চরম অস্থিরতার মধ্যে হঠাত্ করে ‘সংলাপের সু-বাতাস’ বইছে বাংলাদেশে৷ এর আগে সংলাপ নিয়ে নানা আলোচনা হলেও শর্তের বেড়াজালে আটকে ছিল সব কিছু৷ কিন্তু মঙ্গলবার সকাল থেকেই সরকারি দল ও প্রধান বিরোধী দলের নেতাদের সুর অনেকটাই নমনীয়৷
বিজ্ঞাপন
জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অসকার ফার্নান্দেজ তারানকো ঢাকা সফর করে সব রাজনৈতিক দলকে সংলাপে বসে সংকট সামাধানের জন্য যে চাপ দিয়েছেন, তাতেই বরফ গলতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা৷
আওয়ামী লীগ নেতারা আভাস দিয়েছেন যে, খুব শিগগিরই দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সংলাপের আহবান জানিয়ে বিরোধী দলীয় নেত্রীর কাছে চিঠি পাঠাবেন৷ তবে বিরোধী দল ‘শর্তযুক্ত' সংলাপের কথা বললেও শেষ পর্যন্ত যে চিঠি যাবে, তাতে ‘শর্তহীন' সংলাপের আহবানই জানানো হবে৷ অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিএনপিও খানিকটা ছাড় দিয়ে ‘শর্তহীন' সংলাপেই বসতে রাজি৷ অবশ্য শর্ত থাক আর না থাক দুই দলের সংলাপ যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়েই হবে, তা এখনই পরিষ্কার করে বলে দেয়া যায়৷
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলী খান ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান হোক – তা দেশের সবাই চান৷ তাই কার আহবানে ‘সংলাপের সু-বাতাস' বইছে সেটি বড় কথা নয়৷ আসলে কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে চায় দেশবাসী৷ তিনি বলেন, সমস্যা আমাদের, তাই সমাধানও আমাদেরই করতে হবে৷ দুই নেত্রীকে আলোচনায় বসে সব সংকট নিরসনে একযোগে কাজ করতে হবে৷ তিনি বলেন, এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ছাড় বিএনপিকেই দিতে হবে৷ কারণ, তাদের অনেক নেতা কারাগারে আছেন৷ তাই দেশবাসীর স্বার্থে, দেশের স্বার্থে দু'পক্ষকেই নমনীয় হওয়ার আহবান জানিয়েছেন আকবর আলী খান৷
মৃত্যুকূপ থেকে যেভাবে ফিরলেন রেশমা
সাভারে ধসে পড়া ভবন থকে ১৭ দিন পর উদ্ধার করা হয় জীবিত রেশমাকে৷ এই সতের দিন তিনি কিভাবে কাটিয়েছেন? প্রশ্ন অনেকের মনে৷ চলুন উত্তর খোঁজা যাক৷
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
সুস্থ আছেন রেশমা
সাভারে ধসে পড়া ভবন থকে ১৭ দিন পর উদ্ধার করা হয় জীবিত রেশমাকে৷ তিনি এখন সুস্থ আছেন৷ কিন্তু ধসে পড়া রানা প্লাজার মধ্যে কিভাবে সতের দিন কাটিয়েছেন তিনি? প্রশ্ন অনেকের মনে৷ চলুন ছবিতে উত্তর খোঁজা যাক৷
ছবি: Reuters
উদ্ধার অভিযান
১০ মে স্থানীয় সময় বিকেল সোয়া ৩টার দিকে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকর্মী রাজ্জাক ধসে পড়া ভবনের মধ্যে বেঁচে থাকা একজন মানুষের উপস্থিতি টের পান৷ সেই মানুষটি রেশমা৷ তিনি একটি ভাঙা পাইপ দিয়ে নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন এবং তাঁকে বাঁচানোর অনুরোধ জানান৷ এরপর রড কেটে ভিতরে ঢুকে বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে রেশমাকে বাইরে নিয়ে আসা হয়৷
ছবি: Getty Images/STRDEL
যেভাবে টিকে ছিলেন রেশমা
১৭ দিন রেশমা কি খেয়ে টিকে ছিলেন সেই প্রশ্ন অনেকের৷ উদ্ধারকর্মী রাজ্জাক জানান, ‘‘রেশমা যে তলায় আটকে ছিলেন সেটা অন্যান্য তলার মতো মিশে যায়নি৷ সেখানে হাঁটা-চলা এবং নড়া-চড়া করার কিছুটা সুযোগ ছিল৷ রেশমা তাঁকে জানান যে, ঐ জায়গায় বিভিন্ন ধরনের শুকনা ও জুস জাতীয় খাবার ছিল, যা তিনি খেয়েছেন৷ ৭ মে শুকনা খাবার শেষ হয়ে যায় আর রসালো খাবার যায় পচে৷ ফলে শেষের দু’দিন ধরে তিনি অভুক্ত ছিলেন৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
চিকিৎসকের ব্যখ্যা
ধ্বংসস্তূপের নীচে রেশমার এই ১৭দিন বেঁচে থাকার ঘটনাকে ডয়চে ভেলের কাছে ব্যাখা করেছেন মিটফোর্ড হাসপাতালের চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. মনি লাল আইচ৷ তিনি বলেন, ‘‘রেশমা ১৭ দিনে হৃদরোগ বা নিউরোলোজিক্যাল সমস্যায় পড়তে পারতেন৷ হয়ত মানসিক জোর এবং বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছার কারণেই তাঁকে সেই সমস্যায় পড়তে হয়নি৷ আর গবেষণায় প্রমাণিত যে নারীদের মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি৷’’
ছবি: Reuters
গোটা বিশ্বে আলোড়ন
রেশমাকে ১৭ দিন পর জীবিত উদ্ধারের খবরে গোটা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত সাভারে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এই তরুণীকে দেখতে যান৷ রেশমাকে কেউ যাতে মানসিকভাবে পীড়া না দেয় সেজন্যও সবাইকে নির্দেশনা দেন শেখ হাসিনা৷
ছবি: dapd
তৃতীয় নারী রেশমা
১৭ দিন ধরে অন্ধকারে ডুবে থাকা রেশমাকে উদ্ধারের খবরের সঙ্গে একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে বিবিসি৷ এতে দেখা যাচ্ছে, এর আগে পাকিস্তানে একই রকম পরিস্থিতিতে নাকাশা বিবি নামক এক নারী পচা খাবার আর পানি খেয়ে টিকে ছিলেন ৬৩ দিন৷ আর হাইতির ইভান্স মোনসিজনাক টিকে ছিলেন ২৭ দিন৷ এই সময়ের পর তাদের জীবিত উদ্ধার করা হয়৷
ছবি: Getty Images
পরিবারের সঙ্গে দেখা
রেশমার মা জোবেদা খাতুন, দুই ভাই ও বোন আসমা গত কয়েকদিন ধরেই রয়েছেন সাভারে৷ হাসপাতালে রেশমার সঙ্গে দেখা করেছেন তারা৷ রেশমার বড় ভাই জাহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘‘বর্তমানে রেশমা ভালো আছে, সুস্থ আছে৷’’
ছবি: Reuters
বাড়ছে মৃতের সংখ্যা
এদিকে, সাভারে ভবন ধসে মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে৷ গত ২৪ এপ্রিল ভবন ধসের পর ১২ মে অবধি উদ্ধার করা হয়েছে ১,১২৭ টি মৃতদেহ৷ নিহতদের মধ্যে ঠিক কতজন নারী আর কতজন পুরুষ – সেই হিসেব এখন আরা জানা যাচ্ছে না৷ অনেক মরদেহ পচে গেছে৷ গোটা বিশ্বে স্মরণকালের মধ্যে ভয়াবহতম ভবন ধস এটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তবুও কি সতর্ক আমরা?
সাভার ভবন ধসের পর কতটা সতর্ক হয়েছে বাংলাদেশ? এই প্রশ্ন অনেকর মনে৷ বিশেষ করে, যে পোশাক খাত বাংলাদেশকে গোটা বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তুলছে, সেই খাতের শ্রমিকদের নিরাপত্তায় সরকার কতটা সচেষ্ট? সর্বশেষ খবর হচ্ছে, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার৷ রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক শিল্পের যে নেতিবাচক ‘ইমেজ’ তৈরি হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতেই এই পদক্ষেপ৷
ছবি: Reuters
‘আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক’
শান্তিতে নোবেল জয়ী বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনূস গত ৯ মে একটি নিবন্ধের একাংশে লিখেছেন, ‘‘সাভার ট্র্যাজেডি জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক৷ রানা প্লাজার ফাটল ফেটে ভবন ধসে দেখিয়ে দিলো আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যে বিশাল ফাটল ধরেছে সেটা আমলে না নিলে জাতিও এরকম ধসের ভেতর হারিয়ে যাবে৷’’
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
এরপরেও সরাসরি সংলাপ, না কারো মধ্যস্থতায় এই সংলাপ হবে – তা নিয়ে কথা উঠেছে৷ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান মঙ্গলবার স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে সংলাপে ভূমিকা রাখার অনুরোধ করেছেন৷ অধ্যাপক মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক সহিংসতা নিরসনে নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে স্পিকার ভূমিকা রাখতে পারবেন বলেই মনে করেন তিনি৷ তিনি বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক সহিংসতা নিরসনে একটি প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত৷ বর্তমান যে পরিস্থিতি তার প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক সহিংসতা মোকাবেলায় জনগণের অধিকার বাস্তবায়ন করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই৷ এই দৃষ্টিকোণ থেকে যদি খোলা মন নিয়ে সংলাপে বসা যায়, তাহলে নিশ্চয় এর একটা সমাধান হবে৷
মঙ্গলবার চিকিত্সার জন্য সিঙ্গাপুর যাওয়ার আগে বিমানবন্দরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও আশা প্রকাশ করে বলেছেন, অর্থবহ সংলাপের মাধ্যমেই রাজনৈতিক সংকটের উত্তরণ ঘটবে৷ তিনি বলেন, দেশবাসী বিশ্বাস করে একটি অর্থবহ সংলাপের মাধ্যমে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকটের উত্তরণ ঘটবে৷ এছাড়া, বিএনপিও চায় যে, দেশে শান্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হোক, সব সমস্যার সমাধান হোক৷
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আগামী নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণেই অনুষ্ঠিত হবে৷ আর এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করার জন্য তা কোন পদ্ধতিতে হবে, তা প্রধান দুই দল বসে আলোচনার মাধ্যমেই ঠিক করবে৷ খুব শিগগিরই সংলাপের আভাস দিয়ে তিনি বলেছেন, দুই দলই খোলা মন নিয়ে আলোচনা করলে দেশের কোনো সংকটই আর থাকবে না৷
প্রসঙ্গত, চার দিন ধরে দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে আগামী নির্বাচন নিয়ে তাদের মতানৈক্য দূর করতে এবং দ্রুত সংলাপ শুরু করার তাগিদ দেন জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অসকার ফার্নান্দেজ তারানকো৷ সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সংলাপ দ্রুত শুরু হলেই সমাধান বের করা সহজ হবে৷ কারণ, সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে৷