নির্বাচনকে ঘিরে দমনমূলক পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার ক্লেমা নালেতসোভি ভুলে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়েছে কমনওয়েলথ৷
বিজ্ঞাপন
ক্লেমা নালেতসোভি ভুলে শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ (সাবেক টুইটার) তার অফিশিয়াল অ্যাকাউন্টে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে একটি পোস্ট করেছেন। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং সমাবেশের স্বাধীনতার অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের এই র্যাপোর্টিয়ার বলেছেন, ‘‘রাজনৈতিক কর্মী এবং সুশীল সমাজের ওপর দমন-পীড়ন অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য আমরা বার বার আহ্বান জানিয়েছি৷ আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে যে দমনমূলক পরিবেশ তৈরি হয়েছে তাতে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন৷''
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের সুশীল সমাজ ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন বন্ধ এবং পুলিশের মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ বন্ধ করার জন্য আমার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করছি৷ নির্বাচনের আগে, চলাকালীন এবং পরে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং সংগঠন করার অধিকার এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের৷''
যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ১০ দফা মানবাধিকার সনদ দিয়েছে ৷
সংগঠনটি বৃহস্পতিবার (৪ জানুয়ারি) তাদের ওয়েবসাইটে এই ১০ দফার সনদ প্রকাশ করে৷
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল রাজনৈতিক দলের মূল পরিকল্পনায় মানবাধিকার সুরক্ষা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷ অ্যামনেস্টির ১০ দফায় আন্তর্জাতিক চুক্তির প্রতি বাংলাদেশের অঙ্গীকার অনুযায়ী দেশটির মানবাধিকার রক্ষার বাধ্যবাধকতার গুরুত্বও তুলে ধরা হয়েছে৷
বাংলাদেশের জন্য অ্যামনেস্টির দেওয়া ১০ দফা মানবাধিকার সনদের দাবি গুলোর মধ্যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা ও রক্ষা করা, প্রতিবাদ করার সুরক্ষা দেয়া, রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধান, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে দায়মুক্তির অবসান ঘটানো, নারীর অধিকার রক্ষা, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের অধিকার রক্ষা, মৃত্যুদণ্ড বিলোপ করা, জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই পদক্ষেপ নেয়া, হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতনের ক্ষেত্রে দায়মুক্তির অবসান ঘটানো, ও করপোরেট দায়বদ্ধতা এবং শ্রম অধিকার সমুন্নত রাখার কথা রয়েছে৷
কমনওয়েলথ মহাসচিব আরটি হন প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড কেসি, বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক ও নাগরিক নেতৃবৃন্দকে নাগরিকদের শান্তিপূর্ণভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশে বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন৷
তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানান৷ কমনওয়েলথ সেক্রেটারি-জেনারেল বলেন, ‘‘৭ জানুয়ারির নির্বাচনের দিকে এবং তার পরেও বাংলাদেশের প্রতি আমার নজর থাকবে৷ আমি সকল নেতা, প্রার্থী এবং দলগুলির প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি যে, তারা যেন গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং মানবাধিকার রক্ষায় কমনওয়েলথ এর মূল্যবোধকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়৷''
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে কমনওয়েলথ এর একটি বিশেষজ্ঞ দল পর্যবেক্ষক হিসেবে বাংলাদেশে এসেছে৷ বিবৃতিতে কমনওয়েলথ মহাসচিব জানান, কমনওয়েলথ সচিবালয় তাদের সদস্য রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে শক্তিশালী করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবে৷
জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কয়েক দিন ধরে গুরুত্বসহকারে সংবাদ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও৷ দ্য গার্ডিয়ান, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, আল-জাজিরার মতো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর শিরোনামেও ছিল বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে সংবাদ৷
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের খুঁটিনাটি
ভোটে আছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি৷ আর বর্জনের ডাক দিয়েছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো৷ ভোটের আগে দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে পুড়েছে যাত্রীবাহী ট্রেন, পুড়েছে ভোটকেন্দ্র, পুড়েছে ধর্মীয় উপাসনালয়ও৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ভোট ২৯৯ আসনে
শঙ্কা আর আতংকের মধ্যেই বাংলাদেশের জনগণ নিজেদের ভোটাধিকার ক্ষমতার মধ্য দিয়ে নির্বাচিত করবে সরকার৷ নওগাঁ-২ আসনে একজন প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে সেখানে ভোট স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন৷ সংসদীয় আসন ৩০০ হলেও রবিবার ভোট ২৯৯ আসনে৷
সারা দেশকে জনসংখ্যার ভিত্তিতে তিনশটি আসনে ভাগ করা হয়েছে৷ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একদিনেই সবকটি আসনে ভোট অনুষ্ঠিত হয়৷ ন্যূনতম ১৫১টি আসনে জয় পেলে এককভাবে অথবা অন্য দলের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করতে পারে রাজনৈতিক দলগুলো৷
ছবি: bdnews24.com
ভোটার সংখ্যা
নির্বাচন কমিশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২৯৯টি আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ১১ কোটি ৯৩ লাখ ৩৩ হাজার ১৫৭ জন৷ এদের মধ্যে পুরুষ ভোটার ছয় কোটি ৫ লাখ, ৯২ হাজার ১৬৯ জন৷ আর নারী হলেন পাঁচ কোটি ৮৭ লাখ ৪০ হাজার ১৪০ জন৷ আর তৃতীয় লিঙ্গের ৮৪৮ জন৷ আর নওগাঁ-২সহ তিনশটি আসনে মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৯ জন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ভোটগ্রহণ
রোববার (৭ জানুয়ারি) সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলবে একটানা ভোটগ্রহণ৷ নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ভোট যেহেতু ২৯৯টি আসনে হবে, তাই ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা কমে হয়েছে ৪২ হাজার ২৪টি৷ সবকটি কেন্দ্র মিলিয়ে ভোটকক্ষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৬০ হাজার ৮৫৮টি৷
ছবি: DW/A. Islam
প্রতিদ্বন্দ্বিতা
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪৪৷ তবে এই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ ২৮টি দল৷ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে থাকা বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো এই ভোট বর্জনের ডাক দিয়েছে৷ মোট ১৬টি নিবন্ধিত দল এই নির্বাচনে নেই৷ নওগাঁ-২ আসন বাদ দিয়ে ৪৩৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ ভোটে আছেন এক হাজার ৯৬৯ জন প্রার্থী৷
ছবি: Zobaer Ahmed/DW
নির্বাচনি কর্মকর্তা
দুই জন বিভাগীয় কমিশনার এবং ৬৪ জন জেলা প্রশাসক মিলিয়ে মোট ৬৬ জন সরকারি কর্মকর্তা এই নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন৷ সহকারি রির্টানিং কর্মকর্তার সংখ্যা ৫৯০ জন৷ বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়ে তিনশটি নির্বাচনি এলাকায় গঠন করা হয়েছে ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিটি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা
সাধারণ এবং গুরুত্বপূর্ণ—এই দু্ই ভাগে ভোটকেন্দ্রগুলোকে ভাগ করেছে নির্বাচন কমিশন৷ মেট্রোপলিটন ও বিশেষ এলাকার প্রতিটি সাধারণ কেন্দ্রে অস্ত্রসহ পুলিশ সদস্য থাকবেন দুই জন, আনসার ১২ জন এবং দফাদার বা মহল্লাদার এক বা দুই জন৷ আর গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হলে অস্ত্রধারী পুলিশের সংখ্যা একজন বাড়ানো হবে৷ মেট্রোপলিটন এলাকার প্রতিটি সাধারণ কেন্দ্রে অস্ত্রসহ তিন জন পুলিশের সঙ্গে থাকবেন ১২ জন আনসার সদস্য৷
ছবি: Indranil Mukherjee/AFP
মাঠে থাকছে স্ট্রাইকিং ফোর্স ‘সেনাবাহিনী’
‘স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসনকে’ সহায়তা দিতে ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’-এর আওতায় ভোটের মাঠে সশস্ত্র বাহিনীকে নামিয়েছে নির্বাচন কমিশন৷ ৩ জানুয়ারি থেকে নামানো হয়েছে তাদের, থাকবেন ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত৷ ৬২টি জেলায় নেমেছেন ৩৮ হাজার ১৫৪ জন সেনা সদস্য৷ আর ভোলা ও কক্সবাজারসহ ১৯টি জেলায় নামানো হয়েছে দুই হাজার ৮২৭ জন নৌবাহিনীর সদস্য৷
ছবি: DW
মোবাইল টিম
মোবাইল টিম হিসেবে মাঠে রাখা হয়েছে বিজিবি, কোস্টগার্ড, .ব্যাব, পুলিশ ও আনসার সদস্যদের৷ দেশজুড়ে নির্বাচনি পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে বিজিবির ৪৫ হাজার ১৮৫ জন, কোস্টগার্ডের দুই হাজার ৫২০ জন, পুলিশের ১০ হাজার ১৯২ জন এবং আনসারের ৪৪ হাজার ১২২ জন সদস্য কাজ করছেন৷ এছাড়া আছে র্যাবের ৬০টি টিম৷ আর রিজার্ভ রাখা হয়েছে বাহিনীটির ৯৫টি টিমকে৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
পর্যবেক্ষক ও বিদেশি সাংবাদিক
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন ২০ হাজার ৭৭৩ জন দেশি পর্যবেক্ষক৷ এদের মধ্যে ৫১৭ জন কেন্দ্রীয়ভাবে এবং ২০ হাজার ২৫৬ জন মাঠপর্যায়ে৷ আর বিদেশি পর্যবেক্ষক আছেন ১৫৮ জন৷ এদের মধ্যে ১২৬ জন এসেছেন স্বউদ্যোগে আর ৩২ জনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন৷ এছাড়া, ৭৬ জন বিদেশি সাংবাদিক এবং বিভিন্ন দেশের নির্বাচন কমিশনার ও তাদের প্রতিনিধি মিলিয়ে মোট ১৮ জন ভোট পর্যবেক্ষণ ও সংবাদ সংগ্রহের কাজ করবেন৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
একনজরে তফসিল
১৫ নভেম্বর সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল৷ তফসিল অনুযায়ী মনোনয়ন জমা দেয়ার শেষ দিন ছিল ৩০ নভেম্বর, মনোনয়ন যাচাই বাছাই করা হয় ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর, আপিল দায়ের ও নিষ্পত্তি ছিল ৬ থেকে ১৫ ডিসেম্বর৷ মনোনোয়ন প্রত্যাহার শেষ হয় ১৭ ডিসেম্বর এবং প্রতীক বরাদ্দ ১৮ ডিসেম্বর৷ প্রার্থীদের নির্বাচনি প্রচারের জন্য ১৮ ডিসেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছিল৷