1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশে জলবায়ু উদ্বাস্তু

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১৫ আগস্ট ২০১৭

বাংলাদেশে জলবায়ু উদ্বাস্তু বাড়ছে৷ এরা শুধু দেশের ভেতরে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় নয়, বিদেশেও পাড়ি জমাচ্ছেন৷ বিদেশে যাঁরা কাজের সন্ধানে যাচ্ছেন, তাঁদের প্রথম গন্তব্য ভারত৷ মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রতারিত হয়েও ফিরছেন কেউ কেউ৷

ছবি: DIPTENDU DUTTA/AFP/Getty Images

যাঁরা আবাস্থল ছেড়ে অন্যস্থানে চলে যেতে বাধ্য হন, তাঁরাই উদ্বাস্তু৷ এর নানা হিসেব ও সংজ্ঞা আছে৷ এই উদ্বাস্তু অবস্থা দেশ ছেড়ে অন্য দেশে গেলেই যে হবে, তা নয়৷ দেশের ভেতরে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে গেলেও তিনি উদ্বাস্তু৷ মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা উদ্বাস্তু হচ্ছেন জাতিগত নিপীড়ণের কারনে৷ কিন্তু প্রকৃতিও মানুষকে উদ্বাস্ত করে, করছেও৷ এ সময় তাই সবচেয়ে আলোচিত জলবায়ু উদ্বাস্তু৷

ঢাকার মোহাম্মদপুর এলকায় একটি বস্তির নাম ভোলাপাড়া৷ বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা ভোলার বিভিন্ন এলায় যাঁরা নদী ভাঙনের শিকার, তাঁরা এখানে এসে আশ্রয় নেন৷ এই বস্তিতে ভোলা থেকে জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে আসা কয়েকশ' পরিবার আশ্রয় নিয়েছে৷ তাই এই বস্তিরই নাম হয়ে গেছে ভোলাপাড়া৷ তাঁরা গত কয়েক বছর ধরে আসছেন৷ কেউ  আবার ঢাকার অন্যান্য বস্তিতেও চলে গেছেন৷ তবে ঐ এলাকা থেকে যাঁরা নদী ভাঙনের শিকার হয়ে ঢাকায় আসেন, ঢাকায় তাঁদের প্রথম ঠিকানা ভোলাপাড়া বস্তি৷

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং নদী ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত জানান,‘‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে উদ্বাস্তুর সংখ্যা বাড়ছে৷ এঁদের মধ্যে কিছু মানুষ দেশের বাইরেও যাচ্ছেন৷ মোহাম্মদপুরের ভোলাপাড়া বস্তি তার প্রমাণ৷''

এর পিছনে কাজ করছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লবণআক্ততা ও নদী ভাঙন৷ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের পনির উচ্চতা বাড়ায় সাগরের লবণাক্ত পানি ক্রমেই দেশের মধ্যভাগের দিকে ঢুকে পড়ছে বলে জানান ড. আইনুন নিশাত৷

ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার-এর হিসাব অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গত ছ'বছরে বাংলাদেশের ৫৭ লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়েছেন৷ ঢাকার বস্তি এলাকায় বসবাসকারীদের প্রায় ৭০ শতাংশই পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে স্থানান্তরিত বলে জানিয়েছে অভিবাসনবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএমও৷

লবণপানি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলকে ধীরে ধীরে গ্রাস করায় সেখানকার মানুষ শুধু কাজ হারিয়ে উদ্বাস্তু হচ্ছে না৷ তাঁরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতেও পড়ছেন৷ বিশেষ করে নারীদের এই ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি৷ বাংলাদেশের দক্ষিণে খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা, বাগেরহাটের মংলা ও শরণখোলা, সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলাসহ সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকার প্রায় ২ লাখ নারী ও কিশোরী প্রজনন স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে৷

‘প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গত ছ'বছরে বাংলাদেশের ৫৭ লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়েছেন’

This browser does not support the audio element.

ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘‘সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ার কারণে এখন লবণপানি উপকূলীয় এলাকা ছপিয়ে গোপলাগঞ্জ পর্যন্ত এসে পড়েছে৷ এর আগেই খুলনা বাগের হাট, সাতক্ষীরাসহ, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরসহ দক্ষিণের অনেক জেলা লবণ পানির গ্রাসে পড়েছে৷ কৃষি নষ্ট হচ্ছে, ফসলি জমি উর্বরাতা হারাচ্ছে৷ তাই যাঁরা কৃষির ওপর নির্ভরশীল তাঁরা পেশা হারাচ্ছেন৷''

এরইমধ্যে দেখা গেছে জলবায়ু পবির্তনের শিকার হয়ে যাঁরা ঢাকায় এসেছেন তাঁরা নিয়মিত কাজ পাচ্ছেন না৷ তাঁরা আগে প্রধানত কৃষক ছিলেন৷ কিন্তু এখন তাঁরা বলতে গেলে পেশা উদ্বাস্তু৷ নির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই৷ ২০১২ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ পরিচালিত গবেষণায় পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে অভিবাসী হওয়া প্রায় দেড় হাজার পরিবারকে শণাক্ত করা হয়৷ প্রায় সবগুলো পরিবার জানায়, পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে তাঁরা স্থানান্তরিত হয়েছেন৷

বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়ন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এক জনপদ৷ এছাড়া একই উপজেলার পদ্মপুকুর এবং আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগরও জলাবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ স্থানীয় সাংবাদিক আসাদুজাজামান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘২০০৯ সালে আইলার পর পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে টিকতে না পেরে গাবুরার আট হাজার পরিবারের মধ্যে তিন হাজার পরিবারই তাদের আবাস্থল ছেড়ে চলে গেছেন৷ এদের মধ্যে ২০টি পরিবার গেছে ভারতে৷ তাঁরা খাদ্য, পানীয় জল এবং কাজের সংকটের কারণে নিজেদের পিতৃপুরুষের ভিটে ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন৷''

‘কিছু গেছেন ভারতে এবং যাঁরা একটু স্বচ্ছল, তাঁরা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছেন’

This browser does not support the audio element.

ওই এলাকায় কাজ করে স্থানীয় এনজিও লিডার্স৷ তাঁর নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মন্ডল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শুধু গরিব মানুষই নয়, এই এলাকার বিত্তশালীরাও এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন৷ যাঁরা বিত্তবান, তাঁরা এই এলাকা বসবাসের উপযোগী নয় বলে শহরে গিয়ে থাকছেন৷ গরিব যাঁরা, তাঁদের বড় একটি অংশ খুলনা ও ঢাকাসহ দশের বিভিন্ন শহরে কাজের আশায় গেছেন৷ এছাড়া কিছু গেছেন ভারতে এবং যাঁরা একটু স্বচ্ছল, তাঁরা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছেন৷ মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রতারিত হয়ে, নির্যাতনের শিকার হয়ে আবার কেউ কেউ ফিরে এসেছেন৷''

তিনি জানান, ‘‘আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উদ্বাস্তু হওয়া এই এলাকার ৮০টি পরিবারের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি৷ তাতে তাঁরা বলেছেন, খাবার পনির সংকট, কাজের অভাব এবং পেশা হারানোর কারণে তাঁরা এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন৷ তাঁদের ঘরবাড়ি বানাবার টাকাও নেই৷ তাই ভিটেমাটি ছেড়ে চলে গেছেন৷''

তিনি বলেন, ‘‘লবণপানির কারণে কৃষকরা পেশা হরিয়েছেন৷ বাঁধের ওপর ও বসবাসের সুযোগ নেই৷ কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বারবার বাধ ভেঙে যায়৷ যাঁরা চলে গেছেন, তাঁরা এখন কেউ নির্মাণ শ্রমিক, কেউ মাটি কাটার কাজ করেন আবার কেউ কেউ শহরে রিকশা চালান৷ যাঁরা ভারতে গেছেন, তাঁরাও নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন৷''

‘২০০৯ সালে আইলার পর গাবুরার তিন হাজার পরিবারই তাদের আবাস্থল ছেড়ে চলে গেছেন’

This browser does not support the audio element.

ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘‘জলবায়ু উদ্বাস্তুদের একটি অংশকে আমরা হিসেবে আনতে পরছি না৷ তাঁরা সাময়িক উদ্বাস্তু৷ কারণ তাঁরা ছ'মাস পর আবার এলাকায় ফিরে আসেন৷ এবার বন্যায় সিলেট, সুনামঞ্জসহ ঐ এলকার ফসলের হানি হয়েছে৷ ফলে আগামী অন্তত ছ'মাস তাঁদের খাবার নেই, তাই কাজও নেই৷ সে কারণেই তাঁরা শহরে চলে এসেছেন৷ ছ'মাস পর হয়ত তাঁরা ফিরে যাবেন৷ আবার কেউ হয়ত ফিরবেন না৷''

প্রতিবছর বাংলাদেশে সমুদ্রের পানির উচ্চতা আট মিলিমিটার করে বাড়ছে, যা বিশ্বের গড় বৃদ্ধির দ্বিগুণ৷ ২০৮০ সাল নাগাদ এই অঞ্চলে পানির উচ্চতা ২ ফুট বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ তাই যদি হয়, তাহলে বাংলাদেশের ৪০ ভাগ এলাকা লবণ পানিতে তলিয়ে যাবে৷ এই ৪০ ভাগ এলাকায় প্রায় ৫ কোটি মানুষের বসবাস৷ এর ফলে ফসলি জমি নষ্ট হবে, কৃষক-জেলে তাঁদের পেশা হারাবেন৷ তাঁরা হারাবেন তাঁদের আশ্রয় বা আবাস৷

বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অন্তত চার লাখ মানুষ ঢাকায় চলে আসেন৷  দিনের হিসাব করলে প্রতিদিন কম করে হলেও দু'হাজার মানুষ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ঢাকায় আসেন আশ্রয়ের সন্ধানে৷ এঁদের ঠাঁই হয় বস্তিতে৷ এঁদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগই জলবায়ু উদ্বাস্তু৷

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের  ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ