ধর্ষণ বাড়ছে বাংলাদেশে৷ বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিবেদন এবং পুলিশের তথ্যে তার প্রমাণ মিলছে৷ বিশ্লেষকরা বলছেন এর জন্য আইনের প্রয়োগে ঢিলেমি এবং সামাজিক অবস্থা কাজ করছে৷
বিজ্ঞাপন
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) সারা দেশ থেকে গড়ে প্রতিদিনই গড়ে চার-পাঁচজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে চিকিত্সা নিতে আসছেন৷ আর প্রতিমাসে দেড় থেকে দুই শতাধিক ধর্ষিতাকে চিকিত্সা দিচ্ছেন তারা৷ এই হিসাব হচ্ছে যারা ওসিসিতে চিকিত্সা নিতে আসেন তাদের৷ এছাড়া দেশের অন্যান্য হাসপাতাল এবং চিকিত্সা কেন্দ্রে যারা চিকিত্সা নেন তাদের হিসাব নেই ওসিসি'র কাছে৷ চিকিত্সার বাইরে যারা থাকেন, ‘সামাজিক লজ্জায়' যারা ঘটনা প্রকাশ করেন না তাদের হিসাব পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই৷ ওসিসি'র মতে সাধারণত এর শিকার ১৮-১৯ বছর বয়সি মেয়েরা৷
আর খোদ রাজধানী ঢাকার চিত্রটি কিছুটা হলেও পাওয়া যায় পুলিশের হিসাব থেকে৷ ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৫৫৪টি মামলা হয়েছে৷ এর মধ্যে রাস্তা থেকে অপহরণ করে গাড়ির মধ্যে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মামলা রয়েছে অন্তত ৫০ ভাগ৷
বাংলাদেশের যৌনকর্মীদের কথা
পৃথিবীর আদিম এক পেশা পতিতাবৃত্তি৷ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই চালু রয়েছে এই পেশা৷ বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেমন আছেন বাংলাদেশের যৌনকর্মীরা? এই ছবিঘরে তাঁদের অবস্থা কিছুটা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images
যেভাবে যৌনপল্লীতে আগমন
বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার হয়ে যৌনপল্লীতে হাজির হন মেয়েরা৷ প্রত্যন্ত অঞ্চলের অতিদরিদ্র্য পরিবারের সদস্যরা কখনো কখনো অর্থের লোভে মেয়েদের বিক্রি করে দেন বলে জানিয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা৷ এছাড়া ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে কিংবা বিদেশ যাওয়ার লোভ দেখিয়েও মেয়েদের যৌনপল্লীতে আনা হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/Munir uz ZAMAN
যৌনকর্মীদের জন্য ‘গরুর ট্যাবলেট’
ফরিদপুরের সরকার অনুমোদিত যৌনপল্লীর ছবি এটি৷ অভিযোগ রয়েছে, পল্লীর মালিক নতুন আসা যৌনকর্মীদের স্টেরয়েড ট্যাবলেট সেবনে বাধ্য করেন, যা সাধারণত গরুকে খাওয়ানো হয়৷ গরুর স্বাস্থ্য বাড়াতে ব্যবহার করা এই ট্যাবলেট মানুষের দেহের জন্য ক্ষতিকর৷
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ‘ইনজেকশন’
বাংলাদেশের এক যৌনপল্লীর মালিক রোকেয়া জানান, স্টেরয়েড ওষুধ প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ভালো কাজে দেয়৷ কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক, বিশেষ করে ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সি মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি কার্যকর নয়৷ অপ্রাপ্তবয়সিদের স্বাস্থ্য ভালো করতে বিশেষ ধরনের ইনজেকশন ব্যবহার করা হয় বলে জানান ৫০ বছর বয়সি রোকেয়া৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/M. Candela
অধিকাংশ যৌনকর্মী ‘স্টেরয়েড আসক্ত’
আন্তর্জাতিক উন্নয়নসংস্থা একশনএইড ইউকে এক সমীক্ষার ভিত্তিতে ২০১০ সালে জানায় যে, বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ যৌনকর্মী ওরাডেক্সন বা অন্যান্য স্টেরয়েড ট্যাবলেট নিয়মিত গ্রহণ করে৷ তাঁদের গড় বয়স ১৫-৩৫ বছর৷ বাংলাদেশে দু’লাখের মতো যৌনকর্মী রয়েছে বলে ধারণা করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/M. Candela
সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ
স্টেরয়েড ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রচারণা চালাচ্ছে একশনএইড৷ সংস্থাটির বাংলাদেশ অংশের কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার জানিয়েছেন, ‘‘ওরাডেক্সন গ্রহণ করার পর শুরুতে মেয়েদের শরীরে চর্বির পরিমাণ বাড়তে থাকে৷ কিন্তু এটি নিয়মিত সেবন করলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, চামড়ায় ক্ষতসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়৷’’
ছবি: GMB Akash
এইচআইভি সংক্রমণ
বাংলাদেশে যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণ বা এইডস রোগ হওয়ার খবর মাঝে মাঝে পত্রিকায় প্রকাশ হয়৷ তবে ঠিক কতজন যৌনকর্মী এইচআইভি আক্রান্ত তার হালনাগাদ কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি৷ অনেকক্ষেত্রে কনডম ব্যবহারে খদ্দেরের অনীহা যৌনকর্মীদের মাঝে যৌনরোগ ছড়াতে সহায়ক হচ্ছে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: AP
‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ যৌনকর্মী
বাংলাদেশের যৌনপল্লীগুলোতে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের জোর করে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করানোর অভিযোগ রয়েছে৷ আর এই পেশায় যাঁরা একবার প্রবেশ করছেন, তাঁদের জীবনেও নানা ঝুঁকি থাকে৷ পতিতাপল্লীতে হামলার খবর কিন্তু মাঝেমাঝেই শোনা যায়৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
শত বছরের পুরনো পল্লী উচ্ছেদ
মাদারিপুরের পতিতাপল্লীটি ছিল শত বছরের পুরনো৷ গত বছর এই পল্লী উচ্ছেদ করেছেন স্থানীয়রা৷ এমনকি পল্লীটি জোরপূর্বক উচ্ছেদ না করার হাইকোর্টের আদেশও এক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হয়েছে৷ সেখানে পাঁচশ’র মতো যৌনকর্মী বাস করতেন৷ কিছুদিন আগে টাঙ্গাইলের একটি পতিতাপল্লীও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ এ রকম উচ্ছেদের আতঙ্কে রয়েছেন আরো অনেক যৌনকর্মী৷
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
মধ্যপ্রাচ্যে ‘যৌনদাসী’ বাংলাদেশের মেয়েরা!
বাংলাদেশের বেশ কয়েক নারীকে মধ্যপ্রাচ্যে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে৷ তাঁদের পাচার করে সিরিয়ায় নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে একাধিক বার্তাসংস্থা৷ এ সব নারীকে ফিরিয়ে আনতে সরকারি উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে৷ তবে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন পতিতালয়েও বাংলাদেশি নারীদের জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে নিয়োগ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
9 ছবি1 | 9
জাতীয় মহিলা পরিষদ সম্প্রতি একটি হিসাব প্রকাশ করেছে৷ তাদের হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ছ'মাসে সারাদেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৩১টি এবং এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮২ জন৷ এ সময়কালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৫ জনকে৷ এছাড়া ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছেন আরও ৫১ জন৷
আর জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির হিসাব অনুযায়ী ২০১১ সালে সারা দেশে ৬২০ জন, ২০১২ সালে ৮৩৬ জন, ২০১৩ সালে ৭১৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়৷ তবে অপহরণ করে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা সামপ্রতিক সময়ে অনেক বেড়েছে৷
সমিতির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, রাজধানীসহ সারা দেশেই নারী নির্যাতনের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে৷ অপহরণের পর নারীদের ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে৷ তিনি বলেন, ‘‘আইন প্রয়োগ যেমন ঠিকমত হচ্ছে না তেমনি সামাজিকভাবেও ধর্ষকদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রতিরোধ গড়ে উঠছে না৷ আর মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত বিচার হয় না অনেক মামলারই৷ কারণ শেষ পর্যন্ত নানা উপায়ে ভিকটিমকে বিরত রাখা হয়৷ সাক্ষীদের সাক্ষ্য দিতে দেয়া হয় না ৷ আর এজন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘ভিকটিম অ্যান্ড উইটনেস প্রটেকশন অ্যাক্ট' নামে নতুন একটি আইন করার কথা বললেও তা এখনো হয়নি৷
প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৬ জানুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি ইমান আলী ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের এক রায়ে, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ দেশের প্রতিটি থানায় আলাদা সেল গঠন করার নির্দেশ দেয়৷ কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি৷
আর জাতীয় মহিলা সমিতির সভানেত্রী আয়েশা খানম মনে করেন, প্রথম কাজ হল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সক্রিয় করা৷ তাঁর মতে, ধর্ষণ বিষয়ে আইনও সংশোধন করা প্রয়োজন৷ কারন ডিএনএ পরীক্ষা এবং অপরাধ প্রমাণের বোঝা এখনো ধর্ষণের শিকার নারীর ওপরই রয়ে গেছে৷
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ কমিশনার মাসুদুর রহমান এই বিষয়ে বলেন, ‘‘তারা অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিতে দেরি করেন না৷ ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়ার পর আইনি প্রক্রিয়ায় যা করতে হয় তা তারা দ্রুততার সঙ্গেই করেন৷ তাদের জন্য ঢাকা মহানগর এলাকায় ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারও আছে৷ এই সেন্টারটি পুলিশের নারী সদস্যদের দিয়েই পরিচালিত হয়৷ তদন্ত কর্মকর্তারাও নারী৷ আর থানাগুলোতে নারী ও শিশু বিষয়ক মামলা দেখার জন্য আলাদা নারী পুলিশ কর্মকর্তা আছেন৷''
তিনি বলেন, ‘‘তবে নারীদের আরো সাহসী হয়ে এগিয়ে আসতে হবে৷ অভিযোগ করতে হবে৷''