিষয়টি আমরা বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যানসহ সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে এনেছি। সরকারের তরফ থেকে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমরা তাদের পদক্ষেপগুলোর দিকে নজর রাখছি। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন।”
বিএনপির নিন্দা
সোমবার দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, "আমরা বলতে চাই, সরকারের ও আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা এখানে লক্ষণীয়। সরকারের উদ্দেশ্যে বলবো, আপনাদের উচিত ছিল আগে থেকেই এখানে সতর্কতা নিশ্চিত করা। তাহলে দেশের নামে এই বদনাম আমাদের হতো না।”
অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু ডয়চে ভেলেকে বলেন, "একটা দেশে যদি আইন-শৃঙ্খলা ঠিক না থাকে, তাহলে বিনিয়োগ হবে কিভাবে? নির্বাচিত সরকার যদি না থাকে, তাহলে মানুষ কার কাছে গিয়ে বিচার চাইবে? এ জন্য আমরা বলছি, একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার এলে এই ধরনের ঘটনা কমে যেতো। ফলে নির্বাচনটা দ্রুত হওয়া দরকার।”
পণ্য বর্জনের আহ্বান
এদিকে সোমবার বিভিন্ন শহরে বাটা, কেএফসিসহ বিভিন্ন দোকান, রেস্তোরাঁয় হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট চালানোর দেশের বিভিন্ন স্থানের দোকান ও চেইন সুপারশপগুলোতে গিয়ে নির্দিষ্ট কিছু পণ্য না রাখার নির্দেশনাও দেয়া হয়। কেউ কেউ নানা ধরনের হুমকি দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। ফলে মালিকরা কী রাখবেন আর কী রাখবেন না সে বিষয়ে দ্বিধান্বিত এবং শঙ্কিত। বাটাসহ একাধিক অবশ্য এরই মধ্যে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। প্রকৃত তথ্য না জেনে এ ধরনের তালিকা না ছড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছেন কেউ কেউ।
হামলার ঘটনা ‘ভিত্তিহীন ও মিথ্যা তথ্যের ফল'
আন্তর্জাতিক জুতা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান বাটা সম্প্রতি বাংলাদেশে তাদের কয়েকটি আউটলেটে হামলার ঘটনাকে ‘ভিত্তিহীন ও মিথ্যা তথ্যের ফল' বলে দাবি করেছে। বাটার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক বিবৃতির মাধ্যমে জানানো হয়, "বাটা কোনো ইসরায়েলি মালিকানাধীন কোম্পানি নয় এবং চলমান ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাতের সঙ্গে তাদের কোনো রাজনৈতিক সংযোগ নেই। বাটা গ্লোবালি একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন পারিবারিক প্রতিষ্ঠান, যার মূল সূচনা হয়েছিল চেক রিপাবলিকে। আমাদের কোনো রাজনৈতিক সংঘাতের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রশ্নই ওঠে না।”