বাংলাদেশের সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা' আছে৷ কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে, নেতা-কর্মীর বক্তব্যেও আছে ধর্মনিরপেক্ষতা৷ তবে স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটিতে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিনিয়ত হুমকির মুখোমুখি৷
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি জাতিসংঘের ‘ধর্ম অথবা বিশ্বাসের স্বাধীনতা বিষয়ক বিশেষ দূত' হাইনার বিলেনফেল্ড বলেছেন, ‘‘ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদ বাড়ছে৷ তাছাড়া এ দেশের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ হলেও সকল আইন ধর্মনিরপেক্ষ নয়৷ তবে সংবিধানের ৩৯ ও ৪১ ধারা অনুযায়ী সকলেরই এখানে ধর্ম পালনের স্বাধীনতা রয়েছে৷''
সেপ্টেম্বর মাসে সফর করেছেন হাইনার বিলেনফেল্ড৷ ৯ দিনের সফরে দেশের বেশ কিছু অঞ্চল ঘুরে দেখেছেন তিনি৷ সফর শেষে হাইনার বিলেনফেল্ড সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘এদেশে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষ ছাড়াও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধর্মীয় জনগোষ্ঠীও রয়েছে৷ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মাঝেও রয়েছে আহমাদিয়ার মতো জনগোষ্ঠী৷ এমন ক্ষুদ্র ধর্মীয় জনগোষ্ঠীগুলোর ধর্মপালনের অধিকার নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব৷''
কিন্তু সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা' থাকলেও বাংলাদেশে প্রায়ই ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মপালন করতে পারেননা৷ হিন্দু এবং বৌদ্ধমন্দিরে হামলার ঘটনা মোটেই বিরল নয়৷ হিন্দুদের ঘর এবং মন্দিরে হামলার ঘটনা কোথাও-না-কোথাও নিয়মিত বিরতিতেই ঘটে৷ কোনো হামলারই সুষ্ঠু তদন্ত এবং দোষীদের শাস্তি হয়না৷ বৌদ্ধমন্দিরেও হামলা হয়৷ ২০১২ সালে এক বৌদ্ধ তরুণ ফেসবুকে ‘ইসলামের অবমাননা করেছেন'-এমন খবর ছড়িয়ে দিয়ে কক্সবাজার জেলার রামুতে বৌদ্ধদের মন্দির ও বাড়িঘরে ব্যাপক হামলা চালানো হয়৷ যাঁর বিরুদ্ধে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে হামলা চালানো হয়েছিল, সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী সেই তরুণ এখনো নিখোঁজ৷
মালোপাড়ার হিন্দুদের কান্না থামেনি
বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেয়াকে ঘিরে যশোরের অভয়নগর উপজেলার মালোপাড়ায় ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার পাশাপাশি লুটপাটও করা হয়৷
ছবি: DW
নেই নিরাপত্তাকর্মীর সাড়া
যশোরের অভয়নগরের চাপাতলী গ্রামের প্রবেশপথে পুলিশের সতর্ক অবস্থান৷ গত ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের দিন এই গ্রামের নিম্নবর্ণের হিন্দু অধ্যুষিত মালোপাড়ায় বসবাসরতদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে৷ আক্রান্তরা জানান, ঘটনাস্থলের মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে থানার অবস্থান হলেও অনেক ফোন করেও সে সময়ে পুলিশ কিংবা কোনো নিরাপত্তাকর্মীর সাড়া মেলেনি৷
ছবি: DW
‘নদী ঠাকুর’
দুর্বৃত্তদের হামালায় লণ্ডভণ্ড মায়া রানি বিশ্বাসের একমাত্র মাথা গোঁজার ছোট্ট নিবাস৷ সেদিন হামলা শুরু হলে পাশের বুড়ি ভৈরব নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ওপারে উঠে প্রাণে বেঁচে যান বিধবা এই নারী৷ তাঁর ভাষায় ‘নদী ঠাকুর’ সেদিন না থাকলে জানটা হয়ত থাকতো না৷
ছবি: DW
প্রাণ বাঁচাতে নদীতে
নিজের ঘরের ভাঙা আসবাব, টেলিভিশনের পাশে মালোপাড়ার গৃহবধু উজ্জ্বলা বিশ্বাস৷ হামলাকারীদের ভয়াবহ রূপ সামান্য দেখেছিলেন তিনি৷ প্রাণ বাঁচাতে তিনিও ঝাঁপ দেন বুড়ি ভৈরবে৷ হামলার সময়ে তাঁর মনে হয়েছিল যে ভগবান সেদিন পাশে ছিলেন না৷
ছবি: DW
বই-পত্র পুড়িয়ে দিয়েছে
কলেজ পড়ুয়া মঙ্গলা বিশ্বাসের বই-পত্র, এমনকি সার্টিফিকেটও পুড়িয়ে দিয়েছে হামলাকারীরা৷
ছবি: DW
সুন্দর স্বপ্নে চির
হামলাকারীদের ভেঙে দেয়া আয়নায় কলেজ পড়ুয়া মঙ্গলা বিশ্বাসের প্রতিবিম্ব৷ বাড়ির দেয়ালে টাঙানো এই ভাঙা আয়নার মতোই মঙ্গলার সুন্দর স্বপ্নেও চির ধরিয়েছে হামলাকারীরা৷ মঙ্গলার আক্ষেপ, তাঁর বই-পত্র আর সার্টিফিকেট কী দোষ করলো?
ছবি: DW
আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয়
হামলার ছয় দিন পরে এঁরা ফিরছেন বাড়িতে৷ হামলার সময় পার্শ্ববর্তী গ্রামে আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁরা৷
ছবি: DW
হামলার প্রত্যক্ষদর্শী
৮৬ বছর বয়সি মৃত্যুঞ্জয় সরকার সেদিনের হামলার প্রত্যক্ষদর্শী৷ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও দেশ ছাড়েননি তিনি৷ কিন্তু হামলার পর তাঁর মনে হচ্ছিল যে, সে সময়ে ছেড়ে যাওয়াটাই উচিত ছিল তাঁর৷
ছবি: DW
গাছও রেহাই পায়নি
বাড়ি-ঘরের পাশাপাশি মালোপাড়ার গাছও জ্বালিয়ে দিয়েছিল দুর্বৃত্তরা৷
ছবি: DW
পলাতক জামায়াত নেতা
মালোপাড়ায় হামলার পরে চাপাতলী গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম বালিয়াডাঙ্গায় স্থানীয় জামায়াতে ইসলামীর থানা আমীর মাওলানা আব্দুল আজিজের বাড়ি ভাঙচুর করে যৌথবাহিনী৷ ঘটনার আগে থেকেই পলাতক রয়েছেন এ জামায়াত নেতা৷
ছবি: DW
আক্রান্তদের অভিযোগ
জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আব্দুল ওহাব৷ মালোপাড়ায় সাম্প্রদায়িক হামলার জন্য জামায়াত শিবির ছাড়াও স্থানীয় আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলকেও দায়ী করেছেন অনেকে৷ সাবেক এই সাংসদ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়েছেন৷ সেখানে নতুন প্রার্থী হিসেবে রণজিৎ রায় মনোনয়ন পাওয়ায় এই দুই জনের সমর্থকদের মাঝে বেশ উত্তেজনা ছিল পুরো নির্বাচনের সময়টায়৷
ছবি: DW
গণধর্ষণ
যশোরের আরেক ভয়াল জনপদ মনিরামপুর উপজেলার হাজরাইল গ্রামের দাসপাড়ার বাসিন্দা অনারতী দাস৷ ৭ জানুয়ারি রাতে তাঁর সামনেই অস্ত্রের মুখে একদল দুবৃত্ত গণধর্ষণ করে পুত্রবধু মনিমালা দাস আর ভাতিজি রূপালী দাসকে৷
ছবি: DW
ভয়াবহ দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী
কার্তিক দাসকেও সেদিন রাতে সেই ভয়াবহ দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী হতে হয়েছিল৷ দাসপাড়ায় গণধর্ষণের শিকার নিম্নবর্ণের হিন্দু মনিমালা দাসের শ্বশুর ও রূপালী দাসের চাচা তিনি৷
ছবি: DW
বাড়িঘর ছেড়েছেন
দাসপাড়ায় গণধর্ষণের শিকার হওয়া পরিবার দুটি আতঙ্কে বাড়িঘর ছেড়েছেন৷
ছবি: DW
শুধুই আতঙ্ক
দাসপাড়ার এক নারী৷ দাসপাড়ার নারীদের এখন নির্ঘুম রাত কাটে আতঙ্কে৷
ছবি: DW
14 ছবি1 | 14
বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দুদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমছে৷ ১৯৭১ সালে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর ধর্মীয় সংখ্যালঘু মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশের মতো ছিল৷ এখন সে সংখ্যা প্রায় ১০ শতাংশে নেমে এসেছে৷
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পরই বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাবিরোধীতা প্রকাশ্যে ব্যাপক মাত্রা পায়৷ পরবর্তীতে সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা' বাদ দেয়া হয়৷ প্রস্তাবনার পূর্বে ‘বিসমিল্লাহির-রাহমানির রাহিম' রেখে ‘ইসলাম'-কে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দেয়া হয়৷ ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফেরা বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে সংশোধনী এনে সংবিধানে আবার ‘ধর্মনিরপেক্ষতা'-কে ফিরিয়ে আনে৷ কিন্তু সংবিধানে সকল ধর্মের সমান অধিকারের কথা বলা হলেও ইসলামকেই রাষ্ট্র ধর্মের স্বীকৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন৷''
আপনিও কি কিছু বলতে চান? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷