বাংলাদেশের দুটি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির বিরাট জয় পেয়েছে৷ জাতীয় নির্বাচনের আগে তাদের এই জয় নিয়ে জামায়াতের সম্ভাব্য রাজনৈতিক পুনরুত্থান নিয়ে জল্পনা সৃষ্টি হয়েছে৷
ছাত্র সংসদে পরপর দুটি বড় জয়ের পরজামায়াতে ইসলামী উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে এবং জাতীয় নির্বাচনেও ভালো ফলাফল করার আশা ব্যক্ত করেছে৷ তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে একটি আসনও না জেতা বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল বলেছে, তাদের খারাপ ফল জাতীয় নির্বাচনে প্রতিফলিত হবে না৷ছবি: DW
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির ২৫টির মধ্যে ২০টি আসনে জয়লাভ করেছে৷ এর কয়েক দিন আগেই শিবির সমর্থিত ইউনাইটেড স্টুডেন্টস অ্যালায়েন্স ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৮টির মধ্যে ২৩টি আসন জিতেছে৷ এর মধ্যে সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সহ-সাধারণ সম্পাদকের মতো শীর্ষ পদও রয়েছে৷ বর্তমানেবাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্র দল অবশ্য নির্বাচনের দিন এ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়৷
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ নির্বাচন ছিল দেশের প্রথম কোনো নির্বাচন৷
শেখ হাসিনার আমলে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনেজামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছিল৷ তবে গত বছর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসী কার্যকলাপে' জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি- জানিয়ে সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে৷
শিবির-জামায়াতের প্রত্যাবর্তন?
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল৷ স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনা করেছিল আওয়ামী লীগ, তখন শেখ হাসিনার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নেতা ছিলেন৷
পরে শেখ হাসিনার শাসনামলে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের অনেককে ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি বা কারাদণ্ড দেওয়া হয়৷
দলটি প্রায় এক দশক জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিল৷ কিন্তু শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর তাদের আবার রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে৷ অন্যদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে৷
যে ছয়টি বিষয়ে পরিবর্তন চান সব শ্রেণি, পেশার মানুষ
জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে৷ দুর্নীতি, নারীবিদ্বেষ, চাঁদাবাজি, নিরাপত্তাহীনতা, বিচারহীনতা ও অনৈক্য - এই ছয়টি বিষয় নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন তারা ৷ দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Arafatul Islam/DW
‘দুর্নীতি, বিচারহীনতা রয়ে গেছে, আমাদেরকে এসব সমস্যা দূর করতে হবে’: ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান, সংগীতশিল্পী
২০২৪ সালের ৫ ই আগস্ট স্বৈরাচারী সরকারের পতনের আগে যে সকল সমস্যা ছিল, যেমন, দুর্নীতি, বিচারহীনতা- তার সবই রয়ে গেছে৷ আমাদেরকে এসব সমস্যা দূর করতে হবে। নির্বাচনে ফিরতে হবে, রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা ফেরাতে হবে, বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। স্বৈরশাসকদের যেসকল অপরাধ ছিল তার বিচার করতে হবে।
ছবি: DW
‘যে মুক্তির স্বপ্ন দেখে নারীরাও পথে নেমেছিল, সেই মুক্তি আজ নারীবিদ্বেষী সামাজিকতার নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে’: ড.নাভিন মুরশিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক
জুলাই অভ্যুত্থানের কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছিল আকাশছোঁয়া। অথচ অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় এবং হতাশাজনক যে পরিবর্তনটি আমরা দেখছি, তা হলো, তীব্র নারীবিদ্বেষ। আমার কাছে সবচেয়ে দুঃখজনক এটাই যে, যে মুক্তির স্বপ্ন দেখে নারীরাও পথে নেমেছিল, সেই মুক্তি আজ নারীবিদ্বেষী সামাজিকতার নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে।
ছবি: DW
‘নির্বাচিত সরকার আসলে দেশের পরিবর্তন সম্ভব হবে বলে আশা করি’: আমিরুল ইসলাম, সিএন জি চালক
জুলাই অভ্যুত্থানের ফলে দেশে কোনো পরিবর্তন আসেনি৷ আগে দেশে যে সকল সমস্যা ছিল তা এখনো রয়েছে। দেশের বিচার ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে হবে। দেশে একটি সুস্থ নির্বাচন দিতে হবে। নির্বাচিত সরকার আসলে দেশের পরিবর্তন সম্ভব হবে বলে আশা করি৷
ছবি: DW
‘স্বপ্ন ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে’: মীর হুযাইফা আল মামদূহ, গবেষক
শেখ হাসিনার পতনের প্রক্রিয়াতে যেভাবে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাতে আমাদের সবার একটা আশা তৈরি হয়েছিল যে, আমরা হয়ত এমন একটা রাষ্ট্র পাবো, যেই রাষ্ট্র কল্যাণরাষ্ট্র হবে, যাতে কেউ কোনো পরিচয়, বিশ্বাস কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে বিচার্য হবে না, বরং সব ছাপিয়ে নাগরিক তার মর্যাদা পাবে। কিন্তু নানা কারণেই তা আর হয়নি, সেই স্বপ্ন ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে।
ছবি: DW
‘দেশের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি ও দলের স্বার্থের প্রাধান্য বেশি’: সৌমিক আহমেদ, অভিনেতা ও উদ্যোক্তা
জুলাই আন্দোলনের আশা-প্রত্যাশা একটাই ছিল - পরিবর্তন আর মুক্তি। কিন্তু সাধারণ মানুষের আর পরিবর্তন হয়নি, সে একই হানাহানি, রেষারেষি যেন আমাদের রক্তে মিশে গিয়েছে। বর্তমানেও দেশের স্বার্থ থেকে ব্যক্তি ও দলের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে দেখা যাচ্ছে, যা মোটেও কাম্য ছিল না।
জুলাইয়ের গণভ্যুত্থান মানুষের ভেতরের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, বঞ্চনা ও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থেকেই জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু আজ বর্ষপূর্তির আগমুহূর্তে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন উঠছে—এই আশা কতটা পূরণ হয়েছে?বাস্তবতা বলছে, সেই প্রত্যাশার অনেকটাই অপূর্ণ। ‘জুলাই স্পিরিট’ আজ বিভক্তির রাজনীতিতে ক্ষয়প্রাপ্ত। কার ভূমিকা কতটা ছিল—তা নিয়ে কৃতিত্বের লড়াই শুরু হয়েছে, যার ফলে বৈষম্যবিরোধী ঐক্যটিই ভেঙে পড়েছে।
ছবি: DW
‘চাঁদাবাজি, খুন, হত্যা বেড়েই চলেছে’: অদ্বিতীয়া, শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষা খাত, স্বাস্থ্য খাত তে অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, বিশেষ করে মানুষের নিরাপত্তার যে বিষয়টা, সেটা কোনোভাবেই এখন নিশ্চিত হচ্ছে না। প্রায় রোজ অপরাধ হয়েই যাচ্ছে, আর অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। চাঁদাবাজি, খুন, হত্যা বেড়েই চলেছে। কোন সমাধান হচ্ছে না বা সমাধানের কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।
ছবি: DW
7 ছবি1 | 7
এ অবস্থায় ডাকসু ও জাকসুতে শিবিরের এই একচ্ছত্র জয়ে দেশে জামায়াতের কর্মীদের মাঝে মনোবল আরো পোক্ত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে৷
‘‘আপনি একে ঐতিহাসিক পালাবদল বলতে পারেন,'' ডয়চে ভেলেকে বলেন রাজনীতি বিশ্লেষক আলতাফ পারভেজ৷
তিনি বলেন, এই পরিবর্তন এক দিনে ঘটেনি, ধীরে ধীরে ঘটেছে৷
ডাকসু নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে জামায়াতের অবস্থানের কারণে শিবিরকে প্রত্যাখ্যানের যে আহ্বান জানানো হয়েছিল অন্য প্রার্থী বা জোটের পক্ষ থেকে, তা তেমন কাজ করেনি বলে মনে করেন আলতাফ পারভেজ৷
তিনি বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক আচরণের ঠিক বিপরীত দিকে হেঁটেছে৷''
ইসলামপন্থি শিবিরগুলোর প্রতি সমাজে সমর্থন বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি৷ তবে এই পরিবর্তন আগের কর্তৃত্ববাদের চেয়ে ভিন্ন বলে মনে করেন তিনি৷
‘‘এক ধরনের কর্তৃত্ববাদ থেকে আরেক ধরনের কর্তৃত্ববাদে আছি আমরা৷ তবে এখনকার কর্তৃত্ববাদ ভিন্ন৷ এখন কর্তৃত্ববাদীরা সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে প্রভাব ফেলছে,''
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আন্দোলনকারীদের মধ্যে হতাশা
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আন্দোলনকারীদের যে প্রত্যাশা ছিলো সেই প্রত্যাশা কতটা পূরণ হয়েছে? নতুন যে বাংর্লাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন তারা, সেই স্বপ্ন কী পূরণ হয়েছে? জানতে দেখুন এই ছবিঘরটি৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
উমামা ফাতেমা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র
‘‘জুলাই আন্দোলনের সময় একটা পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলাম, এ দেশটা স্বাধীন হবে, দেশটা এক ধরনের পরিবর্তন এর মধ্য দিয়ে যাবে৷ আমরা ওই সময় নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন রাজনৈতিক রূপান্তরের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সে রূপান্তরের স্বপ্নটা আমরা এখনো বাস্তবায়িত হতে দেখিনি, আমি আশাবাদী আমাদের যে জনগণ অভ্যুত্থান করেছে সে জনগণ অবশ্যই সংগঠিতভাবে সামনের দিনে পরিবর্তনগুলো আনবে৷’’
ছবি: DW
অধ্যাপক তাসনীম সিরাজ মাহবুব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী
আন্দোলনে প্রত্যাশা ছিল স্বৈরাচারের অবসান, বাকস্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, কিন্তু বাস্তবে পাওয়া গেল স্বজনপ্রীতি, স্বচ্ছতার অভাব এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা৷ আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডও প্রত্যাশাকে ক্ষুণ্ণ করেছে৷ আরেকটা কথা যেটা না বললেই নয় সেটা হলো এখনো পরিস্থিতি উন্নয়নের সুযোগ আছে যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সচেষ্ট হয৷ সেটা করতে হলে সবার আগে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে৷
ছবি: DW
হাসান রোবায়েত,কবি
একটা ইনসাফভিত্তিক, ভয়ডরহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রত্যাশা ছিল৷ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং আচরণের মধ্যে দিয়েই এসব পূরণ হবে৷ তার কিছু নমুনাও শুরু হয়েছে৷
ছবি: DW
আদিবা সায়মা খান, শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অভ্যুত্থানে নারীরা রাজপথে নেমেছিলাম নাগরিক হিসাবে৷ একটি বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্রের জন্য আন্দোলনে নেমেছিল, যেখানে প্রশাসনিক সংস্কার হবে, মেধাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে এবং নিরাপদ রাষ্ট্র হবে৷ কিন্তু আমরা প্রত্যাশার কোন কিছুই তেমন দেখতে পাচ্ছি না৷ জাতীয় নিরাপত্তা নেই৷ নারীরা হয়রানির শিকার হচ্ছে৷ খুনিদের শাস্তি হয়নি৷ এমনকি ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলাকারীদেরও দৃষ্টান্তমূলক কোন শাস্তি হয়নি৷
ছবি: DW
ইসরাত জাহান ইমু, শিক্ষার্থী ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জুলাইয়ের ১৭ তারিখ পর্যন্ত কোটার সংস্কার ছাড়া আন্দোলনে অন্য কোনো প্রত্যাশা ছিলো না৷ পরে যখন আমরা আন্দোলন করি তখন আমাদের প্রত্যাশা ছিল আওয়ামী লীগ যে দমন-পীড়নমূলক কাঠামো তৈরি করে গিয়েছে সেটা ভেঙে নতুন ব্যবস্থা তৈরি হবে৷ কিন্তু পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের জায়গা দখল করেছে অন্য শক্তি৷ আমরা ভেবেছিলাম যে নতুন যে রাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরি হবে সেখানে নারীদের নিরাপত্তা বা নারীদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা হবে৷
ছবি: DW
সাবরিনা আফরোজ সেবন্তি, শহীদ মাহামুদুর রহমান সৈকতের বোন
‘‘জুলাই আন্দোলনে প্রত্যাশা ছিল একটা নতুন বৈষম্যহীন বাংলাদেশ পাব৷ নতুন যে সরকার আসবে সে কোন অন্যায় মেনে নেবে না, একটা বিপ্লবী ভূমিকা পালন করবে কিন্তু দুঃখজনকভাবে সে প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না৷’’
ছবি: DW
সরদার নাদিম মাহমুদ শুভ, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সমন্বয়ক
আমাদের আকাঙ্খা ছিলো ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার পতন, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত৷ চাওয়া ছিল রাজনৈতিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও বাকস্বাধীনতার নিশ্চয়তা৷ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের দলীয়করণ বন্ধসহ সব প্রতিষ্ঠানকে নিরপেক্ষকরণ ও শিক্ষাব্যবস্থাকে কর্মমুখী করা৷ কিন্তু সত্য যে গণঅভ্যুত্থানের পর এই সরকার জনগণের চাওয়া পূরণ করতে পারেনি৷ তারা আমাদের যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখিয়েছিল তা প্রায় দিবাস্বপ্ন রয়ে গেছে৷
ছবি: DW
বেলাল হোসেন, আন্দোলনে আহত
‘‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম দেশকে ফ্যাসিবাদ মুক্ত করতে৷ কিন্তু বাংলাদেশে এখনো ফ্যাসিবাদ রয়ে গেছে৷ আমরা যারা জুলাই আন্দোলনে আহত তাদের জুলাই সনদপত্র এখনো পর্যন্ত দেওয়া হয়নি৷ আগে গাড়ি চালাতাম৷ এখন আমার একটা চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সেই কাজ করতে পারি না৷ আগস্টের পরে অনেকেই অনেক আশ্বাস দিয়েছিল তার একটাও বাস্তবায়ন হয় নাই৷’’
ছবি: DW
ফারহানা শারমিন শুচি, উদ্যোক্তা
‘‘জুলাই আন্দোলনে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিলো অন্যায় ও দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ, বৈষম্যহীন, এবং বিদেশি আধিপত্যবিহীন একটা সমাজ এবং রাষ্ট্র, যেখানে দেশের আপামর জনসাধারণ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে তাদের প্রাপ্য সব মৌলিক অধিকার সমানভাবে ভোগ করবে৷ রাষ্ট্র বিভিন্ন রকম সংস্কার এবং তার সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের সেই অধিকার নিশ্চিত করবে৷ সত্যিকার অর্থে সে প্রত্যাশার কিছুই পূরণ হয়নি৷’’
ছবি: DW
9 ছবি1 | 9
জাতীয় নির্বাচনের লিটমাস টেস্ট?
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে করার ঘোষণা দিয়েছেন৷
এর আগে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন ঘোষণার পর থেকেই দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রতি গভীর আগ্রহ দেখিয়েছে, একে জাতীয় নির্বাচনের আগে জনমতের একটি পরীক্ষামূলক মাপকাঠি হিসেবে দেখছে৷
ছাত্র সংসদে পরপর দুটি বড় জয়ের পরজামায়াতে ইসলামী উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে এবং জাতীয় নির্বাচনেও ভালো ফলাফল করার আশা ব্যক্ত করেছে৷
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে একটি আসনও না জেতা বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল বলেছে, তাদের খারাপ ফল জাতীয় নির্বাচনে প্রতিফলিত হবে না৷
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রুখসানা খন্দকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি মনে করি না এর প্রতিফলন জাতীয় নির্বাচনে হবে৷ আপনি যদি ইতিহাস দেখেন, তাহলে দেখবেন ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সবসময়ই ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ভোট পড়েছে বেশি৷ ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা শীর্ষ পদে হেরে গিয়েছে৷''
তবে তিনি এই ফলাফলকে একেবারে উপেক্ষা করা ঠিক হবে না বলেও মনে করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এই ফলাফল সমাজে একটি ‘পারসেপশন' বা ধারণা তৈরি করে, যার প্রভাব নির্বাচনে পড়তে পারে৷ আর এখন তো একটি বিশেষ পরিস্থিতি বিরাজ করছে৷''
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলতাফ পারভেজ মনে করেন, এই ফলাফলের একটা সাধারণ কারণ আছে৷ তিনি বলেন, ‘‘এটি পরিষ্কার যে, ইসলামপন্থিদের প্রতি সমর্থন সমাজে বেড়েছে৷ এর ফলাফল আপনি জামায়াত বা অন্য দলগুলোর উত্থানের মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছেন৷''
বিজ্ঞাপন
যুবসমাজ ও নির্বাচনের হিসেব-নিকেশ
বাংলাদেশের ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী তাদের সর্বোচ্চ ভোট শেয়ার পেয়েছিল, যা প্রায় ১২%৷ এরপর থেকে তাদের সমর্থন হ্রাস পেয়েছে৷ ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে মাত্র ৪.৭%-এ নেমে আসে৷ এটাই ছিল জামায়াতের শেষ নির্বাচনি অংশগ্রহণ৷
এরপর থেকে তারা নির্বাচনি প্রক্রিয়ার বাইরে ছিল৷
দক্ষিণ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং সানেম-এর একটি সাম্প্রতিক জাতীয় যুব জরিপে দেখা গেছে যে, ৩৫ বছরের নিচের প্রায় ২২% ভোটার এখন জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক, আর ৩৯% বিএনপিকে সমর্থন করে৷
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের গড় বয়স মাত্র ২৬ এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য অনুযায়ী. দেশের এক-চতুর্থাংশ মানুষ ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সি৷ এর ফলে তরুণ ভোটাররা ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের ফল নির্ধারণে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে৷
সানেম-এর হিসাব অনুযায়ী প্রায় অর্ধেক তরুণ ভোটার এখনও সিদ্ধান্তহীন—যা আগামী মাসগুলোতে রাজনৈতিক শক্তির পুনর্বিন্যাসের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করছে৷
রোকসানা বলেন, ‘‘আমরা ছোট আকারে কিছু জরিপ করে দেখেছি৷ মানুষ আসলে এখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভূগছেন৷''