সমুদ্র উপকূলের দেশ হওয়া বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি নেহাত কম নয়৷ প্রাণহানি ছাড়াও ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয়৷
বিজ্ঞাপন
তবে, গত কয়েক দশক ধরে দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে৷ তবে রুদ্র প্রকৃতিকে বাগে আনার সাধ্য মানুষের কোথায়৷
কাছাকাছি সময়ে আঘাত হানা সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’৷ ২০০৭ সালের নভেম্বরে আঘাত হানা ওই ঝড় এবং তার প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ প্রাণ হারায়৷
এবার সিডর-র চেয়েও শক্তিশালী আরেক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে যাচ্ছে বাংলাদেশে৷ বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি এ শতাব্দীর প্রথম ‘সুপার সাইক্লোন’ আমফানের তাণ্ডবে প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কেমন হবে তা এখনো অজানা৷
আগে এ অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের কোনো নাম দেওয়া হত না৷ কিন্তু ২০০০ সাল থেকে ঝড়ের নামকরণের জন্য নিয়ম বানানো হয়৷ তাতে ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন ও ইউনাইডেট নেশনস ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়ার সদস্য দেশগুলি ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেওয়া শুরু করে৷ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে আছে ভারত, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড৷ সব দেশের কাছ থেকে ঝড়ের নাম চাওয়া হয়৷ তার থেকে দেশ প্রতি ৮টি করে নাম বাছাই করে মোট ৬৪টি ঝড়ের নামকরণ করা হয়৷ সেই তালিকার শেষ নাম ‘আমফান’৷
আমফান মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি
মঙ্গলবার শেষরাত থেকে বুধবার বিকাল বা সন্ধ্যার মধ্যে আমফান বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে৷ ২০০৭ সালে আঘাত হানা সিডরের পর আমফান সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/K. Shanto
কখন আসতে পারে?
মঙ্গলবার শেষরাত থেকে বুধবার বিকাল বা সন্ধ্যার মধ্যে আমফান বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে৷ আবহওয়া অফিস বলছে, ঘণ্টায় ১৪০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার বাতাসের বেগে আমফান যখন উপকূলে আঘাত হানবে তখন দ্বীপ ও চরাঞ্চলে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫ থেকে ১০ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস দেখা দিতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/NASA EOSDIS
সিডরের পর শক্তিশালী
কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর আঘাত হানা সিডরের পর আমফান সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় হতে পারে৷ সিডরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন৷ এই ছবিটি ঐ বছরের ২৫ নভেম্বর তোলা৷
ছবি: Jewel Samad/AFP/Getty Images
সতর্ক সংকেত
মঙ্গলবারই মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে সাত নম্বর বিপদ সংকেত এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ছয় নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে৷ এছাড়া সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও তাদের কাছাকাছি দ্বীপ ও চরগুলো সাত নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় রাখা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/K. Shanto
মানুষজনকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে
উপকূলীয় জেলাগুলোতে ১২ হাজার ৭৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে৷ এসব কেন্দ্রে ৫১ লাখ ৯০ হাজার ১৪৪ জনকে আশ্রয় দেয়া যাবে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান৷
ছবি: bdnews24.com
আশ্রয়কেন্দ্রে মাস্ক বিতরণ
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে যেন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ না হয় তার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে আশ্রয় গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে৷ সম্ভাব্য ঝুঁকি এড়াতে আশ্রয়গ্রহণকারীদের মাঝে মাস্ক বিতরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷ আশ্রয়কেন্দ্রে চিকিৎসক রাখার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷’’
ছবি: bdnews24.com
আশ্রয়কেন্দ্রে জীবাণুনাশক স্প্রে
করোনা ভাইরাসের কারণে বরগুনা জেলার ৫০৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে জীবাণুনাশক স্প্রে করা হয়েছে৷ মঙ্গলবার দুপুর থেকে এসব আশ্রয়কেন্দ্রে লোকজন পাঠানো শুরু হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
বেতারে বার্তা প্রচার
বরগুনার স্থানীয় কমিউনিটি রেডিও ‘লোকবেতার’ থেকে নিয়মিত আবহাওয়া বার্তা প্রচার করা হচ্ছে৷ আর ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির পক্ষ থেকে মাইকে সতর্কতামূলক বার্তা প্রচার করা হচ্ছে৷
ছবি: bdnews24.com
মোংলায় পণ্য ওঠানামা বন্ধ
সোমবার বিকাল থেকে মোংলা বন্দরে জাহাজে পণ্য ওঠানামার কাজ বন্ধ রয়েছে৷ বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সার, ফ্লাই অ্যাশ, কয়লাবাহীসহ ১৪টি জাহাজ এখন বন্দরে অবস্থান করছে৷ ছবিটি প্রতীকী৷
ছবি: gemeinfrei
চট্টগ্রাম বন্দরে প্রস্তুতি
চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য (প্রশাসন) জাফর আলম বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আমফানের কারণে জেটি থেকে ১৯টি জাহাজ সরানো হয়েছে৷ আর বর্হিনোঙ্গরে থাকা ৬১টির মধ্যে ৫১টি জাহাজ গভীর সমুদ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে৷ ছবিটি ফাইল থেকে নেয়া৷
ছবি: Reuters
নৌ চলাচল বন্ধ
মঙ্গলবার দুপুর একটা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সারা দেশে সবধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে৷ করোনার কারণে গত ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি শুরুর আগে থেকেই যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে৷ তবে পণ্যবাহী নৌযান ছুটির আওতামুক্ত ছিল৷ আমফানের কারণে সেগুলোও এবার বন্ধ করে দেয়া হলো৷ ছবিটি ফাইল থেকে নেয়া৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
সুন্দরবনের জেলেদের সরিয়ে নেয়া হয়েছে
কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সু্ন্দরবনের নদী ও খালে মাছ শিকার করতে যাওয়া তিন হাজার জেলেকে ইতিমধ্য সরিয়ে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) বেলায়েত হোসেন৷ ছবিটি ফাইল থেকে নেয়া৷
ছবি: DW/M. Zahidul Haque
11 ছবি1 | 11
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে আঘাত হানা শক্তিশালী যত ঘূর্ণিঝড়:
১৯৮৮ এর ঘূর্ণিঝড়:
১৯৮৮ সালের নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায় যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর এবং বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায়৷ বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬২ কিলোমিটার৷ এই ঘূর্ণিঝড়ে পাঁচ হাজার ৭০৮ জন প্রাণ হারান৷
১৯৯১ এর ঘূর্ণিঝড়:
ভারত মহাসাগরে উৎপত্তি হওয়া প্রবল এই ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটার৷ এটি মূলত চট্টগ্রাম ও বরিশাল উপকূলে আছড়ে পড়েছিল৷ ঝড়ের প্রভাবে ১২ থেকে ২২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়৷ ২৯-৩০ এপ্রিলের এই ঘূর্ণিঝড়কে আখ্যা দেওয়া হয় ‘শতাব্দীর প্রচণ্ডতম ঘূর্ণিঝড়’ হিসেবে৷ এতে প্রায় এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল বলে জানা যায়৷ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এক কোটির বেশি মানুষ৷
১৯৯৭ এর ঘূর্ণিঝড়:
১৯৯৭ সালের ১৯ মে বাংলাদেশের সীতাকুণ্ড ও এর আশেপাশের এলাকায় আরেকটি ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে৷ ঘণ্টায় ২৩২ কিলোমিটার বেগের বাতাসের সঙ্গে ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়৷ এরপর আরো কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল৷ তবে সেগুলো বাতাসের গতিবেগ ছিল কম৷
ঘূর্ণিঝড় সিডর:
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর দেশের দক্ষিণ উপকূলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিডর প্রায় ছয় হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল৷ যদিও রেডক্রিসেন্টের হিসাব মতে প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার৷ উত্তর ভারত মহাসাগরে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছে সৃষ্ট এ ঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ২৬০ থেকে ৩০৫ কিলোমিটার৷ সিডর খুলনা ও বরিশাল এলাকায় তাণ্ডব চালায়৷ সমুদ্র থেকে উঠে আসা ১৫ থেকে ২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে সব কিছু ভেসে যায়৷ ঝড়ে তিন হাজরের বেশি মানুষ মারা যায়৷ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩২টি জেলার ২০ লাখ মানুষ৷ উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ছয় লাখ টন ধান নষ্ট হয়ে যায়৷ সুন্দরবনের প্রাণীদের পাশাপাশি অসংখ্য গবাদিপশু মারা যায়৷
ইতিহাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী আটটি ঝড়
ছবিঘরে ইতিহাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী আটটি ঝড়ের কথা উল্লেখ করা হলো, যেগুলো অ্যাটলান্টিকের হারিকেন, প্রশান্ত মহাসাগরের টাইফুন এবং ভারত মহাসাগরের সাইক্লোন নামে পরিচিত৷ সবচেয়ে বিধ্বংসী ঝড় আঘাত হেনেছে বাংলাদেশে৷
ছবি: Getty Images
২০০৮: নার্গিস (মিয়ানমার)
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে একটি হলো নার্গিস৷ ২০০৮ সালের মে মাসে যেটি মিয়ানমারে আঘাত হানে৷ এতে প্রাণ হারায় ১ লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ৷ ৪ লাখ ৫০ হাজার ঘর-বাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়৷
ছবি: Hla Hla Htay/AFP/Getty Images
১৯৯১ সাল: বাংলাদেশ
বাংলাদেশের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিধ্বংসী ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়, যেটি ২৯শে এপ্রিল ঘণ্টায় ২৩৫ কিলোমিটার বেগে উপকূলে আঘাত হেনেছিল৷ সমুদ্রের পানির উচ্চতা পৌঁছে গিয়েছিল সাত মিটার উঁচুতে৷ এতে প্রাণ হারিয়েছিল উপকূলের অন্তত ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ৷
ছবি: AFP/Getty Images
১৮৭৬: দ্য গ্রেট বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন, বাংলাদেশ
১৮৭৬ সালের অক্টোবরে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে বরিশালের বাকেরগঞ্জে৷ সে সময় ব্রিটিশ শাসনামল চলছিল৷ ভয়াবহ ঐ ঝড়ে প্রাণ হারিয়েছিল অন্তত ২ লাখ মানুষ৷
ছবি: Getty Images/AFP
১৯৭৫: নিনা টাইফুন, চীন
যদিও চীনে টাইফুন বা ঘূর্ণিঝড় খুবই স্বাভাবিক ঘটনা, তবুও ১৯৭৫ সালের ৩১ শে জুলাই চীনের হেনান প্রদেশে টাইফুন নিনার ভয়াবহতা সব ঝড়কে পেছনে ফেলে দেয়৷ ভয়াবহ ঐ ঝড়ে প্রাণ হারায় ২ লাখ ৩১ হাজার মানুষ৷ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Zc
১৮৮১ সাল: হাইফোং, ভিয়েতনাম
১৮৮১ সালের অক্টোবর মাসে ভিয়েতনামের হাইফোং শহরে ভয়াবহ টাইফুন আঘাত হানে৷ এতে প্রাণ হারায় ৩ লাখ মানুষ৷
ছবি: Getty Images/J. Aznar
১৯৩৭ এবং ১৮৩৯ সাল: ভারত
১৭৩৭ সালের অক্টোবর মাসে বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে ধেয়ে এসে কলকাতায় আছড়ে পড়েছিল ঘূর্ণিঝড়৷ বেশিরভাগ ইউরোপীয় গণমাধ্যমে বলা হয়েছিল, ঐ ঝড়ে প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় তিন লাখ মানুষ৷ কিন্তু সেসময় কলকাতায় মাত্র ১০ হাজার মানুষ বসবাস করত৷ তাই এই সংখ্যাটি নিয়ে অনেকের সংশয় রয়েছে৷ ১৮৩৯ সালের নভেম্বরে অন্ধ্রপ্রদেশের কোরিঙ্গা এলাকায় বিধ্বংসী ঝড়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন অন্তত তিন লাখ মানুষ৷ নষ্ট হয়েছিল ২৫ হাজার জাহাজ৷
ছবি: Reuters
১৯৭০ সাল: ভোলা সাইক্লোন, বাংলাদেশ
বিশ্ব ইতিহাসের ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম বলা হয় ভোলা সাইক্লোনকে৷ ১৯৭০ সালের ১৩ই নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উপর দিয়ে ঘণ্টায় ২০৫ কিলোমিটার বেগে বয়ে যায় সাইক্লোন৷ ঐ ঝড়ে প্রাণ হারায় অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ, যাদের মধ্যে এক লাখই ছিলেন জেলে৷
ছবি: Getty Images
7 ছবি1 | 7
ঘূর্ণিঝড় আইলা:
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও খুলনা উপকূলে ২০০৯ সালে ২৫ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা'৷ এই ঘূর্ণিঝড় ভারতের ১৪৯ জন ও বাংলাদেশের ১৯৩ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়৷ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে উপকূলে প্রায় তিন লাখ মানুষ গৃহহীন হয়৷
ঘূর্ণিঝড় মহাসেন:
ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’ ২০১৩ সালের ১৬ মে নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানে৷ এটির বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার৷ এই ঝড় বাংলাদেশে ১৭ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়৷
ঘূর্ণিঝড় কোমেন:
ঘূর্ণিঝড় কোমেন ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে আঘাত হানে৷ বাতাসের গতি ছিল ৬৫ কিলোমিটার৷ কোমেনের প্রভাবে মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও ভারতে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়েছিল৷
ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু:
রোয়ানু একটি ছোট ঘূর্নিঝড়, যা ২০১৬ সালে ২১ মে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে এবং ভারতে আংশিক অঞ্চলে আঘাত হানে৷ ধারণা করা হয়, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর ব্যাপ্তি ছিল দুটি বাংলাদেশের সমান আকৃতির৷ রোয়ানু-র আঘাতে চট্টগ্রামে ২৬ জনের মৃত্যু হয়৷
ঘূর্ণিঝড় মোরা:
উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মোরা ২০১৭ সালের ৩০ মে ১৪৬ কিলোমিটার বাতাসের গতিতে কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানে৷ ঝড়ের তাণ্ডবে হাজার হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়৷ কক্সবাজারে বিদ্যুৎব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে৷ জমির ফসল এবং লবন চাষীদের জমাকৃত লবন নষ্ট হয়ে যায়৷ দুজন নারীসহ তিনজন মারা যায়৷
ঘূর্ণিঝড় ফণী:
২০১৯ সালের ৩ মে বঙ্গপোসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে বাংলাদেশে নয় জনের মৃত্যু হয়৷ তবে প্রাণহানি কম হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ছিল অনেক বেশি৷ সরকারি হিসাব মতে, ঘূর্ণিঝড় ফণীর কারণে ঘরবাড়ি, বাঁধ, সড়ক ও কৃষিতে ৫৩৬ কোটি ৬১ লাখ ২০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়৷
ঘূর্ণিঝড় বুলবুল:
বার বার দিক বদল করে ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর অতিপ্রবল এই ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাগর দ্বীপ উপকূলে আঘাত হানার পর স্থলভাগ দিয়ে বাংলাদেশে আসায় ক্ষয়ক্ষতি আশঙ্কার চেয়ে কম হয়৷ ঝড়ে মারা যায় ২৪ জন৷ ৭২ হাজার ২১২ টন ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়, যার আর্থিক মূল্য ২৬৩ কোটি পাঁচ লাখ টাকা৷ ক্ষতি হয়েছে সুন্দরবনেরও৷
স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে আঘাত হানা প্রলয়ঙ্কারী যত ঘূর্ণিঝড়:
১৯৬০ সালে অক্টোবরে ঘণ্টায় ২১০ কিলোমিটার গতির প্রবল ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর, পটুয়াখালী ও পূর্ব মেঘনা মোহনায়৷ ঝড়ের প্রভাবে ৫ থেকে ৬ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়৷ এতে মারা পড়েন প্রায় ১০ হাজার মানুষ৷
পরের বছর ১৯৬১ সালের ৯ মে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে৷ বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬১ কিলোমিটার৷ প্রায় সাড়ে ১১ হাজার মানুষ মারা যান ওই ঝড়ে৷
১৯৬২ সালে ২৬ অক্টোবর ফেনীতে তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় হাজারখানেক মানুষের মৃত্যু হয়৷ ১৯৬৩ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয় চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার এবং সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, হাতিয়া ও মহেশখালী উপকূলীয় অঞ্চল৷ এই ঝড়ে প্রাণ হারান ১১ হাজার ৫২০ জন৷
১৯৬৫ সালে মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বারিশাল ও বাকেরগঞ্জে প্রাণ হারান ১৯ হাজার ২৭৯ জন৷ সে বছর ডিসেম্বরে আরেক ঘূর্ণিঝড়ে কক্সবাজারে মৃত্যু হয় ৮৭৩ জনের৷ পরের বছর অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে সন্দ্বীপ, বাকেরগঞ্জ, খুলনা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লায়৷ এতে মারা যান ৮৫০ জন৷
১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার উপর দিয়ে বয়ে যায় প্রলয়ঙ্করী ‘গ্রেট ভোলা সাইক্লোন'৷ এই ঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২২২ কিলোমিটার৷এই ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রাম, বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী, ভোলার চর বোরহানুদ্দিনের উত্তর পাশ ও চর তজুমুদ্দিন এবং নোয়াখালীর মাইজদি ও হরিণঘাটার দক্ষিণপাশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ এই ঝড়ে প্রাণ হারায় প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষ৷ চার লাখের মতো বসতভিটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷
এসএনএল/কেএম
এক দশকের বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়
দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের অন্যতম ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকা৷ এক নজরে দেখে নিন গত এক দশকে এই অঞ্চলের সবচেয়ে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়গুলি...
ছবি: picture-alliance/AP Photo/R. Kakade
ক্যার ও মাহা, ২০১৯
চলতি বছরের অক্টোবর মাসে ভারতের পশ্চিম উপকূলে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় মাহা ও ক্যার৷ এর আঁচ এসে পড়ে ভারত-বাংলাদেশ টি টুয়েন্টি ক্রিকেট সিরিজেও৷ বিজ্ঞানীরা জানান, ১৯৬৫ সালের পর এই প্রথম একসাথে দুটি ঘূর্ণিঝড় একসাথে অনুভব করছে ভারত৷
(প্রতীকী ছবি)
ছবি: IANS
ফেনী, ২০১৯
ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্য ওড়িষার উপকূলে কেন্দ্রবিন্দু থাকা এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব সীমিত থাকেনি ভারতে৷ বাংলাদেশেও আসে তার প্রভাব৷ ১৯৯৯ সালের পর থেকে ওড়িষার উপকূলের সবচেয়ে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় ছিল এটি৷ মোট ক্ষয়ক্ষতি ছিল ৭০ কোটি টাকার সমান৷
ছবি: AFP/M.U. Zaman
তিতলি, ২০১৮
গত বছর অক্টোবর মাসে ভারতের পূর্ব উপকূলে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় তিতলি৷ নাসার তথ্য অনুযায়ী, এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রাণকেন্দ্র ছিল কলকাতা থেকে মাত্র ৩১২ মাইল দূরে৷ বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করেছিলেন, এই ঝড় বাংলাদেশে এসে ঢুকবে৷ কিন্তু তা না হয়ে শেষ মুহূর্তে ঝড়টি পথ বদল করে চলে যায় দক্ষিণের দিকে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
অক্ষী, ২০১৭
দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলঙ্কায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করা এই ঘূর্ণিঝড়টির নামকরণ করেছিল বাংলাদেশ৷ ২০১৭ সালের এই ঝড় বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণে জন্ম নিয়ে দক্ষিণের দিকে এগোয়৷ সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় ভারতের দ্বীপ লাক্ষাদ্বীপ, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায়৷ ঝড়ে প্রাণ হারান অন্তত ২৪৫ জন এবং নিখোঁজ হন সাড়ে পাঁচশরও বেশি মানুষ, যাদের বেশির ভাগই মৎস্যজীবী৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/R. Kakade
মোরা, ২০১৭
একই বছরের আরেকটি বিদ্ধংসী ঝড় ছিল মোরা৷ শ্রীলঙ্কা, আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, উত্তরপূর্ব ভারত, মিয়ানমার, ভুটান, তিব্বত ও বাংলাদেশ এই ঝড়ে আক্রান্ত হয়৷ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় চট্টগ্রাম এবং ঝড় চলাকালীন সময়ে চট্টগ্রাম, পায়রা, মংলা ও কক্সবাজার বন্দরে বিপদসঙ্কেত জারি করা হয়৷ বন্ধ রাখা হয় বিমানবন্দরও৷
ছবি: bdnews24.com/Muhammad Mostafigur Rahman
রোয়ানু, ২০১৬
বিজ্ঞানীরা মনে করেছিলেন, রোয়ানু দুর্বল ঘূর্ণিঝড় হওয়ার কারণে তেমন ক্ষতি হবে না৷ কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে নতুন করে জেগে ওঠে এই ঝড়৷ মিয়ানমার উপকূলের কাছে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে প্রাথমিকভাবে আছড়ে পড়ে রোয়ানু৷ মারা যান ২৭জন৷ এরপর বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের সংস্পর্শে এসে শক্তিলাভ করে আরো বড় হয় ঝড়ের কেন্দ্রবিন্দু৷ শ্রীলঙ্কায় এই ঝড়ের কবলে প্রাণ হারান ২০১জন৷
ছবি: Imago/Zuma Press
কোমেন, ২০১৫
বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলে ছিল এই ঘূর্ণিঝড়ের উৎস৷ ২০১৫ সালের জুলাই মাসে এই ঝড় আছড়ে পড়ে বাংলাদেশে৷ মিয়ানমারেরও কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷
ছবি: Getty Images/D. Chakraborty
হুদহুদ, ২০১৪
পূর্ব ভারত ও নেপাল ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভারত মহাসাগরের এই ঝড়ে৷ এছাড়াও, অন্ধ্র প্রদেশ ও ওড়িষায় এসে পড়ে এর ছোঁয়া৷ প্রায় ২৪ কোটি টাকা মূল্যের ক্ষতি হয় এই ঝড়ের কারণে৷ প্রাণ হারান ১২৪ জন৷
ছবি: Getty Images/AFP/STR
ফিলিন, ২০১৩
থাইল্যান্ড, ভারত, মিয়ানমার ও নেপালের গায়ে আছড়ে পড়া এই ঝড় ছিল ১৯৯৯ সালের পরের সবচেয়ে ভয়াবহ ঝড় ছিল এটি৷ এর আগের ২৩ বছরে এত বড় মাপের কোনো ঝড় ভারত সামলায়নি৷ সরকারী তথ্য অনুযায়ী প্রায় ২৫০ কোটি ভারতীয় রুপির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
আইলা, ২০০৯
গত এক দশকে বঙ্গোপসাগরের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ছিল আইলা, যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশ ও ভারতে পূর্ব উপকূলের বিশাল অংশ৷ প্রায় দুই কোটি মানুষ এই ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন৷ ঘরছাড়া হন অনেকে৷ শুধু কলকাতা শহরেই এই ঝড় কেড়ে নেয় ১৮টি প্রাণ, বাংলাদেশে হারিয়ে যায় প্রায় ৬০ হাজার গবাদি পশু৷