গত কয়েক সপ্তাহে পাওয়া গেছে তিন জন রোহিঙ্গার মৃতদেহ৷ নিহতদের পরিবার বলছে, প্রত্যেককেই গভীর রাতে মুখোশধারী কিছু লোক এসে ধরে নিয়ে যায় এবং কয়েকদিন পরই পড়ে থাকে গলাকাটা লাশ৷
বিজ্ঞাপন
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কক্সবাজারের কুতুপালং আশ্রয় শিবিরের রোহিঙ্গাদের এখন দিন কাটছে মুখোশধারীদের আতঙ্কে৷ তারা কোন রাতে এসে কাকে তুলে নিয়ে যায়– এই আতঙ্ক৷ অস্থায়ী শিবিরে আশ্রিতদের অনেকের দাবি, প্রায় রাতেই রাস্তায় রহস্যজনকভাবে ঘুরতে দেখা যায় মুখোশধারীদের৷
গত কিছুদিনে যে তিনজনের লাশ পাওয়া গেছে, তাঁদের একজনের নাম মোহাম্মদ আইয়ুব৷ গত ১৪ জুন রাতে ২০-২৫ জন মুখোশধারী এসে তুলে নিয়ে যায় তাঁকে৷ ২৫ জুন অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরের কাছেই পাওয়া যায় ৩০ বছর বয়সি আইয়ুবের লাশ৷ তাঁর গলা কাটা ছিল, হাত ছিল বাঁধা৷ রয়টার্সকে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আইয়ুবের স্ত্রী নূর আনকিস বলেছেন, ‘‘ওরা আমাকে আর আমার বোনকে পিটিয়ে ওকে (আইয়ুব) বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়৷’’ আইয়ুব-আনকিসের দুই শিশু সন্তান তখন ঘুমাচ্ছিল৷ রাতের আঁধারে মুখোশধারীরা তুলে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে আইয়ুবের আর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না৷ অবশেষে বাংলাদেশের সব মুসলমান যখন রোজা শেষে ঈদের আনন্দের অপেক্ষা করছেন, তখন স্বামীর লাশ পান আনকিস৷ স্বামীকে কবর দেয়ার পর থেকে যোগ হয়েছে নতুন আতঙ্ক৷ আনকিস বলছিলেন, ‘‘অপহরণকারীরা আমাকেও ফোন করে হত্যার হুমকি দিয়েছে৷ আল-ইয়াকিন-এর নামে হুমকি দেয়া হচ্ছে আমাকে৷’’
বাংলাদেশে জন্ম নেয়া রোহিঙ্গা শিশুরা
মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতন থেকে মুক্তি পেতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন৷ অনেক গর্ভবতী মা বাংলাদেশে এসে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন৷
ছবি: Reuters/M. P. Hossain
স্বামীর খবর জানেন না তিনি
রামিদা বেগমের স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী৷ এরপর তাঁদের বাড়িঘরও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷ তার সপ্তাহখানেক পর পালিয়ে বাংলাদেশে চলে যান তিনি৷ ফলে স্বামীর খবর এখন জানেন না রামিদা৷ ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখে যখন ছবিটি তোলা হয় তখন তাঁর কন্যার বয়স ছিল ১০ দিন৷ তখনও মেয়ের কোনো নাম দেয়া হয়নি রামিদার৷
ছবি: Reuters/M. P. Hossain
এই শিশুর বাবাকে হত্যা করা হয়েছে
স্বামীকে মিয়ানমারের সেনারা হত্যা করায় বাবামা-র সঙ্গে বাংলাদেশে চলে যান ১৮ বছরের নূর কায়েস৷ কোলে তাঁর ২৬ দিনের সন্তান, যার এখনও কোনো নাম দেননি তিনি৷ ছবিটি ৯ ফেব্রুয়ারি তোলা৷
ছবি: Reuters/M. P. Hossain
সাত দিনের মেয়ে
ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখে যখন ছবিটি তোলা হয় তখন আসমত আরার মেয়ের বয়স ছিল মাত্র সাত দিন৷ মাসখানেক আগে তিনি প্রতিবেশীদের সঙ্গে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে যান৷ বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার আগে তাঁর শ্বশুরকেও হত্যা করা হয়৷
ছবি: Reuters/M. P. Hossain
সন্তানদের বাঁচাতে বাংলাদেশে
একমাস বয়সি ছেলে সন্তানের সঙ্গে রাজুমা বেগম৷ যখন বাংলাদেশে আসছিলেন তখন গর্ভবতী ছিলেন তিনি৷ সঙ্গে ১১ মাসের আরেকটি সন্তানও ছিল৷ ‘‘আমি বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছি কারণ মিয়ানমারের ভয়ের মধ্যে ছিলাম৷ আমার সন্তানদের বাঁচাতে চেয়েছি আমি’’, রয়টার্সকে বলেন বেগম৷ ছবিটি ১২ ফেব্রুয়ারি তোলা৷
ছবি: Reuters/M. P. Hossain
দেশে ফিরতে আগ্রহী সানোয়ারা
৯ ফেব্রুয়ারি তোলা এই ছবিতে ২৫ দিনের কন্যা কোলে ২০ বছর বয়সি মা সানোয়ারা বেগমকে দেখা যাচ্ছে৷ প্রায় আড়াই মাস আগে স্বামীর সঙ্গে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছেন তিনি৷ এখন আছেন কক্সবাজারের কুতুপালাং আশ্রয়কেন্দ্রে৷ মিয়ানমারের পরিস্থিতি ভাল হলে নিজ ঘরে আবারও ফিরে যেতে চান সানোয়ারা৷
ছবি: Reuters/M. P. Hossain
বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে
ফেব্রুয়ারির ৯ তারিখে তোলা এই ছবিতে মারিজানকে তাঁর ২৫ দিন বয়সি কন্যা সন্তান সহ দেখা যাচ্ছে৷ পাশে তাঁর ছেলে৷ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ঘর পুড়িয়ে দেয়ায় মাসখানেক আগে তাঁরা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে পৌঁছান৷
ছবি: Reuters/M. P. Hossain
কন্যার জ্বর
দু’মাস বয়সি মেয়ের জ্বর কিন্তু মা আরাফা বেগম জানেন না ক্লিনিক কোথায়৷ আড়াই মাস আগে স্বামী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশে আসেনি তিনি৷
ছবি: Reuters/M. P. Hossain
বাচ্চা পর্যাপ্ত বুকের দুধ পাচ্ছে না
মিনারা বেগমের এক মাস বয়সি সন্তান পর্যাপ্ত বুকের দুধ পাচ্ছে না, কারণ তার মা পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার খেতে পান না৷ ফলে স্বাস্থ্যকর না হলেও স্থানীয় বাজার থেকে গুঁড়া দুধ কিনে খাওয়াতে হচ্ছে তাকে৷ ছবিটি ১০ ফেব্রুয়ারি তোলা৷
ছবি: Reuters/M. P. Hossain
এলোপাথাড়ি গুলি
১৬ দিনের সন্তান কোলে মা আমিনা৷ ‘‘মাস দেড়েক আগে মিয়ামারের সেনাবাহিনী আমাদের গ্রামে ঢুকে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে৷ আমি কোনোরকমে প্রতিবেশীদের সঙ্গে পালিয়ে বেঁচেছি৷ তারা আমার চাচা আর ছোটভাইকে ধরে নিয়ে গেছে৷ তারা বেঁচে আছে কিনা জানিনা’’, ৮ ফেব্রুয়ারি রয়টার্সকে কথাগুলো বলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/M. P. Hossain
বয়স মাত্র একদিন
ফাতেমার সন্তানের বয়স মাত্র একদিন৷ ছবিটি ফেব্রুয়ারির ৯ তারিখে তোলা৷ মিয়ানমারে তাদের ঘর পুড়িয়ে দেয়ায় মাস দুয়েক আগে স্বামীর সঙ্গে বাংলাদেশে চলে আসেন৷ এখন তাঁর স্বামী দিনমজুর হিসেবে কাজ করছেন৷
ছবি: Reuters/M. P. Hossain
10 ছবি1 | 10
আল-ইয়াকিন মানে রোহিঙ্গাদের জঙ্গি সংগঠন ‘হারাকাহ আল-ইয়াকিন’৷ গত বছরের অক্টোবরে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের ঘাঁটিতে যে হামলা হয়েছিল, তার জন্য হারাকাহ আল-ইয়াকিনকেই দায়ী করা হয়৷ ওই হামলার পরই সন্ত্রাসী নির্মূলের নামে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অঞ্চলে ব্যাপক অভিযানে নামে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী৷ জঙ্গি সংগঠনটি এখন ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ নামে তৎপরতা চালাচ্ছে৷
আইয়ুবের স্ত্রী রয়টার্সকে জানান, তাঁর স্বামী কুতুপালং আশ্রয় শিবিরের মাদকসেবীদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়েছিলেন৷ মাদকসেবীদের সঙ্গে আল-ইয়াকিনের যোগাযোগ আছে কিনা, কিংবা কোনো বিশেষ গোষ্ঠী আল-ইয়াকিনের নাম ব্যবহার করছে কিনা, সে বিষয়ে কিছু বলতে পারেননি আনকিস৷ আইয়ুবের অপহরণ এবং হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে তিন জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷ তবে হত্যাকারী, হত্যার কারণ এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে পুলিশও এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি৷
তাই কুতুপালং অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে সবার রাত কাটছে আতঙ্কে৷ এক রোহিঙ্গা তরুণ রয়টার্সকে প্রতি রাতের আতঙ্ক সম্পর্কে জানালেন এভাবে, ‘‘এক রাতে আমি যখন দুই সন্তান আর স্ত্রী-র সঙ্গে ঘুমাচ্ছি, ওরা এসে আমার নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করল৷’’ অনেক ডাকাডাকির পরও দরজা না খোলার কথা জানিয়ে আতঙ্কিত তরুণ আরো বলেন, ‘‘যেই এক ঘণ্টা ওরা আমার ঘরের বাইরে অপেক্ষা করেছিল সেটা আমার জীবনের দীর্ঘতম এক ঘণ্টা৷’’