অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে বার বার জোর দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বলা হচ্ছে নির্বাচন ভন্ডুলের ষড়যন্ত্রের কথাও। তাই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে অনেকের মনেই রয়েছে শঙ্কা৷
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারের সামনে নির্বাচন নিয়ে প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আস্থা ফিরিয়ে আনা। এই আস্থা নাগরিকদের মধ্যে যেমন ফিরিয়ে আনতে হবে, তেমনি ফেরাতে হবে রাজনৈতিক দলের মধ্যেও। ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
বিজ্ঞাপন
‘‘ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের কোন বিকল্প আমাদের হাতে নেই” এই বক্তব্য দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বৃহস্পতিবার একথা বলেছেন তিনি।
নির্বাচন কমিশন এরইমধ্যে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা না করলেও রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। কিন্তু নতুন করে সীমানা নির্ধারণের পর দেশের কয়েকটি স্থানে এই সীমানা নিয়ে চলছে বিক্ষোভ। ৩০০ আসনে নতুন করে সীমানা নির্ধারণ করার কারণে ৩৭টি আসনে পরিবর্তন এসেছে। আর এর প্রভাব পড়েছে ঢাকাসহ সারাদেশের ৪৬টি আসনে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ১১ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার এক ব্রিফিং-এ বলেছেন," সবদল সৎ থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে কোনো বাধা নেই, দেশের মানুষ উৎসব মুখর পরিবেশে ভোট দিতে আসবে। কোনো শক্তিই সুষ্ঠু নির্বাচন ঠেকাতে পারবে না।” তার কথা," সুষ্ঠু নির্বাচন শুধু সরকারের ইচ্ছায় নয়, সমাজের বিভিন্ন অংশ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার ওপরও নির্ভর করে। ইলেকশন করে সোসাইটি, পলিটিকাল পার্টিগুলো- তারা যদি চায়, তাহলে একটি ভালো নির্বাচন অবশ্যই সম্ভব।'' তিনি আরো জানান,‘‘নির্বাচনি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রায় আট লাখ পুলিশ, বিজিবি ও আনসার সদস্য মোতায়েন থাকবে।''
এর মাত্র পাঁচদিন আগে শফিকুল আলম বলেছেন," নির্বাচন যে করেই হোক ফেব্রয়ারির প্রথমার্ধে হবে। পৃথিবীর কোনো শক্তি নাই এই নির্বাচনকে ঠেকাতে পারে। সেজন্য যত প্রস্তুতি লাগে সেগুলো নেয়া হচ্ছে।”
নির্বাচন নিয়ে জনমনে শঙ্কা-সংশয়
ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য ও সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েও মানুষের মধ্যে শঙ্কা রয়েছে। এসব বিষয়ে ডয়চে ভেলের সাথে কথা বলেছেন রাজনীতিবিদ, বিশ্লেষক, সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীরা।
জনমনে স্বস্তি ফেরেনি, নির্বাচন হবে কীভাবে?: রুহিন হোসেন প্রিন্স, সাধারণ সম্পাদক, সিপিবি
নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার তিনটি কারণ আছে। প্রথমত, জনজীবনে স্বস্তি ফেরেনি, এর মধ্যে নির্বাচন হবে কীভাবে? দ্বিতীয়ত, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের আরও কিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ দরকার ছিল। যেমন, রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনি যাত্রায় শামিল করার দরকার ছিল, যেটা তারা করেনি। তৃতীয়ত, সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনবিরোধী অবস্থান নিয়েই কথা বলছে। ফলে মানুষের মধ্যে সংশয় তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক।
ছবি: DW
রাজনৈতিক অনৈক্য ও নিরাপত্তাহীনতা নির্বাচনে বাধা : মনিরা শারমিন, যুগ্ম আহবায়ক, এনসিপি
মানুষের মধ্যে শঙ্কার অনেক কারণ আছে। মূলত দলগুলোর মধ্যে ঐক্য তৈরি হয়নি। এটা নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে বড় প্রভাবক। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে এখন তো সবার মাঠে থাকার কথা। বিশেষ করে একটি দল যারা শুরু থেকেই নির্বাচনের কথা বলছে তারাও কিন্তু মাঠে নামেনি। তারাও জানে, রাজনৈতিক ঐক্য ছাড়া নির্বাচন সম্ভব না৷ মানুষ গত তিনটা নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি। নির্বাচনহীনতার একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।
ছবি: Privat
জামায়াত-এনসিপির শর্ত শঙ্কা তৈরি করেছে : ডা. জাহেদ উর রহমান, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
কতগুলো যৌক্তিক কারণেই সংশয় তৈরি হয়েছে। এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ মাঠে নেই। মূল দল জামায়াত ও এনসিপি নানা ধরনের শর্ত দিচ্ছে নির্বাচন নিয়ে। যেগুলো দেখে মনে হতে পারে তারা নির্বাচন চায় না। এটাই মানুষের মধ্যে সংশয় তৈরি করেছে। এই মুহূর্তে সবার নির্বাচনের মাঠে থাকার কথা। কিন্তু জামায়াত-এনসিপি যেসব শর্ত দিচ্ছে সেগুলো পূরণ না হলে তারা নির্বাচন করবে না। ফলে আদৌ নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা তো আছেই।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নির্বাচন ছাড়া সরকারের বিকল্প নেই : রোকসানা খন্দকার, আইনজীবী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের অভাব দেখা যাচ্ছে। কয়েকটি দল শর্ত দিচ্ছে, এটা না হলে, ওটা না হলে তারা নির্বাচনে যাবে না। এই শর্তের কারণে মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবে যতই শঙ্কা থাক, বর্তমান সরকার কিন্তু বুঝতে পেরেছে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, বিনিয়োগ নেই, কর্মসংস্থান নেই এতে মানুষ দারুনভাবে ক্ষুব্ধ। ফলে যত শঙ্কাই থাক না কেন, নির্বাচন দেওয়া ছাড়া এই সরকারের কোন বিকল্প নেই।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
আইন শৃঙ্খলা হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ: মোস্তফা ফিরোজ, সিনিয়র সাংবাদিক
তিনটা দলকে গুরুত্ব দেন ড. ইউনূস। এর মধ্যে জামায়াত ও এনসিপি পিআর সিস্টেমে নির্বাচন চায়। তাদের এই দাবির কারণে এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। আর বিএনপিও অগোছালো। তারেক রহমান দেশে নেই, প্রার্থী বাছাই করে যে তারা মাঠে নামবে সেটাও দেখা যাচ্ছে না। এসব কারণে অনিশ্চয়তা। আর আইনশৃঙ্খলা হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ। পুলিশ আসলে প্রস্তুত না। সেনাবাহিনী দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। এই কারণেও শঙ্কা বেড়েছে।
ছবি: Privat
নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে : সাইদুর রহমান, রাজনীতি ও নির্বাচন বিষয়ক সম্পাদক, ইত্তেফাক
ভোট ব্যবস্থাপনার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা আছে। ভোটারদের কেন্দ্রে উপস্থিত নিশ্চিত করার পাশাপাশি আরেকটি চ্যালেঞ্জ নির্বাচন কমিশনকে কঠিন সংকটের মুখোমুখী ফেলতে পারে। সেটি হল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিস-ইনফরমেশন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে ছবি বা ভিডিও বানিয়ে ছড়িয়ে দেয়া। ভোট না হওয়া পর্যন্ত শঙ্কা থাকবে। এখনো নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার সুযোগ চাই : অর্পিতা সাহা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জীবনের প্রথম ভোট হিসেবে আমি চাই পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে। এই নির্বাচন যেন সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক হয়। যেখানে প্রতিটি দল সমান সুযোগ পাবে। আমার প্রত্যাশা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এমন সরকার নির্বাচিত হবে, যারা সত্যি জনগণের আশা ও কল্যাণ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবে। বর্তমান সরকারের প্রতি জনগণের অনেক প্রত্যাশা ছিল, কিন্তু সেই প্রত্যাশাগুলো পূরণ হয়নি। তাই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নির্ভয়ে ভোট দিতে চাই : রাতুল হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জনগণ ভেবেছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই হবে পরিবর্তনের প্রতীক। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে, দুর্নীতি কমাবে, উন্নয়নের গতি বাড়াবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ব্যর্থতাই বেশি। জনগণের আস্থা টিকিয়ে রাখতে হলে আর সময়ক্ষেপণের সুযোগ নেই। ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হতে হবে। একেবারেই স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক, যেখানে কোনো দল বিশেষ সুবিধা না পায়। জীবনের প্রথম ভোট হিসেবে আমি নির্ভয়ে যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দিতে চাই।
জাতীয় নির্বাচনে একজন তরুণ ভোটার হিসাবে আমার প্রধান প্রত্যাশা হলো সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব পাওয়া। আমি চাই শিক্ষা, কর্মসংস্থান প্রযুক্তিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হোক। দুর্নীতি কমানোসহ নারী হিসাবে আমার সমান সুযোগ ও নিরাপদ পরিবেশ প্রত্যাশা করি। সবশেষে, আমি এমন নেতৃত্ব চাই যারা ন্যায়ভিত্তিক ও উন্নত বাংলাদেশ গড়বে।
ছবি: Privat
নির্বাচন যেন অবাধ সুষ্ঠু হয় : আবু বকর অনিক, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
আমি এখনও কোন নির্বাচনে ভোট দেইনি। জীবনে প্রথম ভোট দেবো রাকসু নির্বাচনে। আর ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে চাই। সেই নির্বাচনটি যেন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়। যাতে জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে নির্বাচিত করতে পারে এবং একজন প্রকৃত স্বদেশপ্রেমী প্রতিনিধির মাধ্যমে সংসদে তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয়।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
10 ছবি1 | 10
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. জাহেদ উর রহমান বলেন," আপনি যখন বার বার কঠোরভাবে বলবেন যে নির্বাচন হবেই, তার মানে হলো আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি আছে। অনেক বেশি শপথ করছি যদি বার বার বলা হয় তাহলে কনফিউশন দেখা দেয়। তাহলে একটা সমস্যা আছে।”
তবে নির্বাচন নিয়ে কাজ করা "ডেমোক্রেসি ডায়াসের” চেয়ারম্যান ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, "এই বার বার বলার মধ্য দিয়ে আসলে নির্বাচন নিয়ে সংশয় কেটে যাচ্ছে।” তার মতে," নানা কারণে এর আগে নির্বাচন কবে হবে সেটা নিয়েই একটি সংশয় ছিলো। এখন ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা সরকার বলছে। আর বার বার বলার মধ্য দিয়ে সরকার সেটা নিশ্চিত করছে। এটা মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করছে।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারের সামনে নির্বাচন নিয়ে প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আস্থা ফিরিয়ে আনা। এই আস্থা নাগরিকদের মধ্যে যেমন ফিরিয়ে আনতে হবে, তেমনি ফেরাতে হবে রাজনৈতিক দলের মধ্যেও। আর রাজনৈতিক দলের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা জরুরি। তাদের কথা, নির্বাচনে আইন শৃঙ্খলাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচন কমিশনের একক যে কাজ তা সরকার সহায়তা করলে তেমন কোনো চ্যালেঞ্জ না। আসল কাজ হলো সাবাইকে নির্বাচনমুখী করা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং এআই নির্ভর গুজব ও অপপ্রচার নির্বাচন কমিশনের জন্য নতুন আরেকটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দেবে: জেসমিন টুলি
This browser does not support the audio element.
সাবেক নির্বাচন কমিশনার জেসমিন টুলি বলেন," নির্বাচন কমিশনের ওপর ভোটারের , রাজনৈতিক দলের আস্থা ফিরিয়ে আনা দরকার। কারণ নির্বাচন কমিশনের ওপর তোআগের সরকারের আমলে আস্থা পুরোপুরি চলে গেছে। আর সরকারকেও এটা নিয়ে কাজ করতে হবে। আর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এখনই ঘটাতে হবে। মানুষের মধ্যে নিরাপত্তার প্রতি আস্থা তৈরি করতে হবে। কারণ এটা নির্বাচনের জন্য খুবই জরুরি।”
বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি নির্বাচনমুখী হয় তাহলে নির্বাচন নিয়ে যেকোনো ধরনের অনিশ্চয়তা কেটে যাবে। এখন বিএনপি, জামায়াত এবং এনসিপির মধ্যে নির্বাচন নিয়ে নানা ইস্যুতে অনৈক্য আছে। জুলাই সনদ নিয়ে আছে মতবিরোধ। এর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে তাদের মধ্যে ঐকমত্য হয়নি। বিএনপি চায় নির্বাচিত সংসদ এটা করবে। জামায়ত গণভোট চায়। আর এনসিপি চায় গণপরিষদ নির্বাচন। এই ইস্যুর সমাধান প্রয়োজন। আর জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ করারও একটা ইস্যু আছে। জামায়াত চায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম যেভাবে নির্বাহী আদেশে সন্ত্রাস দমন আইনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, জাতীয় পার্টির কার্যক্রমও সেভাবেই নিষিদ্ধ করা হোক। এনসিপিও তাই চায়। তবে বিএনপির কথা কোনো নির্বাহী আদেশে নয়, সেটা করা হোক বিচারের মাধ্যমে।
কেমন ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর?
13:05
This browser does not support the video element.
ড. জাহেদ উর রহমান মনে করেন," নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে এই ইস্যু তত বড় হবে। এটা রাজনীতিতে একটা বড় বার্গেনিং ইস্যু হবে। কারণ জাতীয় পার্টি নির্বাচন করতে পারলে সেটা আসলেই জামায়াত এবং এনসিপির জন্য হুমকি হবে। বিরোধী দলের প্রশ্নে জামায়াত অনিশ্চয়তায় পড়ে যাবে। আবার জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ হলে সেটা বিএনপিকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। কারণ তখন জামায়ত ও এনসিপি মিলে বিএনপিকে বড় ধরনের চাপ দিতে পারবে।”
ড. আব্দুল্লাহ আল মামুনও মনে করেন," প্রধান বিরোধী দল হতে হলে যে আসন পেতে হবে তা জামায়াত নিশ্চিত করতে চাইবে। এরপরে আমি মনে করি এনসিপিও সেটা চাইবে। এখানে জাতীয় পার্টি নিয়ে তাই একটি হিসাব আছে। জাতীয় পার্টি নির্বাচনে থাকলে এটা তাদের জন্য একটা থ্রেট তৈরি করবে। আর জাতীয় পার্টির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের তো পুনর্বাসন হতে পারে। এখন ওই দুইটি দল যদি দেখে এই আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে তাহলে তারা জাতীয় পার্টির ব্যাপারে তাদের অবস্থান নিয়ে চাপ বাড়াতেই থাকবে।”
শেষ পর্যন্ত সব রাজনৈতিক দলই নির্বাচনে আসবে বলে আমার বিশ্বাস: কাজী মারুফুল ইসলাম
This browser does not support the audio element.
বিশ্লেষকরা মনে করছেন- সরকারের সামনে নির্বাচন নিয়ে মোটাদাগে যে চ্যালেঞ্জ আছে সেগুলো ঠিক করতে আগে দরকার রাজনৈতিক সমঝোতা। কারণ নির্বাচনে মূল প্লেয়ার হলো রাজনৈতিক দল। কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকার কারণে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। ফলে বাকি যে দলগুলো আছে তাদের সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করতে পারলে সেটা ইনক্লুসিভ হবে।
ড. আব্দুল্লাহ আল মামুনের মতে," জুলাই সনদ সেই ব্যাপারে সরকারের সামনে আরো একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করে রেখেছে। জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতের ভিন্নতা আছে। এখন সরকারকে সেটা সমাধান করতে হবে। এটার সমাধান না হলে নির্বাচনের গতিটা ঠিক আসবে না৷ আর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মনোবলও ভেঙে দিয়েছে। সেটা দ্রুত পুনরুদ্ধার করা দরকার। তা না হলে আশঙ্কা থেকেই যাবে। সরকার চাইলে প্রচলিত বাহিনীর পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক ভলান্টিয়ারও তৈরি করতে পারে। সামাজিভাবে উদ্যোগেরও ব্যবস্থা করতে পারে।”
বিশ্লেষকদের মতে, আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের মূল চ্যালেঞ্জগুলো হল:
১. নাগরিক ও রাজনৈতিক দল সবার জন্য আস্থার পরিবেশ তৈরি করা
২.আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন
৩. জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করা
৪ .রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ দূর করা
৫.জাতীয় পার্টি ইস্যুতে একটা সমাধানে আসা
৬. প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা
যে ছয়টি বিষয়ে পরিবর্তন চান সব শ্রেণি, পেশার মানুষ
জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে৷ দুর্নীতি, নারীবিদ্বেষ, চাঁদাবাজি, নিরাপত্তাহীনতা, বিচারহীনতা ও অনৈক্য - এই ছয়টি বিষয় নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন তারা ৷ দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Arafatul Islam/DW
‘দুর্নীতি, বিচারহীনতা রয়ে গেছে, আমাদেরকে এসব সমস্যা দূর করতে হবে’: ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান, সংগীতশিল্পী
২০২৪ সালের ৫ ই আগস্ট স্বৈরাচারী সরকারের পতনের আগে যে সকল সমস্যা ছিল, যেমন, দুর্নীতি, বিচারহীনতা- তার সবই রয়ে গেছে৷ আমাদেরকে এসব সমস্যা দূর করতে হবে। নির্বাচনে ফিরতে হবে, রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা ফেরাতে হবে, বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। স্বৈরশাসকদের যেসকল অপরাধ ছিল তার বিচার করতে হবে।
ছবি: DW
‘যে মুক্তির স্বপ্ন দেখে নারীরাও পথে নেমেছিল, সেই মুক্তি আজ নারীবিদ্বেষী সামাজিকতার নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে’: ড.নাভিন মুরশিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক
জুলাই অভ্যুত্থানের কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছিল আকাশছোঁয়া। অথচ অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় এবং হতাশাজনক যে পরিবর্তনটি আমরা দেখছি, তা হলো, তীব্র নারীবিদ্বেষ। আমার কাছে সবচেয়ে দুঃখজনক এটাই যে, যে মুক্তির স্বপ্ন দেখে নারীরাও পথে নেমেছিল, সেই মুক্তি আজ নারীবিদ্বেষী সামাজিকতার নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে।
ছবি: DW
‘নির্বাচিত সরকার আসলে দেশের পরিবর্তন সম্ভব হবে বলে আশা করি’: আমিরুল ইসলাম, সিএন জি চালক
জুলাই অভ্যুত্থানের ফলে দেশে কোনো পরিবর্তন আসেনি৷ আগে দেশে যে সকল সমস্যা ছিল তা এখনো রয়েছে। দেশের বিচার ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে হবে। দেশে একটি সুস্থ নির্বাচন দিতে হবে। নির্বাচিত সরকার আসলে দেশের পরিবর্তন সম্ভব হবে বলে আশা করি৷
ছবি: DW
‘স্বপ্ন ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে’: মীর হুযাইফা আল মামদূহ, গবেষক
শেখ হাসিনার পতনের প্রক্রিয়াতে যেভাবে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাতে আমাদের সবার একটা আশা তৈরি হয়েছিল যে, আমরা হয়ত এমন একটা রাষ্ট্র পাবো, যেই রাষ্ট্র কল্যাণরাষ্ট্র হবে, যাতে কেউ কোনো পরিচয়, বিশ্বাস কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে বিচার্য হবে না, বরং সব ছাপিয়ে নাগরিক তার মর্যাদা পাবে। কিন্তু নানা কারণেই তা আর হয়নি, সেই স্বপ্ন ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে।
ছবি: DW
‘দেশের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি ও দলের স্বার্থের প্রাধান্য বেশি’: সৌমিক আহমেদ, অভিনেতা ও উদ্যোক্তা
জুলাই আন্দোলনের আশা-প্রত্যাশা একটাই ছিল - পরিবর্তন আর মুক্তি। কিন্তু সাধারণ মানুষের আর পরিবর্তন হয়নি, সে একই হানাহানি, রেষারেষি যেন আমাদের রক্তে মিশে গিয়েছে। বর্তমানেও দেশের স্বার্থ থেকে ব্যক্তি ও দলের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে দেখা যাচ্ছে, যা মোটেও কাম্য ছিল না।
জুলাইয়ের গণভ্যুত্থান মানুষের ভেতরের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, বঞ্চনা ও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থেকেই জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু আজ বর্ষপূর্তির আগমুহূর্তে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন উঠছে—এই আশা কতটা পূরণ হয়েছে?বাস্তবতা বলছে, সেই প্রত্যাশার অনেকটাই অপূর্ণ। ‘জুলাই স্পিরিট’ আজ বিভক্তির রাজনীতিতে ক্ষয়প্রাপ্ত। কার ভূমিকা কতটা ছিল—তা নিয়ে কৃতিত্বের লড়াই শুরু হয়েছে, যার ফলে বৈষম্যবিরোধী ঐক্যটিই ভেঙে পড়েছে।
ছবি: DW
‘চাঁদাবাজি, খুন, হত্যা বেড়েই চলেছে’: অদ্বিতীয়া, শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষা খাত, স্বাস্থ্য খাত তে অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, বিশেষ করে মানুষের নিরাপত্তার যে বিষয়টা, সেটা কোনোভাবেই এখন নিশ্চিত হচ্ছে না। প্রায় রোজ অপরাধ হয়েই যাচ্ছে, আর অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। চাঁদাবাজি, খুন, হত্যা বেড়েই চলেছে। কোন সমাধান হচ্ছে না বা সমাধানের কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।
ছবি: DW
7 ছবি1 | 7
তবে ড. জাহেদ উর রহমান মনে করেন," বাইরের শক্তিও আছে যারা বাংলাদেশে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে রাখতে চায়। তারা এখানে নির্বাচন চায় না। অস্থিতিশীল হলে তাদের লাভ। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকলে আর সরকার আন্তরিকভাবে নির্বাচনের জন্য কাজ করলে বাইরের ওই শক্তি সুবিধা করতে পারবে না বলতে গেলে পাঁচ মাস নির্বাচনের বাকি। এই সময়ে নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে কাজ করা উচিত সেই হাওয়া দেখতে পাচ্ছি না। দেশের মানুষ নির্বাচনের অপেক্ষায় থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলো যেনো অন্য আরো অনেক ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত৷''
সাবেক নির্বাচন কমিশনার জেসমিন টুলি বলেন," এবার সমানে সমানে দল নাই। সেটা না থাকলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করা একটু কঠিন হয়ে পড়ে। সমানে সমানে দল থাকলে প্রার্থী মনোনয়ন, প্রার্থীরা আবার জেতার জন্য তৎপর হতেন। তাতে নির্বাচন জমে উঠত। এবার একটি বড় দল বিএনপি। জামায়াতে ইসলামী আছে, আছে নতুন দল এনসিপি। আরো কিছু ছোট দল আছে। সমানে সমানে দল নাই। ফলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা এবং এই অনেক বড় দল এবং ছোট রাজনৈতিক দলগুলোকে একই সঙ্গে হ্যান্ডেল করা নির্বাচন কমিশনের জন্য বেশ কঠিন। আছে মবের ভয়। এসব আগেই সরকারকে ঠিক করতে হবে। আর সীমানা নির্ধারণসহ বাকি যে চ্যালেঞ্জ আছে সেগুলো নির্বাচন কমিশন মোকাবেলা করতে পারবে,” বলেন তিনি।
জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতের ভিন্নতার সমাধান না হলে নির্বাচনের গতি আসবে না: আব্দুল্লাহ আল মামুন
This browser does not support the audio element.
তবে তার আশঙ্কা," এবার নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং এআই নির্ভর গুজব ও অপপ্রচার নির্বাচন কমিশনের জন্য নতুন আরেকটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দেবে। যা এরইমধ্যে শুরু হয়েছে। আগে এটা ছিলো না। কমিশন এর জন্য এখনই প্রস্তুতি না নিলে পরে সামলাতে পারবে না।”
নির্বাচন বিষয়ক গবেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজ বিভাগের অধ্যাপ ড. কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন," এখন দেশের মানুষ অপেক্ষা করছে একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন দেখার জন্য। মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে এই আগ্রহ ইতিবাচক বিষয়। আমি আসলে নির্বাচন নিয়ে এখন বড় কোনো সংশয় দেখছি না। একটিই বড় চ্যালেজ্ঞ, আর তা হলো আইনশৃঙ্খলা। সরকারকে এখন সেটা নিয়েই মনোযোগী হতে হবে।''
" আর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে নানা ইস্যু নিয়ে বিরোধ আছে আছে তা নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে ততই কমে যাবে। কারণ নির্বাচন হলে তা সবার জন্যই লাভ। যে রাজনৈতিক বয়ানগুলো তৈরি হচ্ছে প্রতিটি রাজনৈতিক দল এর মাধ্যমে তাদের সমর্থকদের কাছে মেসেজ দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সব রাজনৈতিক দলই নির্বাচনে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।”
ড. জাহেদ উর রহমানও মনে করেন," আসলে রাজনীতিতে যে ইস্যুগুলো আছে সেগুলো বার্গেইনিং ইস্যু। বড় দলের কাছ থেকে অন্য দলগুলোর সুবিধা নেয়ার কৌশল। বড় দলকে যতটা চাপে রাখা যায় নির্বাচনে ততই অন্যদের সুবিধা হবে।”