বাংলাদেশের গোয়েন্দা পুলিশ আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে একটি আলোচিত জঙ্গি সংগঠনের দুই সদস্যকে আটকের পর, চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে৷ জঙ্গিরা স্থানীয়ভাবে তৈরি ‘ড্রোন'-এর সহায়তায় হামলার পরিকল্পনা করছিল৷
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার রাতে ঢাকার যাত্রাবাড়ি এলাকার একটি বাড়ি থেকে তানজিল হোসেন বাবু ও গোলাম মাওলা মোহন নামের ওই দুই যুবককে আটক করা হয়৷ গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, তারা জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য৷ তাদের কাছ থেকে দূর নিয়ন্ত্রিত ‘ড্রোন' বা কোয়াডকপ্টার তৈরির যন্ত্রপাতি এবং সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে৷
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার মনিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এর মধ্যে রয়েছে, ড্রোন তৈরির প্রজেক্ট, ড্রোন তৈরির সরঞ্জাম, বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও উগ্র মতবাদ সম্বলিত কয়েকটি বই৷''
ড্রোনের সামরিক ব্যবহার
ড্রোন যে শুধু ছবি তোলার কাজে ব্যবহার হয়, এমন নয়৷ বরং যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা নজরদারিতে এর ব্যবহার আরো ভয়াবহ৷ যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ ড্রোন ব্যবহার করছে যুদ্ধের কাজে, জঙ্গি দমনে৷ তবে এতে বেসামরকি প্রাণহানিও ঘটছে৷
ছবি: Thomas Coex/AFP/Getty Images
মেক্সিকো-অ্যামেরিকা সীমান্তে ড্রোন
ছবির এই ড্রোনটি তৈরি করেছে এলবিট সিস্টেমস লিমেটেড৷ মেক্সিকো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে টহলের কাজে মনুষ্যবিহীন এই ড্রোন ব্যবহার করা হয়৷
ছবি: Elbit Systems Ltd. via Getty Images
ইসরায়েলের ড্রোন
‘স্কাইলার্ক’ ড্রোন হাতে ইসরায়েলি এক সেনা৷ মূলত ফিলিস্তিনের উপর নজরদারির জন্য ব্যবহার করা হয় এগুলো৷ গাজায় ইসরায়েলের সর্বশেষ হামলার সময় ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে৷
ছবি: Jack Guez/AFP/Getty Images
আকাশ পানে তাকিয়ে থাকা
গাজার আকাশে ওড়া ইসরায়েলের ড্রোনের দিকে তাকিয়ে আছে এক ফিলিস্তিনি শিশু৷ জুলাই এবং আগস্টে গাজায় ইসরায়েলের হামলায় প্রাণ হারিয়েছে দুই হাজারের বেশি মানুষ, যাদের মধ্যে অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক৷ অন্যদিকে ইসরায়েলের ৬৩ সেনা এবং চার বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছে৷
ছবি: Thomas Coex/AFP/Getty Images
আধুনিকতম ‘ড্রোন’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি নতুন ধরনের ড্রোন তৈরির চেষ্টা করছে যেটি পৃথিবীর যে কোনো স্থানে এক ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে হামলা চালাতে সক্ষম হবে৷ সোমবার এই যানের এক পরীক্ষামূলক ফ্লাইট অবশ্য ব্যর্থ হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/DARPA
জঙ্গি নিধনে ড্রোন
আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলে ড্রোন ব্যবহার করে জঙ্গি নিধনে ভূমিকা রাখছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ তবে এ সব হামলায় বেসামরিক প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে৷ পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ ইমরান খান ড্রোন হামলার বিপক্ষে জনমত তৈরির চেষ্টা করছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বেসামরিক ব্যবহার
সামরিক ব্যবহার ছাড়াও ছবি কিংবা ভিডিও করা থেকে শুরু করে বর্তমানে ডাক যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও ড্রোন ব্যবহার শুরু হয়েছে৷ নাগরিকদের কাছে সরকারি চিঠি-পত্র পাঠাতে ড্রোন ব্যবহারের পরিকল্পনা করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত৷
ছবি: Reuters
6 ছবি1 | 6
মনিরুল ইসলাম জানান, ‘‘দূর নিয়ন্ত্রিত ড্রোনের সাহায্যে তারা ওপর থেকে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছিল৷ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, ছয় মাস ধরে তারা ড্রোন তৈরির জন্য গবেষণা ও কার্যক্রম চালাচ্ছে৷ শুধু তাই নয়, তারা নাকি ড্রোন তৈরির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল৷ আরও কিছু টেকনিকাল সাপোর্ট পেলেই তারা এটি তৈরি করতে পারত৷''
খেলনা হেলিকপ্টারের চেয়ে একটু উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা ড্রোনটি তৈরি করছিল বলে জানান মনিরুল ইসলাম৷ তাঁর কথায়, ‘‘২০-৩০ তলা উঁচু ভবনে হামলা চালানোর জন্য ড্রোনটি তৈরি করছিল জঙ্গিরা৷''
তাদের হামলার টার্গেট বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এবং ব্যক্তিরা ছিলেন – এ কথা জানিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার বলেন, ‘‘সেকুলার রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকেরা ছিলেন হামলার লক্ষ্য৷ এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা করে বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণের পরিকল্পনা ছিল তাদের৷''
মনিরুল ইসলাম জানান, আটক মোহন গ্রিন ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্স বিষয়ে পড়াশোনা করছিল৷ অন্যদিকে তানজিলের অ্যাকাডেমিক ডিগ্রি না থাকলেও, সে টেকনিকাল দিকে থেকে পারদর্শী৷ এই দু'জন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের শীর্ষ নেতা জসীম উদ্দিন রাহমানীর অনুসারী, বলেন মনিরুল ইসলাম৷
আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নাম প্রথম আলোচনায় আসে গত বছর শেষ দিকে৷ আগস্ট মাসে বরগুনা থেকে এ সংগঠনের প্রধান মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানীসহ ৩১ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ পরদিন ঢাকার মোহাম্মদপুরে জসীমের বাসা ও অফিসে অভিযান চালিয়ে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, সিডিসহ উসকানিমূলক বই ইত্যাদি উদ্ধার করা হয়৷ এই টিমের সদস্যরাই ব্লগার হত্যা এবং তাঁদের ওপর হামলার সঙ্গে জড়িত৷
সহিংসতায় প্রধান হাতিয়ার ‘পেট্রোল বোমা’
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতার সময় পেট্রোল বোমার ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে৷ হাতে তৈরি এই বোমা ব্যবহার করে গাড়িতে আগুন দেয়ার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
পেট্রোল বোমায় পুড়ছে জীবন
বাংলাদেশে ২০১৩ সালে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে পাঁচ শতাধিক মানুষ৷ নির্বাচনসংক্রান্ত জটিলতা ছাড়াও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে এসময়৷ হরতাল, অবরোধ চলাকালে ব্যাপক আকারে ব্যবহার হয়েছে পেট্রোল বোমা৷
ছবি: imago/imagebroker/theissen
যেভাবে তৈরি হয় এই বোমা
কাঁচের বোতল, পেট্রোল আর কিছু ভাঙা কাঁচ বা মার্বেলের টুকরা ব্যবহার করে পেট্রোল বোমা তৈরি করছে দুর্বৃত্তরা৷ এরপর সুযোগ বুঝে সেগুলো নিক্ষেপ করছে যাত্রীবাহী গাড়িতে৷ ফলে গাড়ি পুড়ছে, সঙ্গে পুড়ছে মানুষ৷ সাম্প্রতিক সময়ে সহিংসতার আগুনে পুড়ে মারা গেছেন বেশ কয়েকজন৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: picture alliance/abaca
রয়েছে অন্য বোমাও
তবে শুধু পেট্রোল বোমাই নয়, লাল বা কালো টেপে মোড়া ককটেলও ব্যবহার হচ্ছে বাংলাদেশে৷ ককটেল তৈরিতে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ এবং ছোট পেরেক বা লোহার টুকরা৷ এছাড়া বোমা তৈরিতে গান পাউডারও ব্যবহার করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বোমা বাণিজ্য
রাজনৈতিক অস্থিরতায় সময় হাতে তৈরি বোমার চাহিদা বেড়ে যায়৷ তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা ছাড়াও পেশাদারি গ্রুপও বোমা তৈরি করে৷ চড়া দামে এসব বোমা বিক্রিও করা হয়৷ গত বছর পাওয়া হিসেব অনুযায়ী, একেকটি হাত বোমার দাম ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত৷
ছবি: Reuters
বড় পর্যায়ে বোমা হামলা
বলাবাহুল্য, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে আত্মঘাতী বা বড় পর্যায়ে বোমা হামলার কোনো ঘটনা ঘটেনি৷ তবে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল৷
ছবি: dpa - Bildfunk
আত্মঘাতী হামলা
১৭ আগস্টের সেই সিরিজ হামলার পর কয়েকটি আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনাও ঘটে৷ দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেসময় ‘‘বোমা হামলায় বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ কমপক্ষে ৩৩ জন নিহত হন৷’’ তবে নিরাপত্তা বাহিনী কঠোর হাতে জঙ্গিবাদের উত্থান দমনে সক্ষম হয়৷ ২০০৭ সালে জেএমবির কয়েকজন শীর্ষ নেতার ফাঁসি কার্যকর হয়৷
ছবি: AP
বোমা নিষ্ক্রিয়করণ টিম
ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি হারুন উর রশীদ স্বপন জানান, বাংলাদেশ পুলিশের শক্তিশালী বোমা নিষ্ক্রিয়করণ টিম রয়েছে৷ তাদের কাছে আধুনিক সরঞ্জামও রয়েছে৷ ইতোমধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের বোমা নিষ্ক্রিয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছে পুলিশের এই টিম৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
7 ছবি1 | 7
জসীমসহ এ সংগঠনের ১০ সদস্যের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলায় গত ১৬ই সেপ্টেম্বর অভিযোগপত্রও দিয়েছে পুলিশ৷
গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার ছানোয়ার হোসেন ডয়চে ভেলেকে জানান, আটক দু'জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে৷ জিজ্ঞাসাবাদে আরো বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে বলে তাঁর আশা৷
প্রসঙ্গত বাংলাদেশে জঙ্গিদের ‘ড্রোন' ব্যবহার করে হামলার পরিকল্পনার কথা এই প্রথম শোনা গেলেও, এর আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দূর নিয়ন্ত্রিত ‘ড্রোন' বা কোয়াডকপ্টার তৈরিতে সফল হয়েছেন৷ এ নিয়ে ব্যাপক উত্সাহ দেখা দিলে নিরাপত্তার কথা ভেবে অনুমতি ছাড়া এটা তৈরি ও উড্ডয়নে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়৷
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, এ ধরনের ‘পরীক্ষামূলক ড্রোন বা রিমোট কন্ট্রোল চালিত বিমান অথবা হেলিকপ্টার' ওড়ানোর আগে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ও বিমান বাহিনীর অনুমোদন নেয়া আবশ্যক৷