এইচআইভি ভাইরাস বা এইডস রোগে আক্রান্তদের এখনও একঘরে করে রাখা হচ্ছে বাংলাদেশে৷ চিকিৎসা নিতে গিয়ে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তাঁরা৷ প্রচলিত ধারণা ও কুসংস্কারের কারণে এ রোগের জন্য আজও দায়ী করা হচ্ছে, হেয় করা হচ্ছে তাঁদের৷
বিজ্ঞাপন
[No title]
বিশ্ব এইডস দিবসে স্বাস্থ্যমন্ত্রী অবশ্য দাবি করেছেন যে, পরিস্থিতি বদলাচ্ছে৷ বলেছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে এইডসমুক্ত করা হবে৷
‘আশার আলো' নামে একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ঢাকায় এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের কাজ করছে৷ তারা এ পর্যন্ত ২৫ জনকে পুনর্বাসন এবং এইডস রোগে আক্রান্ত দুই হাজারেরও বেশি মানুষকে চিকিৎসা দিয়েছে৷ সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক হাবিবা আক্তার ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এইডসে আক্রান্তরা আমাদের সমাজে এখনো নিন্দিত৷ তাই তাঁদের গোপনেই চিকিৎসা করা হয়৷ এছাড়া এ রোগে যাঁরা আক্রান্ত হন, তাঁরাও সে কথা গোপন রাখেন৷ যদি কোনোভাবে পরিচয় প্রকাশ হয়ে যায়, তাহলে তাঁদের সমস্যা হয়৷ অনেককে তো বাড়ি এবং এলাকাও ছাড়তে হয়েছে৷''
বাংলাদেশের এইডস পরিস্থিতি
একটা সময় ছিল যখন এইডস রোগের নাম শুনলেই মানুষ ভয় পেত৷ এখন সেই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে৷ বাংলাদেশে এইডস প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাগুলো কাজ করছে৷
ছবি: AP
প্রথম রোগী
১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে প্রথম এইডস রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়৷ এইচআইভি-র কারণে সৃষ্ট এই রোগটি শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়৷ ফলে একজন এইডস রোগী খুব সহজেই যে-কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন – যা শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যু ঘটাতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হাজার পেরিয়ে গেছে
বর্তমানে বাংলাদেশে এইডস রোগীর সংখ্যা ১,২৯৯৷ পরিসংখ্যানটা অবশ্য ২০১৩ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সংগৃহীত৷ স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম নিজেই চলতি বছরের জুনে সংসদকে এই তথ্য জানিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা
এইডস রোগীর সংখ্যা ১,২৯৯৷ কিন্তু এইচআইভি বা ‘হিউম্যান ইমিউনোডেফিশিয়েন্সি ভাইরাস’-এ আক্রান্তের সংখ্যা ৩,২৪১৷ ২০১৩ সালের ১লা ডিসেম্বর বিশ্ব এইডস দিবসের এক অনুষ্ঠানে এই তথ্য জানানো হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নিহতের সংখ্যা
ঐ একই অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যসচিব জানান এইডসে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত ৪৭২ জন মারা গেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চিকিৎসা সেবা
আশার আলো সোসাইটি, মুক্ত আকাশ বাংলাদেশ কনফিডেনশিয়াল অ্যাপ্রোচ টু এইডস প্রিভেনশন (ক্যাপ) নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান এইডস আক্রান্তদের ‘অ্যান্টি-রেট্রোভাইরাল’ বা এআরভি ওষুধ সহ অন্যান্য সেবা দিচ্ছে৷ সরকার ও ‘দ্য গ্লোবাল ফান্ড’-এর কাছ থেকে ওষুধ কেনার অর্থ পায় এই তিন সংস্থা৷
ছবি: AP
সরকারি সেবা
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জুন মাসে জানান আটটি সরকারি হাসপাতালে ‘সিডি-৪’ সেন্টারের মাধ্যমে এইডস রোগীদের শারীরিক অবস্থা নির্ণয় করাসহ এ সব প্রতিষ্ঠানসমূহে রোগীদের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও ‘কাউন্সেলিং’ সেবা দেয়া হচ্ছে৷ অবশ্য সেটা ঠিক নয় বলে ডয়চে ভেলের কাছে দাবি করেন ‘মুক্ত আকাশ বাংলাদেশ’-এর নির্বাহী পরিচালক এম এস মুক্তি৷
ছবি: AP
6 ছবি1 | 6
হাবিবা আক্তারের কথাতেই বোঝা যায় যে বাংলাদেশে এইডস রোগীরা এখনও এক গোপন জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছেন৷
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি ভাইরাস সংক্রমণের হার এখনও শতকরা ০ দশমিক ১ ভাগের নীচে এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১ শতাংশেরও কম৷ ২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে নতুন করে এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৬৯ জন৷
আর এ সময়ে এই ভাইরাস সংক্রমণের পর এইডস রোগ হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৯৫ জনের৷ এছাড়া ১৯৮৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত, অর্থাৎ ১৪ বছরে মোট এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৪ হাজার ১৪৩ জন এবং এইডস রোগে মৃত্যু হয়েছে ৫৬৯ জনের৷
যাঁরা এইচআইভি-তে নতুন সংক্রমিত হয়েছেন, তাঁদের শতকরা ৭৩ ভাগ পুরুষ, ২৫ ভাগ নারী এবং ২ ভাগ ‘ট্রান্সজেন্ডার' মানুষ৷
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জানান, ‘‘২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে এইচআইভিমুক্ত দেশে পরিণত করতে সরকার পরিকল্পনা নিয়েছে৷ এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এইচআইভি টেস্টিং অ্যান্ড কাউন্সিলিং, আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য পজেটিভ লিভিং কাউন্সিলিং, পুষ্টি, চিকিৎসা এবং কাউন্সিলিং-এর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে৷ স্থাপন করা হয়েছে ন্যাশানাল এইডস কন্ট্রোল সেন্টার-ও৷''
বাংলাদেশের যৌনকর্মীদের কথা
পৃথিবীর আদিম এক পেশা পতিতাবৃত্তি৷ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই চালু রয়েছে এই পেশা৷ বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেমন আছেন বাংলাদেশের যৌনকর্মীরা? এই ছবিঘরে তাঁদের অবস্থা কিছুটা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images
যেভাবে যৌনপল্লীতে আগমন
বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার হয়ে যৌনপল্লীতে হাজির হন মেয়েরা৷ প্রত্যন্ত অঞ্চলের অতিদরিদ্র্য পরিবারের সদস্যরা কখনো কখনো অর্থের লোভে মেয়েদের বিক্রি করে দেন বলে জানিয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা৷ এছাড়া ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে কিংবা বিদেশ যাওয়ার লোভ দেখিয়েও মেয়েদের যৌনপল্লীতে আনা হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/Munir uz ZAMAN
যৌনকর্মীদের জন্য ‘গরুর ট্যাবলেট’
ফরিদপুরের সরকার অনুমোদিত যৌনপল্লীর ছবি এটি৷ অভিযোগ রয়েছে, পল্লীর মালিক নতুন আসা যৌনকর্মীদের স্টেরয়েড ট্যাবলেট সেবনে বাধ্য করেন, যা সাধারণত গরুকে খাওয়ানো হয়৷ গরুর স্বাস্থ্য বাড়াতে ব্যবহার করা এই ট্যাবলেট মানুষের দেহের জন্য ক্ষতিকর৷
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ‘ইনজেকশন’
বাংলাদেশের এক যৌনপল্লীর মালিক রোকেয়া জানান, স্টেরয়েড ওষুধ প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ভালো কাজে দেয়৷ কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক, বিশেষ করে ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সি মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি কার্যকর নয়৷ অপ্রাপ্তবয়সিদের স্বাস্থ্য ভালো করতে বিশেষ ধরনের ইনজেকশন ব্যবহার করা হয় বলে জানান ৫০ বছর বয়সি রোকেয়া৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/M. Candela
অধিকাংশ যৌনকর্মী ‘স্টেরয়েড আসক্ত’
আন্তর্জাতিক উন্নয়নসংস্থা একশনএইড ইউকে এক সমীক্ষার ভিত্তিতে ২০১০ সালে জানায় যে, বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ যৌনকর্মী ওরাডেক্সন বা অন্যান্য স্টেরয়েড ট্যাবলেট নিয়মিত গ্রহণ করে৷ তাঁদের গড় বয়স ১৫-৩৫ বছর৷ বাংলাদেশে দু’লাখের মতো যৌনকর্মী রয়েছে বলে ধারণা করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/M. Candela
সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ
স্টেরয়েড ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রচারণা চালাচ্ছে একশনএইড৷ সংস্থাটির বাংলাদেশ অংশের কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার জানিয়েছেন, ‘‘ওরাডেক্সন গ্রহণ করার পর শুরুতে মেয়েদের শরীরে চর্বির পরিমাণ বাড়তে থাকে৷ কিন্তু এটি নিয়মিত সেবন করলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, চামড়ায় ক্ষতসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়৷’’
ছবি: GMB Akash
এইচআইভি সংক্রমণ
বাংলাদেশে যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণ বা এইডস রোগ হওয়ার খবর মাঝে মাঝে পত্রিকায় প্রকাশ হয়৷ তবে ঠিক কতজন যৌনকর্মী এইচআইভি আক্রান্ত তার হালনাগাদ কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি৷ অনেকক্ষেত্রে কনডম ব্যবহারে খদ্দেরের অনীহা যৌনকর্মীদের মাঝে যৌনরোগ ছড়াতে সহায়ক হচ্ছে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: AP
‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ যৌনকর্মী
বাংলাদেশের যৌনপল্লীগুলোতে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের জোর করে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করানোর অভিযোগ রয়েছে৷ আর এই পেশায় যাঁরা একবার প্রবেশ করছেন, তাঁদের জীবনেও নানা ঝুঁকি থাকে৷ পতিতাপল্লীতে হামলার খবর কিন্তু মাঝেমাঝেই শোনা যায়৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
শত বছরের পুরনো পল্লী উচ্ছেদ
মাদারিপুরের পতিতাপল্লীটি ছিল শত বছরের পুরনো৷ গত বছর এই পল্লী উচ্ছেদ করেছেন স্থানীয়রা৷ এমনকি পল্লীটি জোরপূর্বক উচ্ছেদ না করার হাইকোর্টের আদেশও এক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হয়েছে৷ সেখানে পাঁচশ’র মতো যৌনকর্মী বাস করতেন৷ কিছুদিন আগে টাঙ্গাইলের একটি পতিতাপল্লীও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ এ রকম উচ্ছেদের আতঙ্কে রয়েছেন আরো অনেক যৌনকর্মী৷
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
মধ্যপ্রাচ্যে ‘যৌনদাসী’ বাংলাদেশের মেয়েরা!
বাংলাদেশের বেশ কয়েক নারীকে মধ্যপ্রাচ্যে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে৷ তাঁদের পাচার করে সিরিয়ায় নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে একাধিক বার্তাসংস্থা৷ এ সব নারীকে ফিরিয়ে আনতে সরকারি উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে৷ তবে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন পতিতালয়েও বাংলাদেশি নারীদের জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে নিয়োগ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
9 ছবি1 | 9
তবে তিনি জানান, ‘‘বাংলাদেশকে এইডসমুক্ত করতে হলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে৷ তাছাড়া আক্রান্তদের প্রতি আমাদের সহানুভূতিশীল হতে হবে৷ এ জন্য সরকার ব্যাপক প্রচার প্রচারণার উদ্যোগ নিয়েছে৷''
বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাতটি মেডিক্যাল কলেজসহ মোট ১২টি সরকারি হাসপাতালে এইচআইভি রোগ শনাক্তকরণ, চিকিৎসা ও এইচআইভি আক্রান্তদের বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণসহ বিভিন্ন সুবিধাও দেওয়া হচ্ছে৷ এ সব ছাড়াও বেশ কয়েকটি বেসরকারি সাহায্য সংস্থা বা এনজিও-র মাধ্যমে এইচআইভি আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে৷
অন্যদিকে ‘আশার আলো'-র নির্বাহী পরিচালক হাবিবা আক্তার জানান, ‘‘এইচআইভি আক্রান্তদের যদি সার্জারির মতো চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, তার ব্যবস্থা বাংলাদেশে নেই৷ এমনকি এইচআইভি ভাইরাসের সংক্রমণ এবং এইডস রোগ সম্পর্কে প্রচার-প্রচারণাও সীমিত৷''
তাঁর কথায়, ‘‘আশার আলোসহ তিনটি এনজিও এইচআইভি আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করছে৷ নিজেদের প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিয়ে এই ভাইরাসে বা এইডস রোগে আক্রান্তদের পুনর্বাসনও করছে তারা৷ কিন্তু সরকারি পর্যায়ে তাদের পুনর্বাসন বা চাকরির কোনো ব্যবনস্থা নেই৷''
আপনার প্রতিবেশী এইডস-এ আক্রান্ত হলে আপনি কী করবেন? জানান নীচের মন্তব্যের ঘরে৷