1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশে দায় স্বীকার ও ক্ষমা প্রার্থনার সংস্কৃতি

১২ জুলাই ২০২৫

বিশ্বের বহু দেশে ব্যর্থতা, ভুল বা অন্যায়ের দায় স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনার পর দায়িত্বশীলদের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার নজির রয়েছে। বাংলাদেশে এমন নজির কি আছে?

জাতীয় স্মৃতিসৌধ৷ ফাইল ফটো ছবি: Munir Uz Zaman/AFP

দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা তো ঘটেইনি, যদিও কেউ ক্ষমা প্রার্থনা করেন, তার মধ্যে ‘যদি, তবে, কিন্তু' ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারের প্রবণতাও দেখা যায়। এতে তিনি যে নির্দোষ সেটাই বোঝানোর চেষ্টা থাকে। ফলে বাস্তবিক অর্থেই যে কারণে তিনি ক্ষমা চাচ্ছেন, সেটা নি:শর্ত হয় না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এর জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নিজেদের হীনমন্যতাকেই দায়ী করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমাদের সমাজে, রাষ্ট্রে জবাবদিহিতা নেই। এটা প্রধানত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে থাকার কথা। যদি একটা সংসদীয় ব্যবস্থা থাকে, তাহলেও একটা জবাবদিহিতা থাকে। সেখানে প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে হয়। তাদের বিরোধী দলের মুখোমুখি হতে হয়। আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তাতে রাজনীতি অন্য সবকিছুর উপর প্রাধান্য বিস্তার করে। এই রাজনীতিতে একক দলীয় শাসন-ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এখানে যারাই ক্ষমতায় যায়, তারাই ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার চেষ্টা করে। তারা ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। গণতান্ত্রিক মনোভাব আমাদের সমাজে গড়ে ওঠেনি।”

ক্ষমা চায়নি আওয়ামী লীগ

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালানোর ঘটনায় রাজনৈতিক মহল এবং নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে থেকে আওয়ামী লীগের ক্ষমা চাওয়ার কথা বার বার উঠে এসেছে৷  কিন্তু এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে দলটির পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য আসেনি৷ তবে সরাসরি ক্ষমা না চাইলেও দলটির কোনো কোনো নেতা বিভিন্ন মাধ্যমে এ বিষয়ে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন৷

দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বিদেশ থেকে এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, ‘‘ভুল করে থাকলে আওয়ামী লীগ জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে প্রস্তুত।'' আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে শেয়ার করা এক পোস্টে নাছিম এ কথা বলেন।

তিনি বলেন, ‘‘প্রকৃতপক্ষেই আমরা যদি ভুল করে থাকি, অথবা অন্যায় করে থাকি, সেই অন্যায়ের জন্য জাতির কাছে ক্ষমতা চাইতে আমাদের কোনো আপত্তি অথবা আমরা ক্ষমা চাইব না—এ ধরনের গোঁড়ামি আমাদের ভেতরে কাজ করে না। এ ধরনের দল, এই মানসিকতার দল আওয়ামী লীগ নয়।’’

বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘‘অনুশোচনা কি কারাগারের ভেতরে বসে করবে আওয়ামী লীগ? কীভাবে করবে? ভুলের জন্য জাতির কাছে আমরা এই এই ভুল করেছি প্রকাশ করেই আমরা জাতির কাছে ভুলগুলো শোধরানোর পথ দেখাব।''

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের হতাহতের বিষয়ে আওয়ামী লীগ জাতির কাছে ক্ষমা চাইবে কি না প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ এ আরাফাত কিছুদিন আগে ডয়চে ভেলেকে বলেন, "৫ আগস্টের পর যত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সেগুলোর পর কি তারা ক্ষমা চাইবে? তোফাজ্জল, মাসুদ ও রাজীব হত্যাকাণ্ডের জন্য কি তারা ক্ষমা চাইবে? আমি এর আগেও বলেছি, আমরা ক্ষমতায় থাকার সময় যে ঘটনাই হয়েছে তার একটা দায় আমাদের আছে; কারণ আমরা সরকারে ছিলাম। এই দায় আমরা স্বীকার করেছি৷’’

গণতান্ত্রিক মনোভাব আমাদের সমাজে গড়ে ওঠেনি: অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

This browser does not support the audio element.

আওয়ামী লীগের এই দুই নেতার বক্তব্যের মধ্যেও ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি পরিষ্কার নয়। তারাও তবু, কিন্ত'র মধ্যে আটকে আছেন। ফলে ক্ষমা চাওয়ার যে সংস্কৃতি সেটা তারাও শুরু করতে পারেনি। বরং এই হত্যাযজ্ঞের দায় তারা নানাভাবে এড়ানোর চেষ্টা করছে।

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম দলটির বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত রেখেছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

সাম্প্রতিককালে দায় স্বীকারের কিছু নজির

সর্বশেষ গত ২৫ জুন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, "শুধু একাত্তর নয়, ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমাদের দ্বারা যত মানুষ কষ্ট পেয়েছেন, কেউ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন, সেই সকল মানুষের কাছে, মানুষগুলো তাদের সকলের কাছে আমি বিনা শর্তে ক্ষমা চাচ্ছি। ব্যক্তি হিসেবে মানুষ যেমন ভুল করতে পারে, মানুষের সমষ্টি একটি দলেরও ভুল সিদ্ধান্ত থাকতে পারে। কোনটা ভুল, কোনটা সঠিক- সেটা ইতিহাস নির্ধারণ করবে। আজকে যেটাকে ভুল বলা হচ্ছে, কাল সেটাই হয়তো সবচেয়ে বড় সঠিক হিসেবে প্রমাণিত হবে। আমরা আদর্শবাদী একটা দল। আমরা বিশ্বাস করি, আমরা মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নই। আমাদের দ্বারা, আমাদের সহকর্মীদের দ্বারা মানুষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কষ্ট পেতে পারে, ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আমি সবকিছুর জন্য কোনো শর্ত আরোপ না করেই মাফ চাচ্ছি। মাফ চাওয়ার মধ্যে কোনো পরাজয় নেই, লজ্জা নেই।”

তবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের এই ক্ষমা প্রার্থনার মাঝেও ‘যদি' আছে। অর্থাৎ, তিনি বলেছেন, ‘‘যদি কেউ কষ্ট পেয়ে থাকেন...।’’ ফলে এই ক্ষমা প্রার্থনা ‘যদিতে' আটকে গেছে। এখানে তিনি জামায়াতের একাত্তরের ভুমিকার কথা উল্লেখ করেননি।

কিছুদিন আগে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-এর মহাপরিচালক অতীত অপরাধের জন্য নির্যাতিত ব্যক্তি ও জুলাই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের শিকার পরিবারের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি স্বীকার করেছেন যে, র‌্যাবের গোপন বন্দিশালা বা ‘আয়নাঘর' ছিল। তিনি বলেন, "র‌্যাব সৃষ্টির পর থেকে যারা র‌্যাব দ্বারা নির্যাতিত বা অত্যাচারিত হয়েছেন, তাদের কাছে এবং নারায়ণগঞ্জের সাত খুনসহ যারা র‌্যাবের দ্বারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তাদের পরিবারের কাছে আমরা দুঃখ প্রকাশ এবং ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”

এর কয়েকদিন আগে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের কমিশনার জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে পুলিশের ভূমিকার জন্য রাজধানীবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি বলেন, "ঢাকাবাসীর কাছে আমি জুলাই-আগস্টের ঘটনার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। আমি আশ্বস্ত করছি, সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে আগামীতে রাজধানীবাসীর সেবা করে যাবো। বিগত দিনগুলোতে হেলমেট বাহিনীর সঙ্গে মিলে পুলিশ হামলা করেছে, সেই যুগের অবসান ঘটেছে।”

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও সাবেক সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মর্তুজা বলেছেন, "আমার কাছে মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল তা পূরণ করতে না পারার দায় আমি মাথা পেতে নিচ্ছি। বিশেষ করে, মানুষের যে আবেগ-ভালোবাসার জায়গা ছিল, ক্রিকেটার মাশরাফির প্রতি যে দাবি ছিল, সেটা পূরণ করতে পারিনি এবং সেই দায় মাথা পেতেই নিচ্ছি। আমি ব্যর্থ হয়েছি এবং সেটা আমাকে সেই শুরু থেকেই পোড়াচ্ছে। রাজনীতিবিদ হিসেবে আমি কিছু করার চেষ্টা করেছি। পারিনি।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটা দেশ পেয়েছি। তারপর দীর্ঘ সময় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমরা গেছি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কখনো সংস্কৃতিক পরিবর্তন হয়নি। চীনেও কিন্তু বিপ্লব হয়েছে। কিন্তু বিপ্লবের পর বিপ্লব শেষ হয় না। এখানে বস্তুগত পরিবর্তন হলেও মনোজগতের পরিবর্তন হতে সময় লাগে। এই পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিতে হয় নেতাদের। কিন্তু আমাদের নেতারা রোল মডেল হতে পেরেছেন কিনা? একটা উদাহরণ দেই, একবার ইসরায়েলের একটি স্কুলের শিশুরা পিকনিক করতে গিয়ে ১১ জন শিশু সীমান্ত অতিক্রম করে জর্ডানে ঢুকে পড়ে। তখন সীমান্তরক্ষীরা তাদের গুলি করে হত্যা করে। তখন জর্ডানের বাদশা দেখলেন এই ঘটনার পরিণতিতে ১১শ' মানুষ বা ১১ লাখ মানুষকে হত্যা করতে পারে ইসরায়েল। তখন তিনি দ্রুত ইসরায়েলে চলে গেলেন। ওই ১১টা শিশুর বাড়িতে গিয়ে হাত জোড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। বাদশার তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে বড় ধরনের ঝামলো কিন্তু এড়ানো গেল। আসলে আমাদের মধ্যে সেই সাংস্কৃতিক জাগরণটা তৈরি হয়নি।”

ক্ষমা চায়নি পাকিস্তান

গত এপ্রিলে ঢাকায় পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ‘মহান মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার দায় স্বীকার করে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা ও স্বাধীনতা-পূর্ব অভিন্ন সম্পদের বকেয়া অর্থ দাবি' করা হয়। তখনকার পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন জানান, স্বাধীনতা-পূর্ব ক্ষতিপূরণ হিসেবে বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে ৪ দশমিক ৩২ বিলিয়ন বা ৪৩২ কোটি ডলার চেয়েছে। এছাড়া এফওসিতে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের নৃশংসতার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ও তুলেছে ঢাকা।

এর পরেরদিন পাকিস্তানের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। সেখানে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিভিন্ন দিক, গাজায় ইসরায়েলি হামলার নিন্দা, এমনকি জম্মু ও কাশ্মির ‘ভারতের অবৈধ দখলে' রয়েছে দাবি করে এর সমাধানের মতো ইস্যু নিয়ে ঢাকার বৈঠকে আলোচনার কথা বলা হলেও মুক্তিযুদ্ধে ‘গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়া' কিংবা ‘বকেয়া অর্থের' বিষয়ে কিছু নেই ওই বিজ্ঞপ্তিতে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচের সঙ্গে বৈঠক শেষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব জসীম উদ্দিন জানিয়েছিলেন, আলোচনায় অমীমাংসিত বিষয়ের মধ্যে ছিল, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন, অবিভক্ত সম্পদের সুষম বণ্টন, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রেরিত বৈদেশিক সাহায্য তহবিল হস্তান্তর এবং ১৯৭১ সালে তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে জনসমক্ষে ক্ষমা চাওয়া।

এসব ইস্যুতে একটি শব্দও ব্যয় করেনি পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে অতীতের ইস্যুর চেয়ে ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দিকেই বেশি নজর দিয়েছে ইসলামাবাদ। তাদের ভাষ্য, দেশ দুটির সাংস্কৃতিক সম্পর্ক এবং অভিন্ন ইতিহাস ও জন-আকাঙ্খার কথা এসেছে আলোচনায়। গত বছরের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশ দুটির মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন করে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা দৃশ্যমান হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৬ এপ্রিল ঢাকায় আসেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পলিটিক্যাল কালচারটা দীর্ঘদিনে গড়ে ওঠে। আমরা যারা স্বাধীন হয়েছি, তাদের মধ্যে এক ধরনের সুসম্পর্ক থাকতে পারতো। কিন্তু দেখেন ভারত, পাকিস্তান বা বাংলাদেশ তো এক সময় একটা দেশই ছিল। এরপর ভাগ হয়েছে। কিন্তু এখানে কি সুসম্পর্ক আছে? এখানে এক ধরনের দাম্ভিকতা আমরা দেখি। আমাদের দেশটা কিন্তু স্বাধীন হয়েছে ৩০ লাখ শহীদ এবং ২ থেকে ৬ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে। দেশের যেটা ভিত্তি, সেটাকেই যদি আপনি প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেন, তাহলে সংস্কৃতি বদলাবে কিভাবে? ১৯৭১ সালে ২ থেকে ৬ লাখ নারী নির্যাতিত হয়েছে, এটা নিয়ে আমি নিজে গবেষণা করেছি। এখন সেটা অস্বীকার করা হচ্ছে, আমরা ভুলে যাচ্ছি। তাহলে আপনি কিভাবে আশা করেন যে, একটা সুস্থ, স্বাভাবিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠবে?”

ক্ষমা প্রার্থনা ও দায় স্বীকারের কিছু নজির

সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন করোনাভাইরাস মহামারির লকডাউনের মধ্যেই ২০২০ সালের মে মাসে নিজের সরকারি বাসায় সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি মদ্যপানের পার্টি আয়োজন করেছিলেন। তিনি উক্ত ঘটনা নিয়ে বিরোধীদের পদত্যাগ দাবি ও প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে ‘আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা' করেন। পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, তার ও সরকারের ওপর সমালোচকদের ক্ষোভের বিষয়টি বোধগম্য। কারণ, তিনি মনে করেন, যে ডাউনিং স্ট্রিটে নিয়মগুলো যারা তৈরি করে, তারাই সেগুলো সঠিকভাবে মেনে চলে না এবং এটা হতে পারে না।

দেশের ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করলে সংস্কৃতি বদলাবে কীভাবে: অধ্যাপক ড. জিনাত

This browser does not support the audio element.

১৯৫৬ সালে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে এক রেল দুর্ঘটনায় ১১২ জন যাত্রী মারা যান। তৎকালীন রেলমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী এ দুর্ঘটনার দায় স্বীকার করে সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বিস্মিত হয়ে বলেন, ‘‘দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। কিন্তু পদত্যাগ করতে হবে কেন?'' তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি। কিন্তু এ ঘটনার তিন মাস পরে তামিলনাড়ুতে আবার একটি রেল দুর্ঘটনা ঘটে। তখন ১৪৪ জন যাত্রী মারা যান। বিবেকের দংশন থেকে ঘটনার দায় মাথায় নিয়ে লালবাহাদুর শাস্ত্রী আবার পদত্যাগ করেন। এবার প্রধানমন্ত্রী নেহরু পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। তখন সংসদে বিবৃতি দিয়ে নেহরু বলেছিলেন, ‘‘যদিও তিনি পদত্যাগ করেছেন, এবং আমরা তা গ্রহণ করেছি, এর মানে এ নয় যে মিস্টার শাস্ত্রী তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। পদত্যাগপত্র এ কারণে গ্রহণ করা হয়েছে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে ও শিখতে পারে, তিনি সংবিধান, গণতন্ত্র ও দায়িত্বের প্রতি কতটা সৎ এবং নিবেদিত ছিলেন।''

গত বছরের ১৯ জানুয়ারি নরওয়ের গবেষণা ও উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী স্নাতকোত্তরের গবেষণামূলক প্রবন্ধে অন্যের গবেষণা ‘চুরি' করার কথা স্বীকার করে পদত্যাগ করেছিলেন। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে গ্রিসের অবকাঠামো ও পরিবহণমন্ত্রী ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার দায় নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। একইভাবে নেদারল্যান্ডসের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মিথ্যা বলার দায় নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন।

জার্মান সরকার ২০২১ সালের মে মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নেয় যে নামিবিয়ায় তাদের ঔপনিবেশিক শাসনের সময় সেখানে গণহত্যা চালানো হয়েছিল। নামিবিয়ার জনগণ এবং গণহত্যার শিকার মানুষদের উত্তরসূরিদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে জার্মান সরকার। ওই অপরাধের ক্ষতিপূরণও দিয়েছে জার্মান সরকার। জার্মানির প্রেসিডেন্ট নামিবিয়া গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নামিবিয়ার জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থণা করেন। সারা বিশ্বে এমন অসংখ্য ক্ষমা প্রার্থনা করে দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার নজির থাকলেও বাংলাদেশে উদাহরণ সৃষ্টি হয়নি।

দায় স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা কি দুর্বলতা?

কেউ ভুল করলে তা স্বীকার করে নেওয়া কি দুর্বলতা? অনেকেই মনে করেন ‘‘ভুল করেছি তাতে কী; বরং স্বীকার করলে দুর্বলতাই প্রকাশ করা হলো।'' যুক্তি তোলেন বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটে ভুল স্বীকার করা মানেই দুর্বলতা, এমন ধারণা আমাদের সমাজে প্রচলিত। গবেষকরা বলছেন, ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়া নেতার সদগুণ। জার্নাল অব বিজনেস এথিকস-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, "অন্তর থেকে ক্ষমাপ্রার্থনা বিনয়ের প্রকাশ হলেও বিশেষ করে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে, এমন ভুল স্বীকার করা দীর্ঘমেয়াদী ও স্থায়ী সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য খুব প্রয়োজনীয়।”

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমাদের সমাজে যেটা প্রচলন রয়েছে, কেউ ক্ষমা চাওয়া মানে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা মনে করেন, তিনি ক্ষমা চাইলে দলের কর্মীদের কাছে ছোট হয়ে যাবেন। ফলে তিনি যে ভুলটা করেছেন, সেটার পক্ষেই দলের লোকজন বলতে থাকেন। অথচ রাজনৈতিক নেতারা যদিও সেই অবস্থার পরিবর্তন করেন, তাহলে পরিস্থিতি পাল্টাতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আসলে ক্ষমা চাওয়া বা ব্যর্থতা স্বীকার করার সংস্কৃতিই এখানে তৈরি হয়নি। এর কারণ হলো, আমাদের এখানে এখনো মনে করা হয়, ভুল হয়েছে এটা স্বীকার করলে বা ক্ষমা চাইলে তিনি ছোট হয়ে যাবেন। তার গ্রহণযোগ্যতা বা রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে যাবে, কর্ম-সমর্থকদের কাছে তিনি ছোট হয়ে যাবেন, বিরোধীদের কাছেও তিনি ছোট হয়ে যাবেন। তারপরও কেউ কেউ যে ক্ষমা চাননি তা নয়। কিন্তু তার মধ্যে ‘যদি', ‘কিন্তু' শর্ত থাকে। ফলে তিনি এমনভাবে ক্ষমা চান যে, তিনি যে নির্দোষ সেটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। আমরা এখন যে নতুন বন্দোবস্তের দিকে যাচ্ছি, সেখানে যদি সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্রের চর্চাটা করা সম্ভব হয়, তাহলে আস্তে আস্তে হয়ত পরিস্থিতি বদলাতে পারে।”

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ