বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো গোপনে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বন্দি করছে, এদের অনেককে পরে হত্যাও করছে বলে অভিযোগ করেছে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ)৷
বিজ্ঞাপন
সংস্থাটি বলছে, ২০১৩ সাল থেকে দেশটির সরকার শত শত মানুষকে গোপন স্থানে আটক করে রেখেছ৷ গত বছরই ৯০ জনের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে৷
নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক এই সংস্থাটি এভাবে আটক হওয়া ২১ জনের ক্ষেত্রে তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করেছে৷ যাদেরকে পরে হত্যাও করা হয়৷ আরও ন'জন কোথায় রয়েছে, সেটা জানা যাচ্ছে না৷
সংস্থাটির এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস বলেন, দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো অবাধে মানুষ আটক করে তাঁরা অপরাধী নাকি নির্দোষ-সেই সিদ্ধান্তও দিয়ে দিচ্ছে৷ শাস্তিও নির্ধরণ করছে, এমনকি তারা বেঁচে থাকতে পারবে কি-না, সেটাও ঠিক করে দিচ্ছে৷
এ রকম নিখোঁজদের একজন সাজেদুর ইসলাম সুমন (৩৭)৷ যিনি দেশটির প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত৷
সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম জানিয়েছেন, ব়্যাপিড অ্যাকশ ব্যাটালিয়ন ব়্যাবের কর্মকর্তারা তাঁর ভাইসহ আরো পাঁচজনকে ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর আটক করে৷ বিএনপির বয়কটের মধ্যে ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের এক মাস আগে এই ঘটনা ঘটে৷
তিনি বলেন, সেখানে ২০ জনের মতো নির্মাণ শ্রমিক ছিলেন৷ তাঁরা দেখেছেন, তাঁর ভাই ও অন্যদের ব়্যাব ধরে নিয়ে গাড়িতে তুলছে৷ তাঁরা এরপর আর ফিরে আসেননি৷
গত ৩ বছর এবং ৮ মাসে আমরা সব সংস্থার দপ্তরের দুয়ারে দুয়ারে গিয়েছি৷ আমার ভাইয়ের খবর জানতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তরেও গিয়েছি৷
ব়্যাব এবং পুলিশ এই নিখোঁজের সঙ্গে তাঁদের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে৷
র্যাব – বিতর্কিত এক বিশেষ বাহিনী
শুরুটা হয়েছিল ২০০৪ সালে৷ সেসময় বাঘা বাঘা জঙ্গিদের কুপোকাত করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় ব়্যাব৷ কিন্তু অসংখ্য ক্রসফায়ার, অপহরণ, হত্যার দায়ে এখন সমালোচিত এই ‘এলিট ফোর্স’৷ র্যাব নিয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/AFP
‘এলিট ফোর্স’
বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব নামক ‘এলিট ফোর্স’-এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে৷ এই বাহিনীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ‘‘পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে সরকার একটি এলিট ফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করে৷’’ তবে এই বাহিনী এখন তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন মহল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সমন্বিত বাহিনী
বাংলাদেশ পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে র্যাব গঠন করা হয়৷ এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাস প্রতিরোধ, মাদক চোরাচালান রোধ, দ্রুত অভিযান পরিচালনা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কার্যক্রমে নিরাপত্তা প্রদান৷
ছবি: Getty Images/AFP
জঙ্গি তৎপরতা দমন
শুরুর দিকের ব়্যাবের কার্যক্রম অবশ্য বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল৷ বিশেষ করে ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে বাংলাদেশে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা উগ্র ইসলামি জঙ্গি তৎপরতা দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে র্যাব৷
ছবি: AP
জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার
বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় ২০০৫ সালে একসঙ্গে বোমা ফাটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা জেএমবির শীর্ষ নেতাদের আটক ব়্যাবের উল্লেখযোগ্য সাফল্য৷ ২০০৬ সালের ২ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান (ছবিতে) এবং ৬ মার্চ সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় ব়্যাব৷ একাজে অবশ্য পুলিশ বাহিনীও তাদের সহায়তা করেছে৷
ছবি: DW
ভুক্তভোগী লিমন
২০১১ সালে লিমন হোসেন নামক এক ১৬ বছর বয়সি কিশোরের পায়ে গুলি করে এক ব়্যাব সদস্য৷ গুলিতে গুরুতর আহত লিমনের বাম পা উরুর নীচ থেকে কেটে ফেলতে হয়৷ এই ঘটনায় ব়্যাবের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ তবে এখনো সুবিচার পায়নি লিমন৷ উল্টো বেশ কিছুদিন কারাভোগ করেছেন তিনি৷
ছবি: DW
‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’
জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্য দেখালেও ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব়্যাবের বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমশ বাড়তে থাকে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করে জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বাহিনী ‘সিসটেমেটিক’ উপায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে৷
ছবি: DW
‘ক্রসফায়ার’
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ব়্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ২৪ জন৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে কমপক্ষে সাতশো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ব়্যাব জড়িত ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আলোচিত সাত খুন
২০১৪ সালের মে মাসে ব়্যাবের বিরুদ্ধে ৬ কোটি টাকা ঘুসের বিনিময়ে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ এবং খুনের অভিযোগ ওঠে৷ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন ব়্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ৷ এই ঘটনার পর ব়্যাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আবারো বিতর্ক শুরু হয়েছে৷
ছবি: DW
প্রতিষ্ঠাতাই করছেন বিলুপ্তির দাবি
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করেছেন৷ অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ‘এলিট ফোর্স’৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিলুপ্তির দাবি নাকচ
বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক স্তর থেকে ব়্যাবকে বিলুপ্তির দাবি উঠলেও বর্তমান সরকার সেধরনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না৷ বরং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ব়্যাব বিলুপ্তির দাবি নাকচ করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘র্যাবের কোনো সদস্য আইন ভঙ্গ করলে তাদের চিহ্নিত করে বিচারিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়৷’’
ছবি: Getty Images/AFP
10 ছবি1 | 10
আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ফের রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ বাড়ছে৷ এর মধ্যে এ সব ঘটনায় সরকারের কাছ থেকে জবাব আদায় করতে হারিয়ে যাওয়া ২২ বিএনপি কর্মীর মা মিলে গঠন করেছেন ‘মায়ের ডাক' নামে একটি সংগঠন৷
সানজিদা বলেন, অপহরণের অভিযোগের মধ্যে ফরহাদ মজহারকে পুলিশ উদ্ধার করেছে৷ আমরা তাই আশাবাদী৷ আমরা চাই, আমার ভাই ফিরে আসুক৷ যার দু'টো বাচ্চাও রয়েছে৷
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, ২০১৭ সালের প্রথম পাঁচ মাসে ৪৮ জন নিখোঁজ হয়েছে৷ স্থানীয় মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, ২০০৯ সাল থেকে ৩২৬ ব্যক্তি নিখোঁজ হয়েছে৷
বিএনপি এবং তাদের প্রধান জোট সহযোগী জামাত ইসলামির ১০ হাজার নেতাকর্মী সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দল দু'টোর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে৷
যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে নানা বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল৷ সামাজিক মাধ্যমে সংস্থাটির তুমুল সমালোচনায়মুখর হয়েছে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম৷
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের দেশীয় সহযোগীদের হাতে ৩০ লাখ মানুষ নিহত হয়৷
সমালোচকদের অভিযোগ, সংস্থাটি একাত্তরে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকারকে প্রাধান্য না দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে৷