বাংলাদেশে রাজনৈতিক নাশকতার নিখুঁত ভিডিও ফুটেজ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে৷ প্রশ্ন উঠেছে টেলিভিশন চ্যানেল কিভাবে কোনো নাশকতার চিত্র শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পায়৷ পুলিশ বলছে, এক শ্রেণির সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগের ভিত্তিতেই এটা ঘটছে৷
বিজ্ঞাপন
প্রশ্নটি উঠছিল গত এক বছর ধরেই৷ তবে গত ছয় মাস ধরে বিষয়টি আরো বেশি করে আলোচিত হচ্ছে৷ প্রশ্ন হলো, কিভাবে সাংবাদিকরা নিয়মিতভাবে হরতালের সময় গাড়ি পোড়ানোসহ নাশকতার নিখুঁত চিত্রগুলি পাচ্ছেন? পেট্রোল বোমা নিয়ে হেঁটে যাওয়া থেকে শুরু করে গাড়ি থামানো, আগুন ধরানো এবং তা পুড়ে যাওয়া – কোনো কিছু বাদ যায় না৷ আর জামায়াতের ডাকা হরতালে পিকেটারদের এমনিতে চোখে না পড়লেও বেসরকারি টেলিভিশনের খবরে তাদের নাশকতার নিখুঁত চিত্র পাওয়া যায়৷
হরতালের আগুনে জ্বলছে বাংলাদেশ
যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিবাদে চলতি সপ্তাহে হরতালের সূচনা করে জামায়াত-শিবির৷ এএফপির হিসেবে গত ২১শে জানুয়ারি থেকে ৪ই মার্চের মধ্যে বাংলাদেশে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৮০ ব্যক্তি৷ হরতালের কিছু ছবি নিয়ে ছবিঘর৷
ছবি: Reuters
বরিশালে অগ্নিসংযোগ
জামায়াত-শিবিরের ডাকা হরতালের দ্বিতীয় দিন ৪ই মার্চ বরিশালে মোটর সাইকেলে অগ্নি সংযোগ করছে দলটির সমর্থকরা৷ এভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় হরতালের সময় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশের উপর হামলায় অংশ নেয় জামায়াত-শিবিরের সমর্থকরা৷ উদ্দেশ্য, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা৷
ছবি: Reuters
সহিংসতায় নিহত কমপক্ষে ৮০
ঢাকায় ৪ মার্চ হরতাল চলাকালে জামায়াতে ইসলামী কর্মী সন্দেহে এক ব্যক্তিকে আটক করছে পুলিশ৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দাবিতে গত ২১শে জানুয়ারি থেকে জামায়াত-শিবিরের বিভিন্ন সহিংস কর্মসূচিতে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৮০ ব্যক্তি৷ নিহতদের মধ্যে জামায়াত-শিবিরের সদস্য ছাড়াও পুলিশ, আওয়ামী লীগ কর্মী, নিরীহ পথচারী এবং সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের নাগরিকও রয়েছেন৷
ছবি: Reuters
ট্রেনে আগুন
ঢাকায় হরতাল চলাকালে ৪ মার্চ কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থানরত একটি ট্রেনে আগুন লাগে৷ ছবিতে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন জনতা৷ ঢাকা থেকে নোয়াখালিগামী ট্রেনটির তিনটি বগি আগুনে পুড়ে গেছে৷ রেলমন্ত্রী মাজিবুল হক ট্রেনে অগ্নিসংযোগের জন্য জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করেছেন৷
ছবি: Reuters
মসজিদ থেকে গ্রেপ্তার
হরতাল চলাকালে ৪ মার্চ ঢাকার একটি মসজিদ থেকে জামায়াত কর্মী সন্দেহে কয়েকজনকে আটকে করে পুলিশ৷ জামায়াতের ভাইস-প্রেসিডেন্ট দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়ার পর বাংলাদেশে সহিংসতার তীব্রতা বেড়ে যায়৷ ২৮ ফেব্রুয়ারি এই রায় ঘোষণার পর বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতায় ৪ মার্চ অবধি প্রাণ হারিয়েছেন ৬৪ ব্যক্তি৷
ছবি: Reuters
অব্যাহত অগ্নিসংযোগ
হরতালের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে অগ্নিসংযোগ৷ রাস্তায় টায়ার পোড়ানো, গাড়িতে আগুন, ট্রেনে আগুন, মার্কেটে আগুন – চলতি হরতালে সবই দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ৷ ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে এখন হরতালের সহিংসতার ভিডিও পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বের সব প্রান্তে৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ৩ মার্চ রাস্তায় অগ্নিসংযোগ করছে জামায়াতের সমর্থকরা৷
ছবি: Reuters
‘কপাল পোড়ে’ সাধারণ মানুষের...
জীবিকার তাগিদে রাস্তায় নেমেছিলেন এই অটোরিকশা চালক৷ ২ মার্চ ঢাকায় জামায়াতের কর্মীদের ছোড়া ইটের টুকরায় গুরুতর আহত হন তিনি৷ অটোরিকশাও ভেঙ্গে গেছে৷ রাজনৈতিক সহিংসতায় এভাবেই ‘কপাল পোড়ে’ সাধারণ মানুষের৷
ছবি: Reuters
শরিক জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি’র তাণ্ডব
দুই মার্চ ঢাকায় এভাবেই গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র কর্মীরা৷ সেদিন ঢাকায় মিছিল করেছিল বিএনপি এবং জামায়াতের সমর্থকরা৷ পুলিশ অবশ্য বিরোধীদের কঠোর হাতে মোকাবিলার চেষ্টা করছে৷
ছবি: Reuters
রাবার বুলেট, বুলেট
২ মার্চ ঢাকায় বিএনপি কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলাকালে বন্দুকে রাবার বুলেট ‘লোড’ করছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা৷ তবে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, সেদিন সংঘর্ষ চলাকালে সত্যিকারের বুলেটও ব্যবহার করে পুলিশ৷ এছাড়া হরতাল চলাকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ আত্মরক্ষায় বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে৷
ছবি: Reuters
চোখের সামনে জ্বলছে আগুন
২ মার্চ ঢাকায় বিএনপি সমর্থকরা গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে৷ ছবিতে পুলিশ একটি জ্বলন্ত গাড়ি দেখছে৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে চলমান সহিংসতাকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে জামায়াত-শিবিরকে সমর্থন জানিয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি৷
ছবি: Reuters
একদিনে নিহত কমপক্ষে ৩৪
২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে ফাঁসির রায় ঘোষণার দিনে সহিংসতায় বাংলাদেশে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৩৪ ব্যক্তি৷ এদের মধ্যের ২৩ জন পুলিশ এবং ইসলামপন্থিদের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হন৷ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একদিনে এত সহিংসতা দেখেনি বাংলাদেশ৷
ছবি: AFP/Getty Images
10 ছবি1 | 10
টেলিভিশনে এ ধরনের ঘটনার খবর সংগ্রহ করা কয়েকজন সাংবাদিক স্বীকার করেন যে এ ব্যাপারে তাঁদের আগে থেকেই খবর দেয়া হয়৷ শুধু তাই নয়, সে সব সাংবাদিকরা ক্যামেরা নিয়ে না যাওয়ায় পর্যন্ত পিকেটাররা নাশকতার ঘটনা ঘটায় না৷ এমনকি যদি ক্যামেরা না যায়, তাহলে নাশকতার ঘটনা ঘটানো পর্যন্ত হয় না৷ শুধু টেলিভিশন নয়, পত্রিকার ফটো সাংবাদিকদেরও নাকি নাশকতা সম্পর্কে আগে থেকেই খবর দেয়া হয়৷ বৈশাখী টেলিভিশনের সিনিয়র বার্তা সম্পাদক সাইফুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, বিষয়টি তাঁদের নজরেও এসেছে৷ তবে সবাইকে যে খবর দেয়া হয়, তা নয়৷ নাশকতা সৃষ্টিকারীরা তাদের বিশ্বস্ত সাংবাদিকদের খবর দেয়৷ আর সেই সাংবাদিকদের ধারণ করা ফুটেজ অথবা ছবিই পরে ধার করে নেন অন্যরা৷ এভাবেই চলছে৷
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, তাঁদের কাছে প্রমাণ আছে যে সাংবাদিকরা ক্যামেরা নিয়ে যাওয়ার পর নাশকতার কাজ শুরু হয়৷ তাঁদের সঙ্গে নাকি আগে থেকেই যোগাযোগ করে জানানো হয়, কোথায় এবং কখন নাশকতা করা হবে৷ শুধু তাই নয়, পুলিশ টের পেয়ে যাওয়ায় সমঝোতার ভিত্তিতে নাশকতার স্থানও পরিকর্তন করা হয় অনেক সময়৷ তাই হরতালে পুলিশ এখন সাংবাদিকদের, বিশেষ করে টেলিভিশন সাংবদিকদের অনুসরণ করেন৷ তাতে পুলিশ সুফলও পায়, জানান মনিরুল ইসলাম জানান৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘টেলিভিশন সাংবাদিকতা' বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শফিউল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, সাংবাদিকতার এই প্রবণতা গ্রহণযোগ্য নয়৷ এটা অপরাধীদের সঙ্গে এক ধরনের সহযোগিতা৷ কোনো ঘটনা পেয়ে গেলে তা ধারণ করা সাংবাদিকতা৷ কিন্তু কেউ যদি কোনো সাংবাদিককে খবর দিয়ে কাউকে হত্যা করে আর সেই সাংবাদিক যদি পুলিশকে খবর না দিয়ে হত্যাকাণ্ডের ফুটেজ ধারণ ও প্রচার করেন, তা কোনো বিবেচনাতেই সাংবাদিকতা হতে পারে না৷ সাংবাদিকদের এ থেকে বিরত থাকা উচিত৷ নয়ত যাঁরা এর সঙ্গে যুক্ত তাঁরা অইনি ব্যবস্থার মুখে পড়তে পারেন৷
বৈশাখী টেলিভিশনের সিনিয়র বার্তা সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, সাংবাদিকতার এই প্রবণতা সবাইকে মিলে বন্ধ করতে হবে৷ কারণ প্রতিযোগিতার এই সময় কোনো একক প্রতিষ্ঠান তা করতে পারবে না৷ তিনি মনে করেন, এই প্রবণতা বন্ধে সাংবাদিক ইউনিয়নসহ সাংবাদিক সংগঠনগুলোরও সোচ্চার হওয়ায় প্রয়োজন৷ তিনি জানান, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর এই প্রবণতা শুরু হয়েছে৷ অনেক সময় নাশকতা যারা করে, তারাই আবার তা ক্যামেরায় ধারণ করে পাঠিয়ে দেয়৷ আর কোনো কোনো টেলিভিশন চ্যানেল তা নিজস্ব ফুটেজ হিসেবে প্রচারও করে৷
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলামের কথায়, তাঁরা সাংবাদিকদের অনুরোধ করছেন তাঁরা যেন কোনোভাবেই কোনো অপরাধীর সহায়ক শক্তিতে পরিণত না হন৷ কেউ যদি সে রকমটা করেন এবং তার প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে, বলেন মনিরুল ইসলাম৷