জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে গুম, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়ে গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে৷ সমালোচনা করা হয়েছে বাকস্বাধীনতা হরণ ও বিশেষ অবস্থায় বাল্যবিবাহকে অনুমোদন দেয়ার বিষয়টিও৷
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশকে অবশ্যই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গুম, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো তদন্ত করে দেখতে হবে৷ ঘটনার শিকার যাঁরা, সেইসব নাগরিকদের যথাযথ সহায়তা দিতে হবে বাংলাদেশের৷ সরকারের উচিত গুম ও অপহৃত ব্যক্তিদের সন্ধান করা এবং তাঁদের আত্মীয়দের তদন্তের অগ্রগতি জানানো৷’
প্রতিবেদনে ছ'মাস আগে বিরোধী দলের তিন নেতার তিন সন্তানের অপহরণ হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়৷ সে সময় জাতিসংঘের ‘গ্রুপ ইনভলান্টারি এনফোর্সড ডিসাপেয়ারেন্স' বাংলাদেশ সরকারকে তাদের খুঁজে বের করার আহ্বান জানায়৷ হাম্মাম কাদের চৌধুরী নামে তাঁদের একজন ইতিমধ্যে মুক্তি পেলেও, আরো দু'জন মীর আহমেদ বিন কাশেম ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুল্লাহ হিল আমান আল-আজমি এখনো রাষ্ট্রের কাছে বন্দি আছেন বলে তারা দাবি করছে৷
বিচার পাওয়ার আশা যেন দুরাশা
‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ বাংলাদেশে এখন একটি অতি উচ্চারিত শব্দযুগল৷ বিচার হচ্ছে না কিংবা বিচারের অপেক্ষায় আছে এমন কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: dapd
ব্লগার হত্যা
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি টিএসসির সামনে দুর্বৃত্তরা মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এরপর একে একে হত্যার শিকার হন ব্লগার নীলাদ্রী নিলয়, অনন্ত বিজয় দাশ, ওয়াশিকুর বাবু, প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন৷ এ সব হত্যাকাণ্ডের কোনোটির বিচারে ‘উল্লেখযোগ্য’ অগ্রগতি না হওয়ায় সম্প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান৷
ছবি: Privat
সাংবাদিক দম্পতি হত্যা
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ভাড়া বাসায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনিকে হত্যা করা হয়৷ গত চার বছরে এই মামলার তদন্ত থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ হয়ে র্যাব-এর হাতে পৌঁছেছে৷ গত মে মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘সাম্প্রতিক সময়ে আমরা প্রত্যেক হত্যাকাণ্ড তদন্তের মাধ্যমে তার বিচার করতে পেরেছি৷ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড অন্য কথা৷ ওটা এখানে না আসাই ভালো৷’’
ছবি: DW
ধর্ষণের বিচার
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে ৬৬০ জন নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ অথচ কোনো ঘটনারই বিচার হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/E. McGregor
ত্বকী হত্যা
নারায়ণগঞ্জ গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তা রফিউর রাব্বির ছেলে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে ২০১৩ সালের ৬ মার্চ হত্যা করা হয়৷ হত্যার দুদিন পর শীতলক্ষ্যার একটি খালে তার লাশ পাওয়া যায়৷ রাষ্ট্রের অনিহা থাকায় এই হত্যাকাণ্ডের বিচার থমকে আছে বলে সম্প্রতি অভিযোগ করেন রফিউর রহমান রাব্বি৷ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাংসদ শামীম ওসমানের পরিবারের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: Facebook/Taqi.Mancha
তনু হত্যা
চলতি বছরের ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর মৃতদেহ পাওয়ার পর দেশব্যাপী প্রতিবাদ উঠেছিল৷ দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি উঠেছিল৷ কিন্তু এখনও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি৷ তবে তদন্তকাজ চলছে৷
ছবি: Twitter
শিল্প কারখানায় দুর্ঘটনা
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে সাভারের রানা প্লাজা ধসে এগারশ’র বেশি মানুষের প্রাণ যায়৷ এর মধ্যে বেশিরভাগই পোশাক শ্রমিক ছিল৷ তিন বছরেরও বেশি সময় পর গত জুলাইতে এই ঘটনায় করা হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়৷ ঢাকার এক অনলাইন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৬ বছরে উল্লেখ্যযোগ্য শিল্প দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৮টি৷ এর কোনোটিরই বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি৷ প্রতিবেদনটি পড়তে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Reuters
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা
১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর বনানীর ১৭ নম্বর রোডের আবেদীন টাওয়ারে ট্রাম্পস ক্লাবের নীচে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ ঘটনার দিনই তাঁর ভাই গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেছিলেন৷ এই অভিনেতা খুন হওয়ার পর চলচ্চিত্র প্রযোজক ও ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠলেও এখনও মামলার বিচার শুরু করা যায়নি৷ আরও তথ্য জানতে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: bdnews24.com
সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা
২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে আওয়ামী লীগের জনসভা শেষে ফেরার পথে গ্রেনেড হামলায় মারা যান সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ পাঁচজন৷ এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা – দু’টিই হবিগঞ্জে দায়ের হলেও পরে সিলেটে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়৷
ছবি: Facebook/Justice-for-Shah-AMS-Kibria
হতাশ রামুর ক্ষতিগ্রস্তরা
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের রামু উপজেলায় কোরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে বৌদ্ধপল্লীতে হামলা চালিয়ে ১২টি বৌদ্ধ মন্দির ও ৩০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে একদল লোক৷ ঐ ঘটনার চার বছর পরও মামলা গতিশীল না হওয়ায় হাতাশা প্রকাশ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা৷ পিপি মমতাজ আহমদ সম্প্রতি বলেন, এই হামলার ঘটনায় দায়ের করা ১৯টি মামলায় ইতোমধ্যেই অভিযোগ গঠন করা হয়েছে৷ আরও তথ্য জানতে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: AFP/Getty Images
নারী নির্যাতনের মামলা ৫,০০৩টি, রায় ৮২০টির
২০১৫ সালে প্রকাশিত মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক জরিপ বলছে, গত নয় বছরে দেশের নয়টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২২,৩৮৬ জন নারী ধর্ষণসহ বিভিন্ন নির্যাতনের ঘটনায় চিকিৎসা নেন৷ এই ঘটনাগুলোর বিচারিক প্রক্রিয়ায় দেখা গেছে এ সব ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ৫,০০৩টি৷ রায় ঘোষণা হয়েছে ৮২০টি, শাস্তি হয়েছে ১০১ জনের৷ শতকরা হিসাবে রায় ঘোষণার হার ৩.৬৬ এবং সাজা পাওয়ার হার ০.৪৫ শতাংশ৷
ছবি: dapd
10 ছবি1 | 10
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর, বাংলাদেশে ১৩০০-এরও বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও ৩২৫টি গুমের ঘটনা ঘটেছে৷ এর আগে বিএনপি সরকারের আমলেও এমন ঘটনা ঘটেছে বলে বলা হয় রিপোর্টে৷ তবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এমন অসংখ্য ঘটনা নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সীমাবদ্ধতা আছে বলে অভিযোগ করেছে জাতিসংঘ৷ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বিশেষ করে পুলিশ, সামরিক বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যেখানে জড়িত, সেখানে মানবাধিকার কমিশনের এখতিয়ার সীমিত৷’
বাংলাদেশের নাগরিকদের বাকস্বাধীনতার অভাব নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে৷ বহুল সমালোচিত আইসিটি আইনের আওতায় ২০১৬ সালে ৩৫ জন সাংবাদিক, ব্লগার ও মানবাধিকার কর্মীকে আটক করা হয়েছে উল্লেখ করে এর সমালোচনা করেছে সংগঠনটি৷
তবে ২০১০ সালের জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, গৃহকর্মী নির্যাতন প্রতিরোধে আইন, ২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন এবং পুলিশ হেফাজতে আসামি নির্যাতন ও মৃত্যু নিরোধ আইনকে ইতিবাচকভাবে দেখছে জাতিসংঘ৷ মানবপাচার রোধে ২০১২ সালে প্রণয়ন করা আইনটিরও প্রশংসা করেছে সংস্থাটি৷
জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন নিয়ে বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচলাক নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের নামে মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে৷ ঘটছে গুম ও অপহরণের ঘটনাও৷ মানবাধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদির ধরে এর স্বাধীন তদন্ত দাবি করে আসছে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে৷ কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, সরকার এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না৷ ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই ঘটনাগুলো থামছে না এবং তার সঙ্গে বিচার পাওয়ার পথও খুলছে না৷’’
‘একটা দম বন্ধ করা অবস্থার মধ্যে আমরা আছি’
তিনি বলেন, ‘‘আজকে জাতিসংঘ একই কথা বলছে৷ যাঁরা ভুক্তভোগী, তাঁদের বিচার পাওয়ার অধিকার আছে৷ তাছাড়া রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব তাঁদের বিচার নিশ্চিত করা৷’’
বাকস্বাধীনতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারার যথেচ্ছ অপব্যবহার হচ্ছে বাংলাদেশে৷ এছাড়া বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের মালিক ও সম্পাদকদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে, নানারকম মামলায়৷ অবশ্য এই মামলা যে সরাসরি সরকার দিচ্ছে, তা নয়৷ সরকারি দলের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের এই মামলা দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে৷ বহু সম্পাদকের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা করা হয়েছে৷ ফলে এক ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছে এ মুহূর্তে৷ সংবাদ কর্মীরা সেন্সরশিপের কারণে ভুগছেন৷ ওদিকে সাধারণ মানুষও এক ধরনের ভয়ের মধ্যে থেকে মুক্ত মনে কথা বলার অধিকার হারাচ্ছে৷
নূর খান আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘এটাকে এক কথায় ব্যাখ্যা করলে বলা যায়, গলা টিপে ধরলে যা হয়, সেই অবস্থা এখন বাংলাদেশে৷ একটা দম বন্ধ করা অবস্থার মধ্যে আমরা আছি৷’’