পুরো পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা যা কয়েক মাস ধরে বলছেন, নতুন করে সে কথা বলার জন্য ধমক খেলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক৷ বক্তব্য প্রত্যাহার করে দোষ চাপালেন স্ক্রিপ্ট লেখকের ওপর৷
বিজ্ঞাপন
তিন মাস আগে ‘আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী’ কে যেনো বলেছিল?
পুরো পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা যা কয়েক মাস ধরে বলছেন, নতুন করে সে কথা বলার জন্য ধমক খেলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক৷ বক্তব্য প্রত্যাহার করে দোষ চাপালেন স্ক্রিপ্ট লেখকের ওপর৷ তিন মাস আগে ‘আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী' কে যেনো বলেছিল?
করোনা ভাইরাস ঠেকাতে শুরু থেকে বাংলাদেশে যে হাস্যরস, উলটাপালটা মন্তব্য, অব্যবস্থাপনা, অকার্যকর সিদ্ধান্ত ইত্যাদি চলছে, ভাইরাস চিন্তা করতে পারলে খুব কনফিউজড হয়ে যাওয়ার কথা৷
এমন পরিস্থিতিতে যখন সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিফিংয়ে বললেন, ‘‘এটি দুই থেকে তিন বছর বা তার চেয়েও বেশি দিন স্থায়ী হবে৷ যদিও সংক্রমণের মাত্রা উচ্চ হারে নাও থাকতে পারে৷'' এটা নতুন কোনো কথা নয়৷ গত কয়েক মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিজ্ঞানীরা এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও একই কথা বলে আসছে৷ যদি সামনের বছর ভ্যাকসিন চলেও আসে, সেটির অনুমোদন, উৎপাদন, ও সবশেষে বিশ্বের ৭০০ কোটিরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো চাট্টিখানি কথা নয়৷ করোনা ভাইরাস নিজে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত না নিলে অনায়াসে দুই বছর লেগে যাওয়ার কথা৷
কিন্তু তবুও বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমও সেটা খুব ফলাও করে প্রচার করলো৷ ফলশ্রুতিতে পরদিন নিজের বাসায় ব্রিফিংয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সরকারের সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এই মন্তব্যকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বলে বেশ ধমকের সুরেই কথা বললেন৷ তিনি বললেন, ‘‘সরকার যখন দিনরাত পরিশ্রম করে মানুষের মনোবল চাঙা রাখার নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখন স্বাস্থ্যবিভাগের কোনো কোনো কর্মকর্তার করোনার আয়ুষ্কাল নিয়ে অদূরদর্শী ও দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য জনমনে হতাশা তৈরি করেছে৷’’
করোনার বিরুদ্ধে কারা জেতে, কারা জেতে না
ফুটবলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সমানে সমানে লড়ে, কিন্তু এই লড়াইয়ে ব্রাজিল পাত্তাই পায় না৷ ৪৫ বছর আগের এক যুদ্ধের মতো পুঁচকে ভিয়েতনামের কাছে আবার লজ্জা পায় যুক্তরাষ্ট্র৷ করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের আরো কিছু বিষয় থাকছে ছবিঘরে..
ছবি: Getty Images/AFP/S. Lima
দেশ অপ্রস্তুত আর প্রেসিডেন্ট একগুঁয়ে হলে যা হয়
চীনে করোনা সংকট দেখা দেয়ার দু’মাস পরও যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাসামগ্রীর ঘাটতি, করোনা টেস্ট শুরু করায় বিলম্ব, ইটালিতে মৃত্যুর মিছিল দেখেও করোনাকে ট্রাম্পের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, মধ্য এপ্রিলেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে চাওয়া- ইত্যাদির উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি৷ বিশেষজ্ঞরা যা চান ট্রাম্প তার ঠিক বিপরীত দিকে হাঁটতে চেয়েছেন৷ ফলাফল পরাশক্তি হয়েও করোনার কাছে নাস্তানাবুদ হওয়া৷
শীতল যুদ্ধের যুগ আর নেই৷ তবে এ যুগেও কমিউনিস্ট শাসিত কিউবা আর যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক মধুর হয়নি ৷ যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় মৃত্যু এক লাখ ১৫ হাজার ছাড়িয়েছে, অথচ কিউবায় মারা গেছে মাত্র ৮৩ জন৷ হোক না মাত্র এক কোটি ১৪ লাখ মানুষের দেশ, করোনাকে এভাবে বোতলবন্দি করলো কিভাবে তা-ই এখন কৌতুহলের কেন্দ্রে৷ গার্ডিয়ান বলছে, শুরু থেকে সপ্তাহের সাতদিন ঘরে ঘরে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করে তা সম্ভব করেছে কিউবা৷
ছবি: pictrure-alliance/AP Photo/I. Francisco
বিশেষজ্ঞরা স্বেচ্ছাচারিতার কবলে পড়লে যা হয়
লকডাউন প্রশ্নে ট্রাম্পের বিরোধিতা করে কোণঠাসা হয়েছেন জাতীয় অ্যালার্জি ও সংক্রামক রোগ ইনস্টিটিউটের প্রধান ডা, অ্যান্থনি ফাউচি, একই বিষয়ে প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর বিরোধিতা করে দায়িত্ব হারিয়েছেন ব্রাজিলের দুই স্বাস্থ্যমন্ত্রী৷ সামাজিক দূরত্ব মানার সরাসরি বিরোধিতা করা বলসোনারোর দেশও এখন ধুঁকছে৷ গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে কিউবার চেয়ে সত্তর গুন পিছিয়ে আছে ব্রাজিল৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. Lima
ভিয়েতনাম হলে যা হয়
ভিয়েতনামও করোনার বিরুদ্ধে দারুণ সফল৷ দেশ ছোট আর অর্থনীতি দুর্বল হলেও বড় যুদ্ধে ভিয়েতনাম কখনো হারেনি৷ ৩৫ বছর আগে সামরিক যুদ্ধে ব্যর্থ হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, এখন ব্যর্থ হচ্ছে করোনা ভাইরাস৷ দ্রুত সীমান্ত বন্ধ করা, অল্প সময়ে বেশি পরীক্ষা করানো, সামাজিক দূরত্ব, লকডাউন- সব নিয়ম কঠোরভাবে মেনে সফল হয়েছে ভিয়েতনাম৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Hau Dinh
সরকার এবং সরকারপ্রধান অপরিনামদর্শী না হলে যা হয়
জনমনে অসন্তোষ দেখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট বন্ধ করেছিল ব্রাজিল সরকার৷ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তা আবার চালু হয়েছে৷ ফুটবলে তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে আর্জেন্টিনা ২৬ হাজারের মতো সংক্রমণ আর মাত্র ৭৮৭ জন করোনায় মৃত্যু নিয়ে এখনো অনেক ভালো অবস্থায়৷ আর্জেন্টিনার জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটি, বিপরীতে ব্রাজিলের জনসংখ্যা ২১ কোটির কাছাকাছি হলেও ব্যবধানটা কিন্তু সেই তুলনায় অনেক বড়!
ছবি: Getty Images
করোনাকে বেশি সময় দিলে যা হয়
করোনা যখন হানা দিলো, তখন পরীক্ষার প্রস্তুতি, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের জোগান- সব কিছুরই ঘাটতি ছিল ইউরোপের দেশটিতে৷ লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব মানতে চাননি অনেকে৷ ফলে বিপদ বেড়েছে দ্রুত৷ এখন পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক৷ এ পর্যন্ত ইটালিতে ৩৪ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷ ডাক্তার মারা গেছেন একশ’রও বেশি৷ বেশির ভাগ ডাক্তারই মারা গেছেন পিপিই ছাড়া চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/E. Mattia Del Punta
ছোট দেশও ‘গাইডলাইন’ মানলে যা হয়
প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আর্ডার্ন জানিয়েছেন, নিউজিল্যান্ডে আর করোনায় সংক্রমিত রোগী নেই৷ বিশ্লেষকরা বলছেন মূলত গাইডলাইন মেনে চলার কারণেই এমন সাফল্য এসেছে৷ ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের স্কুল অব ফার্মাসির শিক্ষক ওকসানা পাইসিক বলেন, ‘‘ প্রথমে খুঁজে বের করা, তারপর টেস্ট করা, আইসোলেট করা, প্রত্যেক রোগীকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা, সংক্রমণ ধরা পড়লে কোয়ারান্টিনে পাঠানো- এসব মেনেই নিউজিল্যান্ড সফল হয়েছে৷’’
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Baker
7 ছবি1 | 7
মানুষের মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্যই হয়তো ওবায়দুল কাদের ২১ মার্চ বলেছিলেন, ‘‘করোনা এমন কোনো শত্রু শক্তি নয়, যে তাকে পরাজিত করা যাবে না, আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী৷ জাতি হিসেবেও আমরা শক্তিশালী৷ ভয়কে জয় করতে হবে৷'' তার এমন কথায় ভয়কে জয় করার জন্য মানুষ সরকারের আর কোনো নির্দেশ না মেনে ছুটির মধ্যে বাড়ি গেলো, ঘুরতে থাকলো৷ আমরা এরপর আর তার মুখ থেকে জানতে পারলাম না ‘ভয়কে জয়' করতে গিয়ে মানুষকে কেন রাস্তায় পুলিশের লাঠির বাড়ি খেতে হলো৷
এদিকে বাজেট অধিবেশনের প্রথম দিনে শোক প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘‘বিশ্বের যে যতই শক্তিধর হোক, যতই অর্থশালী হোক, অস্ত্রে শক্তিশালী হোক; কোনো শক্তিই কাজে লাগছে না করোনা ভাইরাসের কাছে৷ মনে হচ্ছে করোনা ভাইরাসটাই সবচেয়ে শক্তিশালী৷’’ নিশ্চয়ই তিন মাস আগের মন্তব্যের জন্য ওবায়দুল কাদেরও ধমকটা পেয়ে গেছেন৷
তবে মানুষের মনোবল চাঙ্গা রাখার মন্তব্যটা নিয়ে আমি সম্পূর্ণ একমত৷ এক্ষেত্রে সরকারও যেমন ব্যর্থ হচ্ছে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিতে, আমরা জনগণও খুঁজে খুঁজে হতাশা বের করছি, সংবাদকর্মীরাও জনগণের ভয়-হতাশাকে কাজে লাগিয়ে কাটতি বাড়াতে ‘হায় হায়, সব গেল বুঝি' টাইপের সংবাদই বেশি পরিবেশন করছি৷
একটি গ্লাসে অর্ধেক জল ভরা৷ এখন সেটাকে অর্ধেক ভর্তি, নাকি অর্ধেক খালি হিসেবে দেখবেন তা পুরোটাই নির্ভর করে যে দেখছে তার মানসিকতার ওপর৷ এই ‘কগনিটিভ বায়াস' নিয়ে মনোস্তত্ত্ববিদদের বিশাল বিশাল গবেষণাও রয়েছে৷
আমরা এখন ইন্টারনেটের কল্যাণে পৃথিবীর সবশেষ তথ্য আমাদের হাতের নাগালে পাচ্ছি৷ ফলে নিজেরাই ওয়ার্ল্ডোমিটারে সার্চ দিয়ে দেখছি বাংলাদেশ কত নাম্বারে পৌঁছে গেছে৷ সেখানে শুরুতেই সংক্রমণের মোট সংখ্যার ভিত্তিতে ২১৫টি দেশ ও অঞ্চলের তালিকা দেয়া আছে৷ বাংলাদেশ ১৭ নাম্বারে অবস্থান করে বেশ খারাপই আছে বলে আমরা ধরে নিচ্ছি৷ আমরা চীনকেও ছাড়িয়ে গিয়েছি৷
গ্লাস যদি অর্ধেক খালি হয় তাহলে আমরা আরো দেখতে পাবো মোট মৃত্যুর তালিকায় বাংলাদেশ ৩০ নম্বরে, অ্যাকটিভ কেসে ৭ নাম্বারে থাকলেও প্রতি ১০ লাখ মানুষে টেস্টে রয়েছে ১৪৭ নাম্বারে৷
এবার গ্লাসটাকে অর্ধেক ভরা দেখুন৷ প্রথমত করোনার সংক্রমণ হিসেব করাটা একটা ফাঁকি৷ বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ মনে করেন চীন তথ্য গোপন করে, অথচ তারা বিশ্বাস করেন বাংলাদেশ সংক্রমণের সংখ্যায় চীনকে ছাড়িয়ে গেছে৷ যদি চীনের দেয়া সংক্রমণ বিষয়ক তথ্য শতভাগ সত্যিও হয়, বিজ্ঞানীরা বলছেন বিশ্বের আসল সংক্রমণ আরো কয়েক লাখ বেশি হবে, কারণ বেশিরভাগের কোনো লক্ষণই প্রকাশ পায়নি৷ তাহলে কিসের ভিত্তিতে আমরা এই তালিকা ফলো করছি? যা জানা গেছে সেটার ভিত্তিতে তাই তো?
নিউজিল্যান্ড থেকে শুরু করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমরা বাংলাদেশের তুলনা করছি৷ আমরা কি এটা খেয়াল করছি যে পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৫ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকায় জনসংখ্যা ৪৫ কোটি, যেখানে বাংলাদেশে কেবল দেড় লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকায় মানুষ প্রায় ২০ কোটি? আমরা কি জানি বাংলাদেশের দ্বিগুণ আকারের দেশ নিউজিল্যান্ডে মানুষ মাত্র ৪০ লাখ? ফলে সেসব দেশে স্বাভাবিক অবস্থাতে যে সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকে, বাংলাদেশে ঘোষণা দিয়েও তা সম্ভব না হওয়াই স্বাভাবিক নয় কি?
ব্রাজিলের পরিস্থিতি আমরা সবাই জানি৷ দেশটির সরকার করোনাকে পাত্তাই দেয়নি৷ ফলে এখন সেটি হটস্পটে পরিণত হয়েছে৷ কিন্তু ল্যাটিন অ্যামেরিকায় সবার আগে লকডাইন দিয়েছিল পেরু৷ অথচ এখন সংক্রমণের তালিকায় তার অবস্থান ব্রাজিলের পরেই৷ এমন কেনো? কারণ খুঁজে বের করতে গিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে পেরুর ৪৪ শতাংশ মানুষের বাসায় ফ্রিজ নেই৷ ফলে খাবার সংরক্ষণের উপায় না থাকায় তাদের বাইরে বের হতে হয়েছে এবং বাজার থেকে সংক্রমণ ছড়িয়েছে৷ দেশটির ৫৬ শতাংশ মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই৷ ফলে সরকারের অর্থ সাহায্যের জন্য তাদের সশরীরে ব্যাংকে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে, সেখান থেকে সংক্রমণ ছড়িয়েছে৷ আবার দেশের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ নিজের বাসায় এক রুমে ৪-৫ জন গাদাগাদি করে থাকতে হয়৷ ফলে বাসার ভেতরেও সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়েছে৷
বাংলাদেশে কী কোনো গবেষণা হয়েছে? ইউরোপকে কপি-পেস্ট না করে বাংলাদেশের বাস্তবতায় কী করা উচিত, সেটা আমরা কারো মুখে শুনেছি? না৷
এবার প্রশ্ন উঠবে বাংলাদেশ টেস্ট এত কম করছে, তাহলে আসল পরিসংখ্যান জানবে কিভাবে? কথা সত্য৷ বাংলাদেশ টেস্ট করার দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে আছে৷ কিন্তু ওয়ার্ল্ডোমিটারের বাকি পরিসংখ্যান দেখুন৷ মোট সুস্থের তালিকায় বাংলাদেশ ১৯ নাম্বারে৷ কিন্তু ক্রিটিক্যাল রোগীর সংখ্যা অনেক কম, তালিকার ১১০ নাম্বারে৷ প্রতি ১০ লাখ মানুষে কতো জন সংক্রমিত হয়েছেন সে তালিকায় বাংলাদেশ ৯১ নাম্বারে৷ প্রতি ১০ লাখে মৃত্যুতে বাংলাদেশ আরো পিছিয়ে ১০৯ নাম্বারে৷ এগুলোও তো দেখা উচিত, তাই না?
কিন্তু আমাদের গবেষকেরা গবেষণা করবেন না, সরকারের দায়িত্বশীলরা বাগাড়ম্বর করে যাবেন, সাংবাদিকরা ভয়ের সংবাদ পরিবেশন করবেন আর জনগণ খুঁজে খুঁজে হতাশ হবেন৷ ভবিষ্যতে যেসব মহামারি আসবে সেগুলোও এভাবেই মোকাবিলা করবো আমরা? ধমক দিয়ে তো আর ভাইরাস ঠেকানো যায় না৷
করোনায় দেউলিয়া যারা
করোনা মহামারির ধাক্কায় বিপর্যস্ত বিশ্ব বাণিজ্য৷ নিরবে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট কোম্পানিগুলো৷ এমনকি অনেক বড় প্রতিষ্ঠানও নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করছে৷
ছবি: DW/I. Banos-Ruiz
কারা টিকে থাকছে?
অনেক জায়গাতেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো দুয়ার এখনও বন্ধ৷ এমন পরিস্থিতিতে কত প্রতিষ্ঠানে চিরতরে হারিয়ে যাবে আর কতগুলো শেষ পর্যন্ত ফিরবে তা অনিশ্চিত৷ এই মুহূর্তে দেউলিয়া ঘোষণা করার আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারছে না অনেকেই৷ বলা হচ্ছে বিশ্ব এখনও এই সংকট পরিস্থিতির মাঝামাঝিতে অবস্থান করছে৷ পুরো পরিস্থিতি অনুধাবন আর আসল ধাক্কাটি সম্ভবত টের পাওয়া যাবে আগামী বছরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Gateau
ছোটরা বেশি বিপদে
করোনার কারণে সবচেয়ে বড় লোকসান পড়েছে খুচরা বিক্রয় প্রতিষ্ঠানগুলো৷ যুক্তরাষ্ট্রে ফ্যাশন পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান জে ক্রু নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে৷ হংকং এবং জার্মান ভিত্তিক ফ্যাশন পণ্য বিক্রেতা এসপ্রি বলেছে, এশিয়া থেকে সব স্টোর তারা গুটিয়ে নিবে৷ অনলাইন বেচাকেনা জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় কোভিড-১৯ এর ধাক্কা লাগার আগে থেকেই অবশ্য এই কোম্পানিগুলো অস্তিত্ব সংকটে ভুগছিল৷ মহামারি তা আরো ত্বরান্বিত করছে মাত্র৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot/L. Ying
নড়বড়ে বড়রাও
দেউলিয়া আইনে সুরক্ষা পেতে আবেদন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের নিম্যান মার্কাসের মতো বৃহৎ ডিপার্টমেন্ট স্টোর৷ মে মাসেই ‘চাপটার ইলেভেন ফাইল’ করেছে জেসি পেনি৷ ১১৮ বছর বয়সী প্রতিষ্ঠানটির স্টোর আছে ৮০০ টি৷ বিশেষজ্ঞদের ধারণা এই তালিকায় এমন নামীদামি কোম্পানির নাম সামনের দিনে যোগ হবে আরো৷ এমনকি জার্মানির সবচেয়ে বড় ডিপার্টমেন্ট স্টোর গ্যালারিয়া কার্স্টার্ড কাউফহফ এর মত প্রতিষ্ঠানও সেই পথে হাঁটছে বলে গুঞ্জন রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/O. Berg
দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে কে বাঁচাবে?
যুক্তরাজ্যে এক জরিপে দেখা গেছে চলতি বছর প্রতি দশটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের একটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যেতে পারে৷ তাদের সেবার চাহিদা দ্বিগুণ বেড়েছে অথচ তহবিল আগের চেয়ে কমে গেছে৷ আর এক্ষেত্রে সামাজিক সহযোগিতা কিংবা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে যারা কাজ করে তারাই পড়ছে সবচেয়ে বিপাকে৷ এমনকি ন্যাশনাল ট্রাস্ট এর মত খ্যাতনামা গ্রুপও এই ধাক্কা অনুভব করছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Güttler
রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় ধ্বস
বিভিন্ন জায়গায় রেস্টুরেন্টগুলো তাদের চেয়ার গুটাতে শুরু করেছে৷ বলা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত এই ব্যবসায় শুধু দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক চেইনগুলোই হয়তো টিকে থাকবে৷ তবে কিছু বড় চেইনও নড়বড়ে অবস্থানে রয়েছে৷ যেমন ভাপিয়ানোর মত জনপ্রিয় চেইনটি জার্মানিতে দেউলিয়া আবেদনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে৷ মারিদো নামের আরেকটি কোম্পানি তাদের তৃতীয় রেস্টুরেন্ট বন্ধ করেছে৷
ছবি: picture-alliance/SvenSimon/F. Hoermann
পর্যটনে বেঁচে থাকার লড়াই
অ্যামেরিকার গাড়ি ভাড়া দেয়া প্রতিষ্ঠান হার্তজ৷ গতমাসে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী বিদায় নিয়েছেন৷ দেউলিয়াত্বের আবেদন করেছে তারা৷ উত্তর অ্যামেরিকাজুড়ে ছাঁটাই করেছে ১০ হাজার কর্মী৷ পর্যটন খাতে জড়িত বাকিরাও স্বস্তিতে নেই৷ জার্মানির বিমান প্রতিষ্ঠান লুফটহানসা সরকারের কাছ থেকে ৯০০ কোটি ইউরোর সহায়তা তহবিল নিয়েছে৷ ভার্জিন অস্ট্রেলিয়া কোন রকমে টিকে আছে ‘ভল্যানটারি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের’ অধীনে৷
ছবি: Imago/R. Peters
পেট্রোলিয়ামের কদর নেই
চাহিদা কমে যাওয়া বিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম তলানিতে ঠেকেছে৷ এর সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলোর এখন ত্রাহি পরিস্থিতি৷ এপ্রিলে ডায়মন্ড অফশোর ড্রিলিং, হোয়াইটিং পেট্রোলিয়াম, আল্ট্রা পেট্রোলিয়াম ফিল্ড যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের কাছে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন জানিয়েছে৷ তবে তারা যে একেবারে বিদায় নিচ্ছে তা নয়৷ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটলেই এই প্রতিষ্ঠাগুলো ব্যবসায় ফিরবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা৷
ছবি: Imago-Images/ITAR-TASS
মাঠে যখন দর্শক নেই
দর্শকের বদলে খেলোয়াড়রা, শিল্পীরা নিজেদের নৈপুণ্য দেখাচ্ছেন ক্যামেরার সামনে৷ তাতে কি ক্ষতি পোষাবে? এর সঙ্গে জড়িত ক্লাব, কর্তৃপক্ষ আর বিভিন্ন কোম্পানি বঞ্চিত হচ্ছে টিকিট আর বিজ্ঞাপনের টাকা থেকে৷ জার্মানির পেশাদার ফুটবল দল কাইজার্সলাউটার্ন দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই তালিকা সামনের দিনে ক্রমশ লম্বা হবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/U. Anspach
আসল পরিস্থিতি সামনে
বিরাট অঙ্কের আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে উন্নত দেশগুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে৷ কিন্তু আসল পরিস্থিতি ধরা দিবে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে৷ কেননা ততদিনে অনেকেরই প্রণোদনার টাকা ফুরাতে শুরু করবে৷ কোম্পনিগুলো দেউলিয়া ঘোষণার জন্য আদালতপাড়ায় লাইন ধরবে, বাড়বে কর্মহীন মানুষের বহরও৷ এমন আভাসই দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা৷
ছবি: Reuters/D. Ryder
দেউলিয়া হলে কি সব শেষ?
দেউলিয়া হয়ে যাওয়া কারো কাছে গর্বের, কারো কাছে লজ্জার৷ অনেক ক্ষেত্রে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া কোম্পানি বা ব্যক্তি নতুন প্রস্তুতি নিয়ে আরো শক্তিশালী রূপে ফিরে আসতে পারে৷ হেনরি ফোর্ড তার কোম্পানি শুরুর আগে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলেন৷ ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দায় জিএম, ক্রাইসলারের মত কোম্পানিও দেউলিয়াত্বের আবেদন করেছিল৷ করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতেও এমন কিছু খারাপ খবর আসবে যা হয়তো পরবর্তীতে ভাল কিছুর জন্ম দিবে৷